একটি যৌক্তিক প্রতিবাদ ও ওএসডি হওয়ার কাহিনী
পোস্ট করেছেন: dinersheshey | প্রকাশিত হয়েছে: মে ১, ২০২০ , ৫:৫৬ পূর্বাহ্ণ | বিভাগ: সম্পাদকীয়
শ্যামল দত্ত, সম্পাদক :
রিপোর্টিং ছেড়েছি বহু আগে,২০০৫ সালে। সম্পাদকের দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে আর রিপোর্টিং করা হয়ে ওঠেনি। তারপরও হাত নিশপিশ করে। বিশেষ করে অন্যায় অনিয়মের তথ্য খবর হাতে এলেই মনে হয় ফিরে যাই সেই আগের জগতে। লিখতে বসে যাই আবার। দীর্ঘদিন সাংবাদিকতা করেছি, এমনকি নির্বাহী সম্পাদক থাকাকালেও রিপোর্টিংয়ের নেশা থেকে মুক্ত হতে পারিনি। সাধারণ রিপোর্টারের মতো রিপোর্ট করেছি নানা বিষয়ে। এখনো মাঝে মাঝে মনে হয় আবার ফিরে যাই সেই জগতে। কিন্তু হয়ে ওঠে না। সংবাদপত্রের ব্যবস্থাপনার কাজটি হয়ে উঠেছে এতই জটিল যে অন্য কোনো দিকে মনোযোগ দেয়ার সুযোগ হয়ে ওঠে না।
মাঝে মাঝে এখন আবার মনে হয়, বোধহয় রিপোর্টিং করাটা আবার দরকার। বিশেষ করে দেশের এই দুর্যোগ পরিস্থিতিতেও যারা দুর্নীতির প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছে, তখন মনে হয় গণমাধ্যমের দায়িত্ব সেই মুখোশ উন্মোচন করা। তথ্য-উপাত্ত দিয়ে, সত্যনিষ্ঠ থেকে অন্যায়ের প্রতিবাদ করা। করোনার এই দুর্যোগেও কিছু মানুষ দুর্নীতির সুযোগ খুঁজছে। যখন মানুষ দেখতে পাচ্ছে মৃত্যুর দুয়ার, তখনো কিছু মানুষের দুর্নীতির দুয়ার বন্ধ হয়নি। তখন হাত নিশপিশ করে লিখতে, কলম ধরতে। নাহলে মনে হয় নিজের কাছে অপরাধী থেকে যাব। আমরা গণমাধ্যম যদি এই দুর্নীতির চেহারা উন্মোচিত না করি, তাহলে আমাদের দায় থেকে যাবে।
সম্প্রতি করোনা চিকিৎসার প্রেক্ষাপটে যে জিনিসটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, সেটা হলো সঠিক সুরক্ষাসামগ্রীর অভাব। প্রায় সাড়ে চারশ স্বাস্থ্যসেবাদানকারী আক্রান্ত শুধু এই কারণেই। গণমাধ্যমের অনুসন্ধান বলছে, এর মূল কারণ নিম্নমানের সুরক্ষাসামগ্রীর সরবরাহ। একটি ছোট অনুসন্ধান বলে দেবে এই সরবরাহের ক্ষেত্রে আমাদের প্রকৃত চেহারার ভয়াবহ চিত্র। হয়তো এটি একটি ছোট ঘটনা কিন্তু সাংবাদিকতার ভাষায় এটাকে বলা হয় ‘টিপ অব দা আইসবার্গ’। এর গভীরে রয়েছে আসল সত্য- যার ব্যাপ্তি অনেক বিশাল। দুর্নীতির চেহারাটাও অনেক বিস্তৃত। অনেক গভীরে এর শিখর। স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি নিয়ে লেখালেখি কম হয়নি কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় এ নিয়ে কোনো অগ্রগতি হয়নি, দুর্নীতির প্রবাহ অব্যাহত থেকেছে একইভাবে।
এবার দেখা যাক, একটি ঘটনার অনুসন্ধান এবং নেপথ্যের আসল সত্যি কি? পৃথিবীখ্যাত ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির কথা আমরা জানি। ওয়াশিংটন পোস্টের সাংবাদিকদের অনুসন্ধান শেষ পর্যন্ত সমাপ্ত হয়েছিল ১৯৭৪ সালের ৯ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম ক্ষমতাধর প্রেসিডেন্ট নিক্সনের পদত্যাগ দিয়ে। বাংলাদেশে সেটা আমরা আশা করি না, তবে সত্য তুলে ধরার চেষ্টা করতে অসুবিধা কি? যদি সেটা হয়ে থাকে, সঠিক তথ্য-উপাত্ত দিয়ে।
কেন্দ্রীয় ঔষধাগার থেকে সরবরাহ করা মাস্ক ‘এন-৯৫’ কিনা জানতে চেয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবরে মুগদা হাসপাতালের পরিচালকের চিঠি। সম্প্রতি রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের পরিচালক ডা শহীদ মো. সাদিকুল ইসলামকে ওএসডি করা হয়েছে। শহীদ মো. সাদিকুল ইসলাম ওএসডি হতেই পারেন কিন্তু তার এই ওএসডি হওয়ার কাহিনীটি অত্যন্ত চমকপ্রদ। কারণ এই সেই পরিচালক, যিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন হাসপাতালে পাঠানো এন-৯৫ মাস্কের মান নিয়ে। প্রশ্ন উত্থাপন করার কারণে আগেই বরিশাল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের পরিচালক কয়েক দিনের মধ্যে বদলি হয়েছেন দুবার। কয়েকজন চিকিৎসক পেয়েছেন শোকজ। তারপরও প্রশ্ন তোলার সাহস দেখালে ওএসডি হবেন এটাই স্বাভাবিক।
