ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াইয়ে তৈরি পোশাকশিল্প
পোস্ট করেছেন: dinersheshey | প্রকাশিত হয়েছে: জুন ১৮, ২০২০ , ৭:০৬ পূর্বাহ্ণ | বিভাগ: অর্থ ও বাণিজ্য
দিনের শেষে প্রতিবেদক : রপ্তানির বাজার ভালো নেই অর্থবছরের শুরু থেকেই। বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া করোনা ভাইরাস বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানিতে ভয়াবহ প্রভাব ফেলেছে। এরমধ্যে তৈরি পোশাক রপ্তানির অবস্থা সবচেয়ে নাজুক। করোনায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বাজার সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাতিল হয়েছে বড় অঙ্কের রপ্তানি ক্রয়াদেশ। এমন সংকটে প্রস্তাবিত ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে কিছু নীতিসহায়তা দিয়েছে সরকার। উৎস কর ১ শতাংশ থেকে কমিয়ে শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ করার পাশাপাশি এ খাতে প্রণোদনা আগের ১ শতাংশই রাখা হয়েছে। তবে পরিবেশবান্ধব কারখানার সনদ আছে, এমন কারখানায় করপোরেট কর ১০ শতাংশ আরো দুই বছরের জন্য বাড়ানোর প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। ব্যবসায়ীরা সরকারের এমন নীতিসহায়তাকে স্বাগত জানালেও করোনা পরিস্থিতির মধ্যে এসব সুবিধা কতটা কাজে লাগানো সম্ভব হবে, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন বিশ্লেষকরা।
করোনা ভাইরাস মহামারির অভিঘাতে গত এপ্রিলে দেশে রপ্তানি আয় এসেছে মাত্র ৫২ কোটি ডলার। এক মাসে এত কম পরিমাণে রপ্তানি আয় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেখা যায়নি। সর্বশেষ প্রকাশিত রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, গত ১১ মাসে তৈরি পোশাকের রপ্তানি কমেছে ১৯ শতাংশ। লক্ষ্যমাত্রা থেকে আয় কম হয়েছে ২৬ দশমিক ৩১ শতাংশ। গত ১১ মাসে মোট দুই হাজার ৫৭০ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে। গত বছরের একই সময়ে এই
পরিমাণ ছিল তিন হাজার ১৭৩ কোটি ডলার। জানা গেছে, করোনা ভাইরাসের কারণে এক হাজার ১৫০ কারখানার ৩১৮ কোটি ডলারের তৈরি পোশাকের ক্রয়াদেশ বাতিল বা স্থগিত হয়েছে। মূলত ইউরোপ ও আমেরিকায় করোনা জেঁকে বসার সঙ্গে সঙ্গেই বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি খাত টালমাটাল হয়ে পড়ে।
গোটা রপ্তানি খাতে এমন সংকটের মধ্যেই প্রস্তাবিত বাজেটে কিছু নীতিসহায়তা দিয়েছে সরকার। এরমধ্যে উৎস কর ১ শতাংশ থেকে কমিয়ে শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ করা হয়েছে। পরিবেশবান্ধব কারখানার সনদ আছে, এমন কারখানায় করপোরেট কর ১০ শতাংশ আরো দুই বছরের জন্য বাড়ানোর প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। তবে পোশাক খাতে বর্তমান ১ শতাংশ প্রণোদনাই বহাল রাখা হয়েছে। দেশের রপ্তানি খাত ঘুরে দাঁড়াবে আশা করে প্রস্তাবিত বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেন, করোনা ভাইরাস মহামারিতে বিশ্বব্যাপী লকডাউনের কারণে আগামীতে রপ্তানি আরো কমবে। তবে আশা করা যায়, করোনার প্রভাব মোকাবিলায় সরকারে দেয়া আর্থিক প্রণোদনার সুবিধা নিয়ে বস্ত্র ও তৈরি পোশাকশিল্প ঘুরে দাঁড়াবে। আগামী ২০২০-২১ অর্থবছরে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি কাক্সিক্ষত ধারায় ফিরতে পারবে। এদিকে দেশীয় বস্ত্রশিল্প বিকাশে প্রস্তাবিত বাজেটে অর্থমন্ত্রী পলিয়েস্টার, রেয়ন ও অন্য সব সিনথেটিক সুতার ওপর মূল্য সংযোজন কর (মূসক) মূল্যভিত্তিক ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে সুনির্দিষ্ট কর প্রতি কেজি ছয় টাকা এবং সব ধরনের কটন সুতার ওপর সুনির্দিষ্ট কর চার টাকা প্রতি কেজি থেকে কমিয়ে তিন টাকা করার প্রস্তাব করেন।
