বদলে যাবে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনীতি, খুলনা থেকে ঢাকায় যাতায়াত ‘৪ ঘণ্টায়’
পোস্ট করেছেন: dinersheshey | প্রকাশিত হয়েছে: জুন ৩, ২০২২ , ৩:৫৩ অপরাহ্ণ | বিভাগ: /////হাইলাইটস/////
দিনের শেষে প্রতিবেদক : কৃষক জলিল মিয়া পদ্মার শিমুলিয়া ঘাটে প্রতি পিস ডেউয়া ফল বিক্রি করছিলেন ১৫ টাকা করে, পেঁপে প্রতি পিস ৬০ টাকা, ঢেড়সের কেজি ৩০ টাকা। অথচ যেসব পণ্য তিনি বিক্রি করছিলেন ঢাকার বাজারে তার অনেক বেশি। শরীয়তপুরের জাজিরা এলাকা থেকে ঢাকায় সরাসরি কোনো বাস-ট্রাক না যাওয়ার কারণে পণ্যের নায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হন বলে জানান শরীয়তপুরের পদ্মাপাড়ের কৃষক জলিল মিয়া। তিনি পদ্মা পার হয়ে ঘাট এলাকায় নিজের জমির ফল ও সবজি নিয়ে বসেছিলেন বিক্রি করতে। কৃষক জলিল মিয়া বলেন, ঢাকায় সবজি নিয়ে যেতে পারি না। যোগাযোগ-ব্যবস্থা ভালো না হওয়ায় ঢাকার পাইকারেরাও এখানে আসেন না। ফলে বাধ্য হয়ে পদ্মা পারে বিক্রি করছি। পদ্মা সেতু চালু হলে কৃষিপণ্য বিক্রিতে ঢাকার বাজার ধরতে পারবো। নিজের গাছের ছফেদা বিক্রি করছিলেন জসিম হোসেন নামের এক তরুণ। তিনি ছফেদা ১০ টাকা দরে প্রতিপিস বিক্রি করছিলেন। তিনি বলেন, মাঝিকান্দি এলাকা থেকে ছফেদা বিক্রি করতে পদ্মা পার হয়ে এ ঘাটে আসতে হয়েছে কিন্তু সেতু চালু হলে আমরা ঢাকায় গিয়ে বিক্রি করে ফিরে আসতে পারবো। লাভও বেশি হবে। শরীয়তপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত উপপরিচালক গোলাম রসুল বলেন, পদ্মা-মেঘনা নদীবেষ্টিত শরীয়তপুরের মাটি বেশ উর্বর। ফসলের ফলন ভালো হয় এ জেলায়। কেবল যোগাযোগ-ব্যবস্থা ভালো না হওয়ায় এ অঞ্চলের কৃষকেরা উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হতেন। পদ্মা সেতু চালু হলে এ অঞ্চলের কৃষকের ভাগ্য খুলে যাবে।
পরিবহন খরচ কমাতে মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও ফরিদপুরের অধিকাংশ পশু ব্যবসায়ী ট্রলারে পশু নিয়ে রাজধানীতে আসেন। অন্যদিকে যশোর, মাগুরা, সাতক্ষীরা, নড়াইল ও ঝিনাইদহের ব্যবসায়ীরাও ট্রাকে করে গবাদিপশু ঢাকায় আনেন। পদ্মা পার হতে এসব ট্রাকের জন্য এতদিন ফেরিই ছিল ভরসা। বিড়ম্বনার সঙ্গে যুক্ত হতো বাড়তি খরচ। আবার ব্যবসায়ীরা অতঙ্কে থাকতেন, অতিরিক্ত গরম বা ঠাণ্ডায় পশু আবার অসুস্থ হয়ে না যায়। অনেক সময় ফেরিঘাটে অসুস্থ গরু জবাই করে কম দামে মাংস বিক্রির নজিরও রয়েছে। এ বছর পদ্মা সেতু দিয়ে ট্রাক পার হবে বলে খুব একটা টেনশনে নেই বলে জানালেন গরু ব্যবসায়ীরা। ঢাকায় গরু নিয়ে যেতে ঘাটে অপেক্ষা করছিলেন যশোর থেকে পশু বিক্রি করতে আসা খামারি মাসুদ হোসেন। তিনি বলেন, পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় ফেরিঘাটের বিড়ম্বনা কমবে। আগে একটি ট্রাকে ২০টি গরু আনতে খরচ হতো ১৪-১৮ হাজার টাকা। এখন হয় ২২-২৫ হাজার টাকা। পদ্মা সেতু চালু হলে কম দামে ট্রাক পাওয়া যাবে কারণ ঘাটে ঘণ্টার পরে ঘণ্টা তখন অপেক্ষা করতে হবে না।
