যে তিন কারণে বিধ্বংসী করোনা
পোস্ট করেছেন: dinersheshey | প্রকাশিত হয়েছে: জুলাই ১, ২০২১ , ২:০৩ অপরাহ্ণ | বিভাগ: /////হাইলাইটস/////
দিনের শেষে ডেস্ক : করোনাভাইরাস সংক্রমণ ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে। গত মার্চ মাস থেকে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, স্বাস্থ্যবিধি না মানা, আক্রান্তদের কোয়ারেন্টিনে বা আইসোলেশনে না নেওয়া এবং ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের অতিমাত্রার সংক্রমণ প্রবণতার কারণেই নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হচ্ছে না রোগটিকে। মাত্রই শেষ হয়ে যাওয়া জুন মাসটি যেন দেশবাসীর জন্য এক মহাআতঙ্কের মাস ছিল। এ মাসে চারদিনের ব্যবধানে করোনায় একদিনের সর্বোচ্চ মৃত্যু এবং একদিনের সর্বোচ্চ রোগী শনাক্ত হয়েছে বলে জানায় স্বাস্থ্য অধিদফতর। পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে দেখা যায়, ২০২০ সালের মার্চে দেশে করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্তের পর বছরের শেষ দিকে এসে সংক্রমণ কমতে থাকে। কিন্তু চলতি বছরের মার্চ থেকে সংক্রমণ আবার বাড়তে থাকে। দৈনিক শনাক্ত রোগীর সংখ্যা হাজারের ওপরে চলে যায়।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের মুখপাত্র অধ্যাপক নাজমুল ইসলাম জানিয়েছেন, জানুয়ারিতে ২১ হাজার ৬২৯ রোগী শনাক্ত হলেও ফেব্রুয়ারিতে রোগী কমে হয় ১১ হাজার ৭৭ জন। কিন্তু মার্চ থেকে ক্রমাগত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। এপ্রিলে এক লাখ তিন হাজার ৯৫৭ জন রোগী শনাক্ত হয়। আর জুনে শনাক্ত হন এক লাখ ১২ হাজার ৭১৮ জন। শনাক্ত ও মৃত্যু বাড়তে থাকায় পাঁচ এপ্রিল থেকে মানুষের চলাচলে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। এ বিধিনিষেধের ফলে সংক্রমণ পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলেও ঈদুল ফিতর উপলক্ষে সে বিধিনিষেধ শিথিল হয়ে পড়ে। শহর ছেড়ে যাওয়া মানুষ গ্রামমুখী হয়, যেখানে স্বাস্থ্যবিধির কোনও বালাই ছিল না। তাতে করে জনস্বাস্থ্যবিদরা আশঙ্কা করেন ঈদের পর সংক্রমণ আবার বেড়ে যাবে। বিশেষজ্ঞদের সে আশঙ্কাই যেন এখন বাস্তবায়িত হয়েছে।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) জানিয়েছে, দেশে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের সামাজিক সংক্রমণ হয়েছে। এর ফলে প্রথমে সীমান্তবর্তী জেলা এবং পরে সেসব জেলা থেকে সংক্রমণ ছড়িয়েছে পাশের জেলাগুলাতেও। পরে স্বাস্থ্য অধিদফতর জানায়, দেশের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে করোনার সংক্রমণ রোধে বিধিনিষেধ আরোপের যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে এবং ব্যক্তিপর্যায়ে যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে তা বাস্তবায়নে শিথিলতার পরিচয় দিলে পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে। স্বাস্থ্য অধিদফতর জানায়, এসব কারণে জুন মাস স্বস্তির যাবে না।গত ঈদের সময় মানুষের চলাচলে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও মানুষের স্রোত থামিয়ে রাখা যায়নি; বরং সে সময় মানুষ ভেঙে ভেঙে, গাদাগাদি করে বাড়ি গিয়েছে। এতে করে সংক্রমণ আরও বেড়েছে।’—বলেন কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. ইকবাল আরসালান। তার ভাষায়, ‘আমরা প্রতিরোধ করতে পারিনি। যেভাবে প্রয়োজন ছিল, সেভাবে পারিনি। ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট দেশে ঢুকে যাওয়ার পর আমরা একে নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি।’