কিন্তু অনুসন্ধান করে দেখা যাক, ডাক্তার শহীদ যে প্রশ্ন তুলেছেন তা কতখানি সত্য? রিপোর্টার ছিলাম তাই সত্যনিষ্ঠ মন আনচান করছে অনুসন্ধানের জন্য। বিভিন্ন গণমাধ্যম এরই মধ্যে শক্তিশালী সিন্ডিকেটের বিজ্ঞাপনে সয়লাব। সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন যাচ্ছে, কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের বিজ্ঞাপন যাচ্ছে। কি আছে বিজ্ঞাপনের ভাষায়- যা একটু বিশ্লেষণ করলেই বেরিয়ে আসবে অনেক তথ্য। কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের যে বিজ্ঞাপন গত ১৯ এপ্রিল বিভিন্ন কাগজে এসেছে তাতে বলা হয়েছে, ‘কোম্পানি যে মোড়কে সাধারণ মাস্ক সরবরাহ করে সে মোড়কগুলোতে এন-৯৫ মুদ্রিত ছিল, সিএমএসডি ভুলক্রমে সাধারণ মাস্ক হিসেবেই পণ্যগুলো সরবরাহ করে। বিষয়টি প্রাথমিক পর্যায়ে নজরে আসে। সিএমএসডি তাৎক্ষণিক সরবরাহকারী কোম্পানিকে মাস্কগুলো ফেরত দেয় কেন এমন মোড়কে সাধারণ মাস্ক সরবরাহ করেছে তার লিখিত জবাব চায়। কোম্পানি দেরি না করে ভুলের ব্যাখ্যা দেয়। এবার দেখা যাক, বিভিন্ন গণমাধ্যমে জেএমআই কোম্পানির দেয়া বিজ্ঞাপনে কি লেখা আছে? একইদিনে প্রকাশিত বিজ্ঞাপনে জেএমআই বলেছে, ‘জরুরি সরবরাহকালীন সময়ে ২০৬০০ পিস ফেস মাস্ক ভুলবশত প্রোডাক্ট ডেভেলপমেন্টের জন্য সংরক্ষিত এন-৯৫ কার্টনে সরবরাহ করা হয়; এ বিষয়টি প্রাথমিক পর্যায়ে কর্তৃপক্ষের নজরে আসে এবং কেন্দ্রীয় ঔষধাগার তাৎক্ষণিক মাস্কগুলো জেএমআইকে ফেরত দেয় এবং কেন এমন মোড়কে সাধারণ মাস্ক সরবরাহ করা হয়েছে তার ব্যাখ্যা জানতে চায়। মুগদা হাসপাতালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কেন্দ্রীয় ঔষধাগার কর্তৃক প্রেরিত মালামালের তালিকায় ১০ নম্বরে ৩০০ পিস ‘এন-৯৫ ফেস মাস্ক’-এর উল্লেখ রয়েছে
দুটি বিজ্ঞাপন- একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রীয় ঔষধাগার ও অপরটি সরবরাহ প্রতিষ্ঠানের জেএমআই গ্রুপের। কিন্তু কি অদ্ভুত ভাষার মিল এ দুটি পৃথক প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনে। সরকারি প্রতিষ্ঠান সিএমএসডি ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান জেএমআইয়ের মধ্যে বিজ্ঞাপনের ভাষায় মিল থাকলেও তাদের মধ্যে অন্য কোনো যোগাযোগ আছে কিনা তা খুঁজতে যাওয়ার জন্য হয়তো আলাদা একটি জাতীয় পর্যাবেক্ষণের প্রয়োজন হবে, কিন্তু অনুসন্ধানে যখন অন্য একটি ডকুমেন্ট হাতে আসে তখন দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। গত ৩০ মার্চ কেন্দ্রীয় ঔষধাগার হাসপাতালে যে মালামাল পাঠিয়েছিল তার চালানে দেখা যায় বিভিন্ন মালামালের তালিকায় ১০ নম্বর সিরিয়ালে ছিল ফেস মাস্ক এন-৯৫ (৩০০ পিস) এবং এই সামগ্রীগুলো পাঠিয়েছেন কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে স্বাস্থ্য দপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমূহ)। কেন্দ্রীয় ঔষধাগার, জেএমআই কোম্পানী ও সরাবরাহকৃত চালানে যখন এতই অমিল, তখন বোঝা যায় প্রকৃত সত্য লুকিয়ে মিথ্যার আড়ালে।
সরবরাহকৃত এই মালামাল নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেক প্রতিষ্ঠান। এমনকি মালামাল সরবরাহের মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু বিজ্ঞাপন দিয়ে সাফাই গেয়েছেন কেন্দ্রীয় ঔষধাগার এবং সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান জেএমআই কোম্পানি। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো সরবরাহে ক্রুটি হওয়ার কারণে ভুল স্বীকার করে দায় মুক্তি চেয়েছে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান। কিন্তু প্রশ্ন তোলার অপরাধে বদলি হয়েছেন এক হাসপাতালের পরিচালক এবং ওএসডি হয়েছেন আরেক হাসপাতালের পরিচালক। কয়েকজন চিকিৎসক পেয়েছেন শোকজ লেটার। দুর্নীতির বিষবৃক্ষ কত গভীরে সেটা খুঁজতে গেলে হয়তো আমাদের আরো অনেক অনুসন্ধানের প্রয়োজন হবে।