এদিকে, এর মাধ্যমে রাজধানী ঢাকা থেকে সরাসরি সড়ক পথে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার যোগাযোগের দ্বার উন্মোচিত হবে। এই সেতু ঘিরে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের দীর্ঘ দিনের স্বপ্ন। পদ্মা সেতু চালু হলে খুলনা থেকে ঢাকার যাতায়াতের সময় তিন ঘণ্টা কমে আসবে। মাত্র চার ঘণ্টায় খুলনা থেকে রাজধানী ঢাকায় যাওয়া যাবে। এতে একদিকে যেমন ভোগান্তি কমবে, তেমনি যাত্রার ব্যয়ও সাশ্রয় হবে। সব মিলিয়ে সুফল পাবে খুলনাসহ ২১ জেলার মানুষ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এখন মাওয়া-জাজিরায় পদ্মা নদী পাড়ি দিতে ফেরিতে দেড় থেকে তিন ঘণ্টার মতো সময় লাগে। আর আরিচা-পাটুরিয়া ঘাটেও যাত্রীদের সময় নষ্ট হয়। সমস্যা হলো, ঘাটে গিয়েই ফেরিতে ওঠার নিশ্চয়তা নেই। কখনো কখনো সারা দিন-রাত ঘাটে বসে থাকতে হয় ফেরিতে উঠতে। পদ্মা সেতু চালু হলে এ সময় বাঁচবে। সহজ হবে যোগাযোগ। বাড়বে ব্যবসা-বাণিজ্য। সড়ক ও জনপথ অধিদফতর (সওজ) খুলনা অঞ্চলের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী সৈয়দ আসলাম আলী বলেন, পদ্মা সেতু চালু হলে খুলনা থেকে ঢাকা যেতে সময় সাশ্রয় হবে। এখন ঢাকায় যেতে ৬-৭ ঘণ্টা সময় লাগে। ফেরি পারাপারের ওপর নির্ভর করে কত সময় লাগবে। ফেরিতে আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা সময় লাগে। সেতু চালু হলে টোল দিয়ে মাত্র ২০ মিনিটের মধ্যে পদ্মা নদী পার হওয়া যাবে। সে হিসেবে মাত্র চার ঘণ্টায় ঢাকায় যাওয়া যাবে। সরকার পদ্মা সেতু উদ্বোধন ঘোষণার তারিখ জানানোর পর থেকেই যেন আর তর সইছে না খুলনাসহ ২১ জেলার মানুষের। কবে যাবো পদ্মা সেতু দিয়ে এই স্বপ্নে সবাই বিভোর। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক মো. সামিউল হক বলেন, পদ্মা সেতু চালু হলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে যোগাযোগ ব্যবস্থায় যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটবে।
পদ্মা সেতুর সুযোগ-সুবিধা সবার আগে পাবে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ। পদ্মা পার হওয়ার সময়, ঘাটে অনেক বিড়ম্বনায় পড়তে হয় যাত্রীদের। পদ্মা সেতু চালু হলে সে বিড়ম্বনা থেকে চিরতরের জন্য মুক্তি পাবেন যাত্রীরা। তিনি আরও বলেন, দেশের বৃহত্তম এ সেতু নির্মাণ সম্পন্ন হলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর সঙ্গে রাজধানীসহ অন্যান্য অংশের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে। স্বপ্নের এ সেতু দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্রবন্দর মোংলার গতিশীলতা বাড়াবে। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা অল্প সময়ের মধ্যে পণ্য পরিবহন করে মোংলা বন্দরের মাধ্যমে রফতানি ও আমদানি করতে উৎসাহিত হবেন। দেশের অন্যতম বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত হিমায়িত মৎস্য ও পাটশিল্প, যার অধিকাংশ খুলনা থেকে রফতানি হয়। পদ্মা সেতু হলে এ আয় আরও বাড়বে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে যশোর, খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, বেনাপোল, দর্শনা ও ভোমরাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমের অর্থনীতিতে গতি সৃষ্টি হয়েছে।