৮ চ্যালেঞ্জ নিয়েই ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বাজেট চূড়ান্ত
পোস্ট করেছেন: dinersheshey | প্রকাশিত হয়েছে: জুন ৯, ২০২২ , ৩:৫০ অপরাহ্ণ | বিভাগ: /////হাইলাইটস/////
দিনের শেষে প্রতিবেদক : মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, কৃষিখাত, স্বাস্থ্য, মানবসম্পদ, কর্মসংস্থান ও শিক্ষাখাতসহ মোট আটটি চ্যালেঞ্জকে সামনে রেখে ২০২২- ২৩ অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বাজেট তৈরি করেছে সরকার। গতকাল বিকাল ৩টায় জাতীয় সংসদে ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের বিশাল এ বাজেট উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এদিন স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে এ বাজেট উপস্থাপন করা হয়। এটি স্বাধীন বাংলাদেশের ৫১তম বাজেট। বর্তমান সরকারের টানা তৃতীয় মেয়াদের চতুর্থ বাজেট, টানা ১৪তম এবং অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের চতুর্থ বাজেট। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বাজেটে প্রাধিকার পাবে দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। ‘কোভিডের অভিঘাত পেরিয়ে উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় প্রত্যাবর্তন’ শিরোনামের এবারের বাজেটটি প্রস্তুত হয়েছে সরকারের অতীতের অর্জন এবং বর্তমান পরিস্থিতির সমন্বয়ে। এবারের বাজেটে সঙ্গত কারণেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, কৃষিখাত, স্বাস্থ্য, মানবসম্পদ, কর্মসংস্থান ও শিক্ষাখাতসহ বেশ কিছু খাতকে। মূল্যস্ফীতি গত কয়েক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। ডলারের বিপরীতে দেশের টাকার মান কমছে। ডলার সাশ্রয়ে অপ্রয়োজনীয় ও বিলাসী পণ্য আমদানিতে নিরুৎসাহ করতে বাধ্য হচ্ছে সরকার। রপ্তানি, রেমিট্যান্সে সুখবর নেই। রাজস্ব আয়েও সুখবর নেই। এজন্য বাজেটে মোট আটটি চ্যালেঞ্জের কথা বলা হয়েছে। এই আটটি চ্যালেঞ্জগুলো- মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, তেল, গ্যাস ও সারের ভর্তুকির জন্য অর্থের সংস্থান, বেসরকারি বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়ানো, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ স্থিতিশীল রাখা, ব্যাংক ঋণের সুদের হার স্থিতিশীল রাখা, রাজস্ব আহরণের পরিমাণ বাড়ানো ও বাজেট ঘাটতি কমিয়ে আনা, কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের বাস্তবায়ন পিছিয়ে দেওয়া এবং সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতা বাড়ানো। বাজেটের আকার : বাজেটের আকার চূড়ান্ত করা হয়েছে ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা, চলতি অর্থবছরে যা ছিল ছয় লাখ তিন হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। সেই হিসাবে নতুন বাজেটের আকার বাড়ছে ৭৪ হাজার ৩৮৩ কোটি টাকা। কিন্তু ব্যয়ের বিপরীতে অর্থের সংস্থান কম। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি ধরা হয়েছে, ২ লাখ ৪৬ হাজার ০৬৬ কোটি টাকা, যা গত অর্থবছরে ছিল ২ লাখ ২৫ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা। বাজেটের ঘাটতি ধরা হয়েছে, ২ লাখ ৪৫ হাজার ০৬৪ কোটি টাকা, যা গত অর্থবছর ছিল ২ লাখ ১৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। মোট রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধরণ করা হয়েছে ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা, যা গত অর্থবছর ছিল ৩ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা। বাজেটে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ।
