ইচ্ছামতো বাস ভাড়া আদায়, যাত্রী ভোগান্তি চরমে
পোস্ট করেছেন: dinersheshey | প্রকাশিত হয়েছে: আগস্ট ১১, ২০২২ , ৩:৪৫ অপরাহ্ণ | বিভাগ: /////হাইলাইটস/////
সানি আজাদ : সরকার কিলোমিটারের হিসাবে ভাড়া ঠিক কইরা দিছে কিন্তু গাড়ির তেল তো আর কিলোমিটারে পুড়ে না। যতক্ষণ ইঞ্জিন চালায়া রাখবেন ততক্ষণই তেল পুড়বো’— কথাগুলো বলছিলেন রাজধানীর মিরপুর-গুলিস্তান রুটে চলা শিকড় পরিবহনের সহকারী আমজাদ। তিনি বলেন, রাস্তার যেই অবস্থা! যতক্ষণ চলি তারচেয়ে বেশি সময় জ্যামেই আটকায়া থাকি। তাই কিলোমিটারের হিসাবে ভাড়া কাটা সম্ভব না। নতুন করে গণপরিবহনে ভাড়া বৃদ্ধি পাওয়ায় আমজাদের মতো প্রায় সব বাসের চালক- হেল্পারদেরকেই অতিরিক্ত ভাড়া নিতে বিভিন্ন বাহানায় যাত্রীদের সঙ্গে তর্কে জড়াতে দেখা যায়। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি, ওয়ে বিল, মালিকের অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের চাপসহ নানা বাহানায় শুধু ভাড়া বাড়িয়েই তারা ক্ষান্ত হয় না, চলে ধারণক্ষমতার দ্বিগুণ যাত্রী নেওয়া। এ নিয়ে যাত্রীদের আপত্তি কানেই তোলে না বাসের চালক-সহকারীরা।
এই পরিস্থিতিকে এক যাত্রী নাম দিয়েছেন— ‘বাস বোঝাই জিম্মি’। আট মাসের ব্যবধানে দ্বিতীয় দফায় জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় গণপরিবহনে চলছে ইচ্ছা মতো ভাড়া আদায়ের মহোৎসব। সরকার থেকে ভাড়া নির্ধারণ করে দেওয়া হলেও কোনও গণপরিবহনই মানছে না সেই ভাড়া। এমনকি কোনও কোনও পরিবহনে এখনও টাঙানো হয়নি নতুন ভাড়ার তালিকা। গন্তব্য যাই হোক না কেন— নানা বাহানায় যাত্রীদের থেকে আদায় করা হচ্ছে অতিরিক্ত টাকা। নিয়মিত বাসে যাতায়াত করা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত রেদোয়ান শাফিন বলেন, ভাড়া নিয়ে ওদের সঙ্গে তর্ক করে কোনও লাভ নাই। ওরা কারো কথা শোনে না। আসলে আমরা সাধারণ যাত্রীরা ওদের কাছে জিম্মি। তেলের দাম বাড়লে সব ব্যবসায়ীরা লাভ বুঝে নেয় কিন্তু জনগণের লাভ কেউ দেখে না মন্তব্য করে আরেক বাসযাত্রী নাহিদ হাসান বলেন, তেলের দাম বাড়লো বাসের ভাড়াও বাড়লো, পরে অন্যান্য জিনিসেরও দাম বাড়বে। সবাই সবার ভাগ বুঝে নিচ্ছে কিন্তু এই জনগণের কথা কেউ ভাবে না। তারা সব কিছু চাপিয়ে দেয় আমাদের ওপর। অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের ব্যাপারে বিআরটিএ-এর পক্ষ থেকে নিয়মিত মনিটরিং করার কথা থাকলেও মিরপুর-গুলিস্তান রুটে ভাড়ার বিষয়ে কাউকে তদারকি করতে দেখা যায়নি। ফলে ভাড়া নিয়ে চলছে নৈরাজ্য।
অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের বিরুদ্ধে যাত্রীদের সচেতন ভূমিকা পালনের আহবান জানিয়ে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বাংলা বলেন, রাস্তায় গাড়ি চলাচলের বিভিন্ন দিক বিবেচনা করেই নতুন ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে। তাই কোনও ধরনের বাহানা দিয়ে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের সুযোগ নেই। বরং ভাড়া নৈরাজ্যের বিষয়ে যাত্রীদেরই আরও সচেতন ভূমিকা পালন করতে হবে। আমি যাত্রীদের অনুরোধ জানাচ্ছি যদি কোনও বাসে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের চেষ্টা করা হয় আপনারা ট্রাফিক পুলিশ বা বিআরটিএ এর কাছে যথাযথ প্রমাণসহ গাড়ির নাম্বার এবং কোম্পানির নাম লিখে অভিযোগ জানাবেন। এদিকে, বাসে ওয়েবিল পদ্ধতি বাতিলের ঘোষণা দিয়েছে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি। গতকাল এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্লাহ। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে গণপরিবহনের ভাড়া বাড়িয়ে সমন্বয় করা হলেও ওয়েবিলের নাম করে কিছু বাসের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগের মধ্যে এই সিদ্ধান্ত এলো।
