আজকের দিন তারিখ ২৩শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, সোমবার, ৮ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সর্বশেষ সংবাদ
সম্পাদকীয় একের ভেতর তিন আওয়ামী লীগ

একের ভেতর তিন আওয়ামী লীগ


পোস্ট করেছেন: dinersheshey | প্রকাশিত হয়েছে: জুন ২৩, ২০২১ , ১২:৫১ অপরাহ্ণ | বিভাগ: সম্পাদকীয়


মাঝে মাঝে মাথা এলোমেলো হয়ে যায়। ভাবনার জটে সব গোলমেলে মনে হয়। চিন্তাগুলো যেন নাটাই সুতোর গিট্টু। খুলতে গেলে আরো জট পাকায়। একটি অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু আজীবন সংগ্রাম করেছেন। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আওয়ামী মুসলিম লীগ সৃষ্টির উদ্দেশ্য ছিল গণমানুষের একটি দল তৈরি করা। মুসলিম লীগ নবাব, জমিদার আর সমাজের উঁচু শ্রেণির মানুষের দল। এই উপমহাদেশের মুসলমানদের জন্য আলাদা একটি রাষ্ট্রের স্বপ্ন নিয়ে ১৯০৬ সালে দলটির জন্ম হলেও কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষের রাজনীতি করার দরজা ছিল বন্ধ। দলটির জন্মলগ্নে বাঙালি মুসলমান নেতারা পাকিস্তান গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর দেখা গেল পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি মুসলমানদের কোনো গুরুত্ব নেই এই দলে। কয়েকজন বাঙালি নবাব, জমিদার আর পশ্চিম পাকিস্তানিরা দখল করল ক্ষমতার মসনদ। পশ্চিম পাকিস্তানি নেতৃত্বের কূটচালে বাঙালি নেতৃত্ব পড়ে রইল অবহেলায়, যদিও সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান জনগোষ্ঠী ছিল এ পূর্ব বাংলারই। ফলে দেশভাগের মাত্র দুই বছরের মাথায় অবহেলিত-নিগৃহীত পূর্ব বাংলার মুসলিম নেতারা অনুভব করলেন তাদের নিজেদের একটি দল করা প্রয়োজন। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর একচ্ছত্র কর্তৃত্বে মুসলিম লীগ মূলত পশ্চিম পাকিস্তানিনির্ভর একটি দল।

এই দলে পূর্ব বাংলার মুসলিমদের অংশীদারত্ব নেই বললেই চলে। এ কারণেই নতুন প্রত্যাশায় ২৩ জুন ঢাকার রোজ গার্ডেনে জন্ম হলো আওয়ামী অর্থাৎ জনগণের মুসলিম লীগ। ১৯৫৫ সালে তা রূপ নিল জনগণের লীগ বা আওয়ামী লীগে। অর্থাৎ জনগণকে নিয়ে, জনগণের জন্য, জনগণের দ্বারা একটি দল। এই ‘জনগণ’ চিন্তার মূল কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল বাংলা ও বাঙালি। যে কারণে ১৯৪৭ সালের পরপরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘পাকিস্তানের জন্ম হলো বটে কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তানের অধীনস্থ একটি রাজ্যের মধ্যে রয়ে গেল। স্বাধীন বাংলার আকাক্সক্ষা বা বাঙালির আত্ম দেখার প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন অধরাই থেকে গেল।’ বাঙালি জাতির আত্মপরিচয়ের মৌলিক উপাদান বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে রক্ষাই ছিল এ দলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধুর সারা জীবনের সংগ্রামের অংশ। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সেই সংগ্রাম থেকে কী শিক্ষা নিলাম আমরা? কৃষক-শ্রমিক গণমানুষের দল থেকে কালের বিবর্তনে আওয়ামী লীগ কি আবার ধনিক গোষ্ঠীর দল হয়ে উঠেছে? যে আকাক্সক্ষা থেকে মুসলিম লীগ থেকে আওয়ামী লীগ, সেই গণমানুষের আকাক্সক্ষার বাস্তবায়ন কি আছে বর্তমান এই দলে? কোথায় সে গ্রামভিত্তিক সংগঠন, যা বঙ্গবন্ধু তিলে তিলে গড়ে তুলেছিলেন? কোথায় সেই আপামর জনগণের অংশগ্রহণ? উঠতি পুঁজিপতির ঠেলায় কাছে ভিড়তে পারছে না সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব। দলীয় পদ কেনাবেচা হচ্ছে টাকার বিনিময়ে। একদিনও সংগঠন না করে পাওয়া যায় দলের গুরুত্বপূর্ণ পদ। দীর্ঘ রাজনীতি, ত্যাগ আর সংগ্রামের মূল্যায়ন কী হয় এখন দলে? ফলে বঙ্গবন্ধু আছেন কথায়। নেই চিন্তায়, নেই হৃদয়ে। তার আদর্শ গুলিয়ে গেছে ক্ষমতার মেরুকরণের বহুমাত্রিক হিসাবে। ক্ষমতায় থাকতে হবে সেটাই বাস্তবতা; কিন্তু বঙ্গবন্ধু ও তার আদর্শকে দূরে ঠেলে দিয়ে অথবা সযত্নে পাশে রেখে দিয়ে দল ক্ষমতায় থাকলেই কি বঙ্গবন্ধুর আত্মা শান্তি পাবে?