মূল্যস্ফীতি ধরা হয়েছে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ । বাজেটের আয়: সরকার আয়ের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি নির্ভরশীল জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ওপর। চলতি অর্থবছরের মোট বাজেটের ৫৫ শতাংশ অর্থ জোগান দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছে এনবিআরকে; সবমিলিয়ে তিন লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে (জুন-মার্চ) দুই লাখ চার হাজার কোটি টাকার শুল্ক কর আদায় হয়েছে। অর্থাৎ ঘাটতি লাখ কোটি টাকার বেশি। এই যখন অবস্থা তখন আগামী অর্থবছরের নতুন বাজেটে মোট কর রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা, চলতি অর্থবছরে যা ছিল ৩ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা। আর এনবিআরকে ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছে। চলতি বাজেট থেকে এটি ৪০ হাজার কোটি টাকা বেশি। এনবিআরবহির্ভূত কর থেকে আদায় করা হবে ১৮ হাজার কোটি টাকা এবং কর ব্যতীত প্রাপ্তি খাত থেকে আদায়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৪৫ হাজার কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরে তিন হাজার ২৭১ কোটি টাকা বিদেশি অনুদান পাওয়া যাবে বলে বাজেটে উল্লেখ থাকবে। বাজেটে ব্যয় : আগামী অর্থবছরের বাজেটে পরিচালন ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ লাখ ১১ হাজার ৪০৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে সুদ দিতেই ব্যয় করতে হবে ৩ লাখ ৭৩ হাজার ২৪২ কোটি টাকা। এই সুদের মধ্যে আবার দেশের অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ ব্যয় ৭৩ হাজার ১৭৫ কোটি টাকা। বিদেশি ঋণের সুদ গুণতে হবে ৭ হাজার ২০০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ ব্যয়ের জন্য ধরা রয়েছে ৬২ হাজার কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে তা বাড়িয়ে ৬৫ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। বাজেটে ঘাটতি : আগামী বাজেটে ঘাটতিই থাকবে দুই লাখ ৪৫ হাজার ৬৪ কোটি টাকা, জিডিপির অংশ হিসেবে যা সাড়ে ৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ ছিল দুই লাখ ১৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা।
নতুন অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি পূরণের জন্য সরকারকে বেশি নির্ভর করতে হবে ব্যাংক খাতের ওপর। এই খাত থেকে নিট ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য দেওয়া হচ্ছে এক লাখ ছয় হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি ঋণের পরিমাণ ৬৮ হাজার ১৯২ কোটি টাকা। স্বল্পমেয়াদি ঋণ নেওয়া হবে ৩৮ হাজার ১৪২ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে ব্যাংক থেকে ঋণের লক্ষ্য আছে ৭৬ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা। পরবর্তী সময়ে সংশোধিত বাজেটে তা বাড়িয়ে ৮৭ হাজার ২৮৭ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। আগামী অর্থবছরের ব্যাংকবহির্ভূত ঋণের মধ্যে শুধু সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৫ হাজার কোটি টাকা, চলতি অর্থবছরে যা রয়েছে ৩২ হাজার কোটি টাকা। চ্যালেঞ্জ মূল্যস্ফীতি : নতুন বাজেটে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে ৫.৬ শতাংশ। যা গত অর্থবছর ছিল ৬. ৫ শতাংশ। এজন্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখাই আগামী বাজেটের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আমদানি ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। বাংলাদেশ আমদানি নির্ভর দেশ। ফলে একদিকে যেমন বাড়ছে মূল্যস্ফীতির চাপ, অন্যদিকে নিত্যপণ্যের দামে লাগাম টানা যাচ্ছে না। টানা তিন মাস মূল্যস্ফীতির হার ৬ শতাংশের বেশি। মানুষকে চাল, ডাল, তেলসহ সব নিত্যপণ্যই বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। গত এপ্রিল মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৬ দশমিক ২৯ শতাংশ। মার্চ মাসে ছিল ৬ দশমিক ২৪ শতাংশ এবং ফেব্রুয়ারি মাসে ৬ দশমিক ১৭ শতাংশ। গত দুই বছরে এমন মূল্যস্ফীতি আর ওঠেনি। এর আগে ২০২০ সালের অক্টোবরে মূল্যস্ফীতি উঠেছিল ৬ দশমিক ৪৪ শতাংশে। এই তথ্যগুলো বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস)। গত মার্চ মাসে মূল্যস্ফীতির বিপরীতে মজুরি বেড়েছে ৬ দশমিক ১৫ শতাংশ হারে। ফেব্রুয়ারি মাসেও মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল ৬ দশমিক ৩ শতাংশ। জিডিপির উচ্চাশা বহাল : অর্থনীতির খারাপ অবস্থার মধ্যেও জিডিপির উচ্চাশা থেকে সরে আসেনি সরকার।