এনায়েত উল্লাহ বলেন, ঢাকা মহানগরী ও এর আশপাশের রুটে চলাচল করা বাসে ওয়েবিল থাকবে না। রাস্তায় চেকার থাকবে না। পারমিট স্টপেজে গাড়ি থামাতে হবে। তবে দুই স্টপেজের মাঝে গাড়ির দরজা বন্ধ রাখা হবে। এ ছাড়া বিআরটিএ’র নতুন চার্ট অনুযায়ী ভাড়া নেওয়ার কথা জানিয়েছে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি। নতুন ভাড়ার চার্ট প্রতিটি গাড়িতে দৃশ্যমান স্থানে টাঙিয়ে রাখতে হবে বলেও জানায় সংগঠনটি। এদিকে, বিআরটিএ’র পুনর্র্নিধারিত ভাড়ার চেয়ে বেশি আদায় করা হচ্ছে কিনা, সেটি তদারকি করতে মালিকদের সমন্বয়ে ৯টি ভিজিলেন্স টিম গঠন করা হয়েছে। এসব টিম বিআরটিএ’র নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের সঙ্গে মাঠে থেকে কাজ শুরু করেছে বলেও জানিয়েছেন খন্দকার এনায়েত উল্লাহ। এর আগে ৬ আগস্ট গণপরিবহনের মালিক ও শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠক করে ভাড়া বাড়িয়ে সমন্বয় করার ঘোষণা দেয় বিআরটিএ।
জানানো হয়, ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরে প্রতি কিলোমিটারে ১৬ দশমিক ২৭ শতাংশ, এই দুই মহানগরীর আশপাশের এলাকায় (ডিটিসিএ) ১৭ শতাংশ এবং দূরপাল্লার বাস ভাড়া ২২ দশমিক ২২ শতাংশ বাড়িয়ে চার্ট করেছে বিআরটিএ। সেই হিসাবে দূরপাল্লার বাসের ভাড়া আগের চেয়ে কিলোমিটারে ১ টাকা ৮০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ২ টাকা ২০ পয়সা, ঢাকা-চট্টগ্রামে ২ টাকা ১৫ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ২ টাকা ৫০ পয়সা এবং ডিটিসিএ এলাকায় ২ টাকা ৫ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ২ টাকা ৪০ পয়সা করা হয়। ঢাকা ও চট্টগ্রামের বড় বাসে সর্বনিম্ন ভাড়া আগেরটাই ১০ টাকা এবং মিনি বাসে ৮ টাকা বহাল রাখা হয়েছে। ওয়েবিল হলো- একটি গাড়ি কোন স্টোপেজ থেকে কখন ছাড়লো, কতজন যাত্রী আছে, হাফ-পাস যাত্রী আছে কিনা, থাকলে কতজন আছেন ইত্যাদি তদারকি করা। মালিকপক্ষের নিয়োগ করা একজন পরিদর্শক এই কাজটি করে থাকেন এবং প্রয়োজনীয় তথ্য ওয়েবিলের নির্দিষ্ট কাগজে লিখে দেন। একটি বাসের রুট কয়েকটি পয়েন্টে ভাগ করা হয় এবং প্রতিটিতে একজন পরিদর্শক বা কর্মী থাকেন। তারা ওয়েবিল খাতায় ওই পয়েন্টে ওই সময়ে যাত্রীর তথ্য লিখে স্বাক্ষর করে দেন। পরে যাত্রী সংখ্যা দিয়ে ওই পয়েন্টগুলো পর্যন্ত নির্ধারিত ভাড়ার অঙ্ক গুণ করে বাস মালিক টাকা বুঝে নেন।
একেক পয়েন্ট পর্যন্ত একেক গাড়ির একেক রকম ভাড়া থাকে। কোথাও কম, কোথাও আবার বেশি দেখা যায়। আবার কখনও যাত্রী কম বা বেশি থাকে। এ ক্ষেত্রে গড়ে যাত্রী সংখ্যা ও ভাড়া হিসাব করা হয়। ওয়েবিলের কারণে যাত্রী ভোগান্তির কারণে এর আগেই ওয়েবিল বন্ধের বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত হয়। তবে এর পরও অনেকটা নিজেদের সিদ্ধান্তে ওয়েবিল চালু রেখেছিল বাস মালিকরা। তবে এবার তার ওয়েবিল বন্ধের সিদ্ধান্ত নিলেন। এক সময় ঢাকার সড়কের ফুটপাতে বুথ বসিয়ে টিকেট বিক্রি করতো গণপরিবহনগুলো। তাতে কোন স্টোটপেজ থেকে কতজন যাত্রী উঠলো, সেটি বোঝা যেতো। এখনও সেই ব্যবস্থা থাকলেও ভিন্ন রূপ নিয়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ওয়েবিল পদ্ধতি।