এসব ভাবতে ভাবতে যখন মাথা ঘুরছে, চিন্তা যখন জট পাকাচ্ছে, তখন ভাবলাম এক কাপ কফি খাওয়া যাক, কিছুটা হলেও স্বস্তি পাওয়া যাবে। বনানীর ১১ নম্বর সড়কটি এখন ফুড স্ট্রিট হয়ে উঠেছে। মানুষের আয়-রোজগার বেড়েছে। মাছে-ভাতের বাঙালি এখন হারফির বার্গার বা গ্লোরিয়া জিন্সের ব্রাউন টোস্ট স্যান্ডউইচে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। ইউরোপীয় টমাহক স্টেক কিংবা সিবাস বা কড ফিশের খদ্দেরের অভাব নেই। ভাবতে ভাবতে মাথাধরা কমানোর লক্ষ্যে ভাবলাম এক কাপ কফি নিই। কফির কাপে চুমুক দিতেই চোখে পড়ল দূরে বসে আছেন এক নেতা। কিছুদিন আগে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন। বিগত সংসদ নির্বাচনে দলের মনোনয়নও পেয়েছেন। কথিত আছে এই মনোনয়নের পেছনে তার বিপুল অর্থের বিনিয়োগ আছে। এত ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন, তা নিজেই বিশ্বাস করতে পারছেন না। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর শুধু পরাজয় নয়, জামানতও বাজেয়াপ্ত হয়েছে। বিএনপির ঘাঁটি বলে পরিচিত এ আসনে প্রতিদ্ব›দ্বী বিএনপি প্রার্থীর পরাজয় নির্বাচনের ইতিহাসে রেকর্ড হয়ে থাকবে। সদ্য আওয়ামী লীগে যোগ দেয়া নেতা এই আসনে যে এতই জনপ্রিয়, তা স্বপ্নেও কেউ ভাবেননি আগে। চোখে চোখ পড়তেই কাছে এসে বসলেন। সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবির ওপর মুজিব কোটের বোতাম ফেটে যাওয়ার জোগাড়।

নেতা বললেন, কী খবর ভাই, ইদানীং টেলিভিশনে আপনাকে কম দেখি।
বললাম, কম যাই। আগের মতো টকশোতে কথা বলে মজা পাওয়া যায় না।
জিজ্ঞেস করলাম, এত গরম, ঘেমে তো সারা।
নেতা বললেন, ভাই সংসদ থেকে আসলাম। নেত্রী খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেন। যদি চোখে পড়ি, সেই আশায় মুজিব কোট পরে বসে থাকি।
মাথার ভেতরে খোঁচানোর বুদ্ধি এলো।
জিজ্ঞেস করলাম, ভাই, বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ পড়েছেন? ‘কারাগারের রোজনামচা’ বা ‘আমার দেখা নয়াচীন’?