আগামী অর্থবছরে তাই জিডিপির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি): আগামী অর্থবছরের জন্য এডিপির আকার ধরা হয়েছে ২ লাখ ৪৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা, চলতি অর্থবছরে যা ছিল দুই লাখ ২৫ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে দুই লাখ ৯ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়েছে। ভর্তুকিতে রেকডর্ : আসন্ন বাজেটে ভর্তুকি আসছে ৮৩ হাজার কোটি টাকার। এক বছরের ব্যবধানে এত বেশি ভর্তুকি বৃদ্ধি আগে কখনোই হয়নি। বৃদ্ধির পরিমাণ কখনো দুই হাজার, কখনোবা তিন হাজার কোটি টাকা হয়। গত পাঁচ বছরের বাজেট পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে একবার পৌনে ১০ হাজার কোটি টাকাও বেড়েছিল। কিন্তু ভর্তুকি ও প্রণোদনা বাড়াতে এবার ছাড়িয়ে যাচ্ছে অতীতের সব রেকর্ড। আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে ভর্তুকি ও প্রণোদনা বাবদ বরাদ্দ থাকছে ৮২ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে ভর্তুকি ও প্রণোদনা বাবদ বরাদ্দ ছিল ৪৯ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া ব্যাংক ঋণের সুদ স্থীতিশীল রাখাও সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে আসন্ন বাজেটে উল্লেখ করা হয়েছে। এই খাত নিয়েও বড় পরিকল্পনা থাকবে বাজেটে। এছাড়া মেগা প্রকল্পগুলো নিয়ে অর্থমন্ত্রীর চ্যালেঞ্জ রয়েছে। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, যেসব প্রকল্পের সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয়ের বিষয় রয়েছে এবং এখনই বাস্তবায়ন জরুরি নয় সেগুলো পরে বাস্তবায়ন করা হবে। আর মেগা প্রকল্পগুলো থেকে রাজস্ব কীভাবে আসবে সেটিও মাথায় রাখতে হচ্ছে অর্থমন্ত্রীকে। বেসরকারি বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান : বর্তমান সময়ে বড় ধরনের সংকটে পড়েছে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি। কোভিড-১৯ মহামারিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এ খাত।
এই মহামারিতে কমপক্ষে আড়াই কোটি মানুষ কর্মহীন হয়েছে, একাধিক বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের জরিপে এমন তথ্য উঠে এসেছে। আসন্ন বাজেটে কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে ১৪ লাখ কোটি টাকার বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এটি চলতি বাজেটের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ৪ লাখ ৩৯ হাজার কোটি টাকা বেশি। ব্যাপক কর্মসৃজনের লক্ষ্য নিয়ে এ বিনিয়োগের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। ফলে নতুন বছরের এডিপি কাটছাঁট ছাড়াই বাস্তবায়নের পরিকল্পনা নিয়েছে অর্থ বিভাগ। এর প্রতিফলন দেখা যাবে ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে। অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে ঘোষিত বাজেটের আকার ছিল ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। এবার ৭৪ হাজার ১৮৩ কোটি টাকা বাড়িয়ে ৬ লাখ ৭৭ হাজার ৮৬৪ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করা হবে। এবারের বাজেটে মূল্যস্ফীতির হার ৫ দশমিক ৬ শতাংশ ধরা হচ্ছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে যা ছিল ৫ দশমিক ৩ শতাংশ। মোট বিনিয়োগ ধরা হয়েছে জিডিপির ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ। এর মধ্যে বেসরকারি খাত থেকে ২৪ দশমিক ৯ শতাংশ ও সরকারি খাত থেকে ৬ দশমিক ৬ শতাংশ বিনিয়োগ আসবে। বাজেটে টাকার অঙ্কে নতুন জিডিপির আকার হচ্ছে ৪৪ লাখ ১২ হাজার ৮৪৯ কোটি টাকা।