এই না পারার কারণ হিসেবে অধ্যাপক ইকবাল আর্সলান বলেন, ‘নিয়ন্ত্রণের জন্য যেসব বিধিবিধান মানা প্রয়োজন বা মানানো প্রয়োজন ছিল, সেসব বিধিনিষেধ সাধারণ মানুষকে বোঝাতে সক্ষম হইনি অথবা মানুষ আমাদের কথা কানেই নেয়নি। এই অবস্থার কারণেই সংক্রমণ এত বড়ছে। তিনি বলেন, ‘দ্রুত সংক্রমণ বাড়ার কারণ হচ্ছে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট। এটি অতি উচ্চ সংক্রমণশীল। অথচ এটাকে আমরা গুরুত্বের সঙ্গে নিতে পারিনি। এবারও লকডাউনের ঘোষণায় সেই আগের চিত্র আমরা দেখতে পাচ্ছি। মানুষ স্রোতের মতো ঢাকা ছাড়ছে, সেখানে কারও মুখে মাস্ক নেই, স্বাস্থ্যবিধি মানার বালাই নেই। এসব যদি আগামী কয়েকদিন চলতে থাকে এবং তার সম্ভাবনা যথেষ্ট আছে, তাহলে সংক্রমণের গতি আরও ঊর্ধ্বমুখী হবে, বাড়বে মৃত্যুর সংখ্যাও।’
একই ধরনের মতামত প্রকাশ করেন জাতীয় কমিটির আরেক সদস্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলামও। তিনি বলেন, ‘একদিনে শনাক্তের সর্বোচ্চ এবং মৃত্যুর সর্বোচ্চ দেখা হলো চলতি মাসে। এটাই হওয়ার কথা ছিল। তিনি বলেন, ‘কেবল গাড়ি বন্ধ করে করোনার সংক্রমণকে রোখা যাবে না, ভাইরাস সংক্রমিত হচ্ছেই।’ তার মতে, সংক্রমণ রুখতে বেশি বেশি টেস্টের কোনও বিকল্প নেই। টেস্ট করে যিনি পজিটিভ হবেন তাকে আইসোলেশনে নিয়ে যেতে হবে, যে পরিবারের সদস্য তিনি সে পরিবারের সবাইকে কোয়ারেন্টিনে নিতে হবে। কিন্তু সেটা করা হচ্ছে না।
নজরুল ইসলাম বলেন, ‘গ্রাম-উপজেলা-জেলা-রাজধানী কোথাও আইসোলেশন-কোয়ারেন্টিন হচ্ছে না। এ কারণে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে না।’ হতাশ কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘গত ঈদের সময় ট্রাকে, ফেরিতে, ভ্যানে, মাইক্রোবাসে, রাস্তায় মানুষের ঢল দেখেছিলাম। তাতে ভাইরাস ছড়ানোর সুযোগ পেয়েছিল। এবারেও সে অবস্থার পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা রয়েছে। এই প্রবণতা থামানো না গেলে সংক্রমণ আরও বাড়বে।’
এদিকে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বশেষ সাপ্তাহিক (২১ থেকে ২৭ জুন) প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ৫২ জেলা অতিউচ্চ ঝুঁকিতে আছে। এর মধ্যে আছে— চট্টগ্রাম বিভাগের কুমিল্লা, ফেনী, নোয়াখালী, চাঁদপুর, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান; রাজশাহী বিভাগের ৮ জেলার সবকটি; রংপুর বিভাগের নীলফামারী এবং গাইবান্ধা ব্যতীত সব জেলা; খুলনা বিভাগের ১০ জেলার সবকটি; ঢাকা বিভাগের মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ ও শরীয়তপুর বাদে সব জেলা; সিলেট বিভাগের সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলা; ময়মনসিংহ বিভাগের সব জেলা এবং বরিশালের ভোলা ও পটুয়াখালী বাদে সব জেলা এই তালিকায় আছে। অতি উচ্চ ঝুঁকির তালিকার বাইরের ১২ জেলা আছে মধ্যম ঝুঁকিতে।
প্রতিবেদন থেকে আরও জানা যায়, এক সপ্তাহের ব্যবধানে সবচেয়ে বেশি রোগই বেড়েছে বরিশাল বিভাগে, যা আগের সপ্তাহ থেকে ১১৮ দশমিক ৩ শতাংশ বেশি। বরিশালের পর আছে যথাক্রমে ঢাকা, ময়মনসিংহ, রংপুর, চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা ও রাজশাহী। আগের সপ্তাহের তুলনায় সারাদেশে সংক্রমণ বেড়েছে ৪৮ দশমিক ৫ শতাংশ। এই সাত দিনে মোট মৃত্যু হয়েছে ৬২৪ জনের; যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু খুলনায়, সংখ্যায় ১৭৮ জন। শতকের ওপর মৃত্যু আছে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা ও রাজশাহী বিভাগেও।