নেতা বললেন, ভাই, তিনটাই আছে। নীলক্ষেত থেকে কিনেছি। আন্ডারলাইন করা বই কিনতে পাওয়া যায়। এজন্য ১ হাজার টাকা অতিরিক্ত দিয়েছি। ড্রয়িংরুমে সাজানো আছে। লোকে উল্টেপাল্টে দেখে আর ভাবে, আমি পড়ে পড়ে বোধ হয় আন্ডারলাইন করেছি। তবে সত্যি কথাটা আপনাকে বলি। এত ব্যস্ত থাকি, এখনো পড়া হয়ে ওঠেনি। পড়ে ফেলব। আরেকটু খোঁচাতে মন চাইল। বললাম, আপনি কি জানেন, বঙ্গবন্ধু ১৯৫৭ সালে দলের কাজ করার জন্য মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দিয়ে দলীয় পদ নিয়েছিলেন। এখন তো দলে যোগ দিয়েছেন। আপনাকে যদি দলীয় এমপি পদ ছেড়ে জেলার সভাপতির দায়িত্ব নিতে বলে, নেবেন?

প্রশ্ন শুনে কিছুটা উষ্ণ নেতার গলা। কি যে বলেন, এমপি থেকে এখন মন্ত্রী হওয়ার তদবিরে আছি। মন্ত্রিসভায় সামনে রদবদল হবে, এমন গুঞ্জনও আছে। সরকারের মেয়াদের অর্ধেক সময় তো চলে গেল। এবার মন্ত্রিসভায় রদবদল হবে না? আর আপনি বলছেন মন্ত্রী-এমপির পথ ছেড়ে দলের পদ নিতে। আপনার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। কানে কানে বললেন, মন্ত্রী হওয়ার জন্য বিশেষ জায়গায় বেশ কিছু টাকা ইনভেস্টও করেছি। দোয়া করবেন ভাই। আমি ভাবছি আমার মাথাটা না হয় খারাপ কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মাথাও কি খারাপ ছিল? তিনি কেন মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দিয়ে দলীয় পদ নিয়েছিলেন? তিনি কেন ভেবেছিলেন, মন্ত্রিত্ব করার চেয়ে সংগঠনকে শক্তিশালী করা অনেক জরুরি। ভাবতে ভাবতে মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে। এটাও একটা আওয়ামী লীগ করার স্টাইল হয়তো এখন। তারপরও জিজ্ঞেস করলাম, ‘জয় বাংলা’ বলেন?

নেতা বললেন, বলি ভাই, বলি। এলাকায় অনেক জোরে গলা ফাটিয়ে স্লোগান দিই। দীর্ঘদিন জাতীয় পার্টি করতাম তো, মাঝে মাঝে মুখে বাংলাদেশ জিন্দাবাদ চলে আসে। অনেক কষ্টে চেপে রাখি। অনেক দিনের অভ্যাস। বঙ্গবন্ধু বলতে গিয়ে মাঝে মাঝে পল্লীবন্ধু বলে ফেলি। কিছু মনে করবেন না। সবই অভ্যাস। এই বলে চেয়ার ছেড়ে উঠলেন। যাওয়ার আগে বললেন, ভাই দোয়া করবেন। যাতে মন্ত্রী হতে পারি। নেতার কথা শুনে মাথাটা আরো ঘুরছে। মাথাব্যথা মনে হয় আরো ভোগাবে। কফিতে কাজ হলো না। কড়া এক কাপ চা হলে ভালো হতো। ভাবছি, এরাও আওয়ামী লীগের মতো ঐতিহ্যবাহী একটি দলের এমপি। হয়তো মন্ত্রীও হবে। ভাবতে ভাবতে বেরিয়ে এলাম কফি শপ থেকে। বাইরে বর্ষার ঝিরঝিরে বৃষ্টি। এবার বৃষ্টি একটু কম। ঘনঘোর বর্ষায় মুষলধারে যে বৃষ্টি, তার দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। অল্প একটু বৃষ্টি হয়। তাতেই জলজট। এক কোমর পানি। এই নাকানি-চুবানি অবস্থা থেকে ঢাকাবাসীর মুক্তি নেই। বসবাসের যোগ্য শহরের তালিকায় তলানিতে ঢাকার নাম। চট্টগ্রামের অবস্থা আরো খারাপ। ফ্লাইওভারে পানি জমতে দেখে অনেকের মন্তব্য, এ রকম দোতলা নদী পৃথিবীর আর কোথাও দেখা যাবে না, এই চট্টগ্রাম ছাড়া। নিচে পানি, উপরেও পানি। কেউ কেউ বলেন, এটা উন্নয়নের প্রসব বেদনা। বছরের পর বছর এই প্রসব বেদনার যন্ত্রণা আর শেষ হচ্ছে না। তবে ঢাকার সিটি করপোরেশন বলে, ওয়াসা এর জন্য দায়ী। ওয়াসা বলছে, মেট্রোরেলের উন্নয়নের কাজ এর জন্য দায়ী। আর বিশ্লেষকরা বলছেন, ১০ বছর ধরে উন্নয়নের কাজ চলতে থাকলে জলাবদ্ধতা তো থাকবেই। এত বিশ্লেষণ, এত ব্যাখ্যায় মাথা আরো এলোমেলো।