জানতে চাইলে তৈরি পোশাক খাতের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি ড. রুবানা হক ভোরের কাগজকে বলেন, সারা বিশ্ব কোভিড-১৯-এর মহামারিতে টালমাটাল, ঠিক সে রকম এক অভ‚তপূর্ব সংকটের মধ্য থেকে সরকার বাজেট ঘোষণা করেছে। এ খাতে রপ্তানির অবস্থা খুবই খারাপ। সব অর্ডার ভারত-পাকিস্তানে চলে যাচ্ছে। তিনি বলেন, আশা করি ক্ষুদ্র-মাঝারি শিল্পের জন্য ২০ হাজার কোটি টাকা ও বৃহৎ শিল্পের জন্য ৩০ হাজার কোটি টাকার চলতি মূলধন ঋণ সহায়তা প্যাকেজ দুটিও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে দ্রুততার সঙ্গে বিতরণ করা হবে। তিনি আরো বলেন, শিল্পের এ কঠিন সময়ে উৎস কর ০ দশমিক ২৫ শতাংশ হারে আরো পাঁচ বছর অব্যাহত রাখতে অনুরোধ করছি। এ ছাড়া কৃত্রিম তন্তু উৎপাদনকে কর থেকে অব্যাহতি দেয়ার ফলে এ খাতে বিনিয়োগ আরো উৎসাহিত হবে এবং প্রকারান্তরে এটি আমাদের রপ্তানি বহুমুখীকরণ এবং উচ্চমূল্যের পণ্যে যেতে সহায়তা করবে।
এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, করোনার কারণে তৈরি পোশাকশিল্পে খারাপ সময় যাচ্ছে। বাজেট প্রস্তাবে নেয়া পদক্ষেপ বাস্তবায়ন হলে এই মন্দা কাটিয়ে উঠতে তা সহায়তা করবে। বাজেট প্রস্তাবে কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক ছাড় দেয়ায় শিল্পে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, রপ্তানি এখন বড় দুশ্চিন্তার খাত। বিশেষ করে করোনার কারণে তৈরি পোশাকের চাহিদা কমে গেছে। করোনা পরিস্থিতির মধ্যে বাজেটে যেসব সুবিধা দেয়া হয়েছে বাস্তবে কতটা কাজে লাগানো সম্ভব হবে, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে।
এদিকে, সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বাংলাদেশের ‘কান্ট্রি ফোকাস’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোভিড-১৯-এর প্রভাবে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান দুটি খাত তৈরি পোশাক রপ্তানি ও রেমিট্যান্স মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হয়েছে। এর আগে বাংলাদেশের সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে আইএমএফ, তা ২১ মে সম্পন্ন হয়। এ মূল্যায়ন নিয়ে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে সংস্থাটি। প্রতিবেদনে আইএমএফ বলছে, চলতি অর্থবছর বাংলাদেশের রপ্তানি খাতে ১৭ দশমিক ৯ শতাংশ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হবে। মূলত পোশাক খাতে ধসের কারণে সার্বিকভাবে এ রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক হবে। পোশাক খাত থেকে মোট রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশ আসে। গত মে মাসে এক লাফে রপ্তানি আয় কমেছে ৬২ শতাংশ।
জানা গেছে, দেশের গ্রামীণ অর্থনীতিতে প্রবাসী আয়ের মতো অভ্যন্তরীণ রেমিট্যান্স হিসেবে অবদান রাখে পোশাক খাত। এ খাতের ধাক্কা একটি সামাজিক অস্থিরতা তৈরি করবে। সরকার শিগগিরই বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে না পারলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে ধস নামবে। এটা সামাল দেয়া কঠিন হবে। তাই কর্মচু্যত শ্রমিকসহ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের কর্মীদের সামাজিক সুরক্ষার আওতায় নিয়ে আসা জরুরি। সরকার তাদের জন্য বিশেষ তহবিল করতে পারে।