হাঁটতে হাঁটতে ভাবছি এক কাপ চা পেলে মন্দ হতো না। কফিতে তো কাজ হলো না। চা’টা খেয়ে দেখি। স্টেডিয়ামের উল্টো দিকে রাস্তার উপরে চায়ের দোকান। বললাম, আলগা পাতা দিয়ে কড়া রংয়ের এক কাপ চা দেন। চায়ের কাপটা হাতে নিতেই দেখলাম, দূর থেকে আসছেন আরেক নেতা। দেখা হতে বললেন, আরে কি সৌভাগ্য। সাংবাদিক ভাই এইখানে।

জিজ্ঞেস করলাম, দলীয় কার্যালয়ে এসেছিলেন বুঝি?
নেতা বললেন, না রে ভাই। বঙ্গভবনে গিয়েছিলাম মহামান্যের সঙ্গে দেখা করতে। মহামান্য মহামান্য হলেও এলাকার নেতা। সবাইকে দেখা দেন তিনি। বঙ্গভবন থেকে স্টেডিয়াম এলাম। একটা বড় ফ্রিজ দরকার। ছোট ফ্রিজে আর চলে না। কর্মীরা এত জিনিসপত্র উপহার হিসেবে পাঠায়, রাখার জায়গা হয় না।

জিজ্ঞেস করলাম দলীয় কার্যালয়ে যাবেন না? তিনি বললেন, না, নেতারা যায় ধানমন্ডির অফিসে। এখানে তেমন একটা কেউ আসেন না। বললাম, এত কোটি টাকা খরচ করে এত সুন্দর একটা দলীয় কার্যালয় বানালেন। নেতারা আসেন না কেউ?

তিনি বললেন, নেতারা ধানমন্ডিকে বেশি পছন্দ করেন। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বললাম, মোগলটুলীতে ছোট্ট একটা অফিস থেকে আওয়ামী লীগের কার্যালয় শুরু। কত কষ্ট করতে হয়েছে আওয়ামী লীগকে। আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে সব নেতাই প্রায় জেলে। আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে বাতি জ্বালানোর লোক খুঁজে পাওয়া যেত না একসময়। এখন অনেক বড় বড় অফিস। নেতা অনেক, তবে কর্মীর বড় অভাব। খোঁচাটা খেয়ে মনে হলো নেতা একটু বিব্রত। ভাবলাম আরো একটু খোঁচাই। সাংবাদিকের যা অভ্যাস। বললাম, বঙ্গবন্ধুকে দেখলেই মনে হতো, আপাদমস্তক বাঙালি। ঢোলা পায়জামা-পাঞ্জাবি। ৬ ফুট উঁচু শালপ্রাংশু এক মানুষ। দেখলেই বোঝা যায় এক বিশাল ব্যক্তিত্ব। আপনারা জামাতের লেবাস ধরেছেন কেন? ইদানীং আওয়ামী লীগের অনেক নেতার লেবাস দেখলে চিনতে বড় কষ্ট হয়। নেতা বললেন, কি যে বলেন ভাই। রাজনীতি করতে হলে অনেক কিছুই করতে হয়। ভোটের জন্য যে আমরা কত কিছু করি, আপনারা বুঝতে পারবেন না।

বললাম, বঙ্গবন্ধু সত্তরের নির্বাচনে ১৬৯ আসনের মধ্যে ১৬৭ আসন পেয়েছিলেন। এসব কিছুই তো করতে হয়নি। জনগণ সঙ্গে ছিল। আর বঙ্গবন্ধুকে ভেবেছিল তাদের মুক্তির মহানায়ক। তাই পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর সব ষড়যন্ত্রকে উপড়ে ফেলে বাঙালি অকাতরে ভোট দিয়েছে বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগকে। জনগণ যদি সঙ্গে থাকে, তাহলে আর কিছু করতে হয় না।
নেতা মনে হয় একটু বিরক্ত।

বললেন, দিন পাল্টে গেছে। ভোটে ধর্মের ব্যবহার এতই প্রকট, আগে কোনো দিন তা ভাবা যায়নি। শুধু আমাদের দোষ দেখছেন কেন? অন্য দলগুলো কী করছে দেখতে পাচ্ছেন না? সংবিধানকে কীভাবে কাটাছেঁড়া করল, বিসমিল্লাহ, রাষ্ট্রধর্ম ঢোকাল। এই মৌলিক পরিবর্তনগুলোই তো আমাদেরকে আজ এই বিব্রতকর জায়গায় নিয়ে এসেছে। আমরা চাইলেও আর বাহাত্তরের অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের ফিরতে পারছি না। বিসমিল্লাহ বাদ দিতে পারছি না। রাষ্ট্রধর্মকেও ফেলে দিতে পারছি না। মানুষের ধর্মীয় আবেগকে চ্যালেঞ্জ করে এখন রাজনীতি করা যায় না। তাই জোড়াতালি দিয়ে কাজ চালাতে হচ্ছে।

বললাম, ২০০৮ সালে জনগণ আপনাদেরকে ব্যাপক ম্যান্ডেট দিয়েছিল। চাইলে আপনারা ’৭২-এর সংবিধানে যেতে পারতেন। বঙ্গবন্ধু ’৫৪ সালের নির্বাচনে যে ম্যান্ডেট পেয়েছিলেন, সেই সাহস থেকে আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগে আসার সাহস পেয়েছিলেন। আপনারা চাইলে বাহাত্তরের সংবিধানে যেতে পারতেন। কিন্তু সে সাহস আপনারা দেখাননি। আপনারা ধর্মীয় সেন্টিমেন্টকে অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন ভোটের রাজনীতির হিসাব-নিকাশের জন্য।

নেতা বললেন, আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে আওয়ামী লীগ করা হয়েছিল মুসলমানদের বাইরে সব ধর্মের মানুষকে সম্পৃক্ত করার জন্য। এখনো তো সংবিধান থেকে রাষ্ট্রধর্ম বাদ দিতে পারলাম না। বঙ্গবন্ধুর সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ছিল না। ১৯৮৮ সালের ৯ জুন সংসদে যখন রাষ্ট্রধর্ম বিল পাস হয়, তার পরদিন আওয়ামী লীগ হরতাল ডেকেছিল। সেই বছরের সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি তৎকালীন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা দেরাদুনে অধ্যয়নরত সন্তানদের দেখে দেশে ফেরার পথে কলকাতা বিমানবন্দরে আনন্দবাজার পত্রিকাকে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। সেই সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, রাষ্ট্রধর্ম বিল পাস হওয়ার জন্য ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিন্দুরা শঙ্কিত হয়ে বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর এ বক্তব্যের জন্য তৎকালীন এরশাদ সরকার তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এখন কিছুই করার নেই। আমাদের এখন সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হয়। এসব নিয়ে পড়ে থাকলে চলে না। ক্ষমতায় থাকতে হলে কম্প্রোমাইজ করতে হয়। আপনি তো নিশ্চয়ই জানেন, ‘কম্প্রোমাইজ ইজ দ্য আর্ট অব পলিটিকস’- বলে নিজেই হাসতে লাগলেন।

আমি বললাম, তা অবশ্য ঠিকই। এসব নিয়ে পড়ে থাকলে তো চলবে না। কম্প্রোমাইজ করতে করতে দলটাই না পরিবর্তন হয়ে যায়। বললাম, বঙ্গবন্ধু ছিলেন ধর্মপ্রাণ ও ধর্মীয় মূল্যবোধে বিশ্বাসী একজন মানুষ। তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে এই বিশ্বাসের জায়গায় কখনো বিচ্যুত হতে দেখা যায়নি। তিনি বলতেন, ‘আমি একজন বাঙালি, আমি একজন মুসলমান। বাঙালি আমার জাতিসত্তা, মুসলমান আমার ধর্মীয় সত্তা। এ দুয়ের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই।’ কিন্তু বঙ্গবন্ধু কখনো ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহারের পক্ষে ছিলেন না। ১৯৭৩ সালে লিবিয়া ও সৌদি আরব বাংলাদেশকে স্বীকৃতির শর্ত হিসেবে বাংলাদেশের নাম ‘ইসলামিক রিপাবলিক অব বাংলাদেশ’ করতে বলেছিলেন। বঙ্গবন্ধু রাজি হননি। তিনি বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের জনগণের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সবাই অংশগ্রহণ করেছিল। ধর্মীয় লেবাসের বিরুদ্ধে ছিল বাঙালির আজীবনের সংগ্রাম। তাই বাংলাদেশের নাম পরিবর্তনের প্রশ্নই ওঠে না।’

নেতার সঙ্গে কথা বলতে বলতে তার টয়োটা প্রাডো ল্যান্ড ক্রুজার গাড়ি এসে থামল। গাড়ি থেকে নামলেন সাঙ্গোপাঙ্গরা। সংসদ সদস্যদের জন্য বিশেষ সুবিধা হিসেবে রাষ্ট্রের দেয়া ডিউটি ফ্রি (শুল্কমুক্ত) কোটায় কয়েক কোটি টাকার গাড়ি পেয়েছেন মাত্র ৫০ লাখে। গাড়িতে সংসদের স্টিকার ও সাইরেন লাগানো। ‘চলি সাংবাদিক ভাই’ বলে বিদায় নিলেন নেতা। যাওয়ার আগে বলে গেলেন, আপনারা অনেক বেশি ভাবেন। এত ভাবলে ব্রেন হেমারেজ হয়ে যাবে।

কিঞ্চিৎ হেসে নেতা উঠলেন গাড়িতে। নেতাকে নিয়ে সাইরেন বাজিয়ে ছুটল সাঙ্গোপাঙ্গরা। ভাবছি, এটাও একটা আওয়ামী লীগ। আর ভাবছি ব্রেন হেমারেজ হলেই ভালো। এত আজে বাজে চিন্তার উর্বর ভূমি আর থাকবে না।

মাথায় ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি আরো বাড়িয়ে দিয়েছে মাথাব্যথা। হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম সদরঘাট। সন্ধ্যার লঞ্চ ছাড়ছে দক্ষিণবঙ্গ অভিমুখে। তুমুল হাঁকডাক। এক সময় এই নদী ছিল প্রমত্ত। কেউ কি বিশ্বাস করবে বুড়িগঙ্গা এতটাই খরস্রোতা ছিল যে জিঞ্জিরা প্রাসাদে বন্দী নবাব সিরাজউদদৌলার পত্নীকে এই নদীতেই নৌকা ডুবিয়ে মারা হয়েছে। বুড়িগঙ্গার পাড় ধরে হাঁটতে হাঁটতে সোয়ারিঘাটের কাছে এসে বসলাম একটি চায়ের দোকানের সামনের টুলে। পাশে এসে বসলেন একজন বয়স্ক মানুষ। চোয়ালটা ভাঙা। বোঝা যায় বয়স সত্তরের কোটায়। সাদা ধবধবে নয়, তবে পরিষ্কার জামাকাপড়। কিছুটা ফ্যাকাশে পায়জামা-পাঞ্জাবি পরা। মনে হলো কিছু একটা বলতে গিয়েও যেন বলছেন না। শেষে বলেই ফেললেন, ‘ভাই, আপনি সাংবাদিক না? আপনাকে টেলিভিশনে মাঝে মাঝে দেখি। মাঝে মাঝে সত্য বলার চেষ্টা করেন। আবার অনেক সময় দলীয় কর্মীর মতোই কথা বলেন।’

একেবারে সরাসরি আক্রমণে আমি কিছুটা বিব্রত। বললাম, সত্য কথাটা সব সময় বলা যায় না।
তিনি বললেন, সমাজে অন্যায় হবে কিন্তু সমাজটা তখনই ধ্বংস হয়ে যায়, যদি সেই সমাজে প্রতিবাদ করার মতো কেউ না থাকে।
বুঝলাম, পড়াশোনা করা মানুষ তিনি। এ বাক্যটি বিখ্যাত এক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর। জিজ্ঞেস করলাম, কী করেন ভাইজান?
বললেন, ‘একটি স্কুলের হেডমাস্টার ছিলাম। সম্প্রতি অবসর নিয়েছি। এখন মনে হচ্ছে, অনেক ছাত্র তৈরি করেছি। কিন্তু মানুষ বানাতে পারেনি। দীর্ঘদিন ধরে বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগের রাজনীতি করছি। এখন নব্যদের ঠেলাঠেলিতে দলে আর জায়গা পাই না। ওই যে আপনারা হাইব্রিড না কাউয়া- কি সব বলেন না।’ বলেই তিনি নিজেই হেসে ফেললেন।

আমি বললাম, অসুবিধাটা কী? দলে তো আছেনই। দলে পদপদবি পেতে হবে এ রকম তো কথা নেই। তিনি বললেন, তা অবশ্য ঠিক। সমস্যাটা অন্য জায়গায়। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে দল মনে হয় অনেক দূরে সরে যাচ্ছে। এখন মডেল মসজিদ হচ্ছে, ভালো কথা। এদিকে মডেল মন্দিরের দাবিও উঠছে। কদিন পরে মডেল গির্জা বা মডেল প্যাগোডার দাবিও উঠবে। কারণ এই দেশটা তো সবার। আমি যে স্কুলটাতে পড়াতাম, সেই স্কুলের ছাদটা ভেঙে পড়ছে। বর্ষায় ক্লাস নেয়া খুব কষ্টের। এই দেশের সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে শিক্ষা। কিন্তু সারাদেশে মডেল স্কুল নির্মাণ করার কথা তো কেউ বলছে না, যেটা এই মুহূর্তে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বেশি দরকার। জানেন তো, বঙ্গবন্ধু তার ছাত্রজীবনে স্কুলের সুযোগ-সুবিধার জন্য শেরেবাংলা ও সোহরাওয়ার্দীর রাস্তা রুখে দাঁড়িয়েছিলেন।

আমি বললাম, জানি। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে পড়েছি। জিজ্ঞেস করলাম, তা এখন যাচ্ছেন কোথায়? তিনি বললেন, গিয়েছিলাম নরসিংদী। উয়ারী বটেশ্বরের পাশের গ্রামে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি। ওয়ারী বটেশ্বর দেখে আসলাম। হাজার বছর আগে এই অঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র ছিল এই এলাকা। এখানকার মসলিন নিতে আসত ইউরোপের বিভিন্ন দেশের ব্যবসায়ীরা। নরসিংদী এলাকায় আজকের কাপড়চোপড়ের ব্যবসার পেছনে এটাও একটা অতীত ইতিহাস। যে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের এত গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় ছিল, সেদেশ এখনো এতটা পরনির্ভর। এজন্য তো মুক্তিযুদ্ধ করিনি।
আমি বললাম, ও আপনি মুক্তিযোদ্ধা। ভাতা পাচ্ছেন নিয়মিত? কিছুটা ক্ষিপ্ত হলেন তিনি। বললেন, ভাতার জন্য যুদ্ধ করিনি। সূর্যসেন-প্রীতিলতা কি ভাতার জন্য জীবন দিয়েছিলেন? শহীদ আসাদ-নূর হোসেন কী মিছিলে যাওয়ার আগে ভাতার কথা ভেবেছিলেন? ৩০ লাখ মানুষ কী শহীদ হয়েছিল, ভাতা পাওয়ার আশায়? এখন মুক্তিযোদ্ধাদের প্রমাণ করতে হচ্ছে, তারা মুক্তিযোদ্ধা। আপনি কি পৃথিবীর কোথাও শুনেছেন, মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছর পরে মুক্তিযোদ্ধাদের নতুন তালিকা হচ্ছে।

আমি জিজ্ঞাসা করলাম, আপনার মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট নেই? আরো ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন, ‘সার্টিফিকেট পাওয়ার জন্য মুক্তিযুদ্ধে যাইনি।’ বলে উঠে হন হন করে হেঁটে চলে গেলেন। আমি দেখলাম, তিনি নিমিষে মিশে যাচ্ছেন ভিড়ের মধ্যে, অজস্র মানুষের মধ্যে। তিনিও একজন আওয়ামী লীগার। এরাই হয়তো ঐতিহ্যবাহী এই দলটির প্রকৃত প্রাণশক্তি। যারা হৃদয়ে এখনো ধারণ করে আছেন বঙ্গবন্ধু ও তার রাজনীতিকে। চায়ের কাপে শেষ চুমুকটা দিতেই মনে হলো, মাথাব্যথাটা আস্তে আস্তে সেরে যাচ্ছে।