এবারও চামড়ার দরে বিপর্যয়
পোস্ট করেছেন: Dinersheshey | প্রকাশিত হয়েছে: আগস্ট ৩, ২০২০ , ৬:৪৪ পূর্বাহ্ণ | বিভাগ: অর্থ ও বাণিজ্য
দিনের শেষে প্রতিবেদক : গত বছর ঈদুল আজাহার মতো এবারও কোরবনির পশুর চামড়ার দর বিপর্যয় হয়েছে। ঢাকায় প্রতিটি গরুর চামড়া সর্বনিম্ন ১০০ থেকে সর্বোচ্চ ৬০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। আর ছাগলের চামড়ার অনেকে ফ্রি দিয়েছেন। আর দু’চারজন দাম দিলেও তা এক বর্গফুটের নির্ধারিত দামে পুরো চামড়া কিনেছেন।
যদিও এই দর বিপর্যয় ঠেকাতে ঈদুল আজহার আগে চামড়া ব্যবসায়ীদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেছে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থা। এমনকি অর্থের ঘাটতি মেটাতে বিশেষ ঋণ সুবিধাও অব্যহত রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এমনকি কেস টু কেস ভিত্তিতে কাঁচা ও ওয়েটব্লু চামড়া রপ্তানির সুযোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এর পরেও চামড়ার দর মেলেনি। এবার কোরবানির পশুর চামড়ার বাজার নিয়ে হতাশাজনক পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
দেশে করোনা মহামারি, বন্যার দুর্যোগ ও আন্তর্জাতিক বাজারে দর বিপর্যয় বিবেচনায় নিয়ে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করে দর নির্ধারণ করে সরকার। এবার গত বছরের চেয়েও প্রায় ২৩ থেকে ৩০ শতাংশ কমিয়ে দর নির্ধারণ করা হয়। নির্ধারিত এই দর এবার গত দশ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন ছিল। এরপরেও নির্ধারিত দরের অর্ধেকে ও কয়েকভাগ কমে চামড়া বেচাকেনা হয়েছে।
ঢাকার নির্ধারিত দর প্রতিবর্গফুট গরুর লবণযুক্ত চামড়া ৩৫ থেকে ৪০ টাকা। একটি ২০ বর্গফুট গরুর চামড়া নির্ধারিত দর ৩৫ টাকা বর্গফুট ধরে লবণযুক্ত চামড়ার দাম পরে ৭০০ টাকা। এবার প্রতিবস্তা ৫০ কেজি লবণের দাম ৮০০ টাকা গেছে। এমন আকারের একটি চামড়ায় ৭ কেজি লবণ ব্যবহার করলে ১১২ টাকা, শ্রমিকের মজুরি ১০ টাকা, আড়ত কমিশন ৮ টাকা ধরা হলেও মোট ব্যয় হবে ১৩০ টাকা। এই ব্যয় করে প্রতিটি চামড়ায় ৭০ টাকা মুনাফা করলেও ৫০০ টাকায় কেনার কথা। অথচ শনিবার ব্যবসায়ীরা এই চামড়া ১০০ থেকে ২০০ টাকায় কিনেছেন।
পোস্তার আবদুল মাজেদ আড়তে চামড়া কিনেছেন ব্যবসায়ী তাজউদ্দীন। তিনি বলেন, বোল্ডার (সবচেয়ে বড়) চামড়া কিনেছেন ৬০০ টাকায়। এর চামড়া আকারে গড়ে ৪০ বর্গফুট হবে। মাঝারি চামড়া ৩০ বর্গফুট ৪০০ থেকে ৫০০ টাকায় কিনেছেন। আর ১৮ থেকে ২০ বর্গফুট আকারের ছোট চামড়া ১০০ থেকে দেড়শ টাকায় কিনেছেন। এই আড়তের সামনের সড়কে বসে অনেকেই তখন চামড়া কিনছিলেন। খানিকটা দাঁড়িয়ে দেখা গেল আড়াইশ থেকে ৩০০ টাকায় চামড়া কেনাবেচা চলছে। দেখতে বেশ বড় মনে হওয়ায় এটাই সবচেয়ে বড় সাইজ কিনা ক্রেতাদের কাছে জানতে চাইলে তারা বলেন, এটা মাঝারি মানের চামড়া আকারে ২৫ থেকে ৩০ বর্গফুট হবে।
এবার দাম এত কম কেন? জানতে চাইলে ক্রেতারা জানান, ট্যানারিগুলো টাকা দেয়নি। কিভাবে চামড়া কিনবে আড়তদাররা? ট্যানারি টাকা না দিলে কোন বছরই কেনাবেচা জমে ওঠে না। গত দুই বছর ধরে ট্যানারি টাকা দেওয়ায় এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে জানান তারা।
ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মো. শহীদুল ইসলাম মোহাম্মদ পুর থেকে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা করে ১২টি চামড়া কেনেন। তার চামড়ার মধ্যে ছোট চামড়া ২টি আর সবগুলোই বড় চামড়া। চামড়া নিয়ে বিক্রির জন্য পান্থপথে কেনার অপেক্ষায় থাকা একটি ট্যানরির প্রতিনিধি দরদাম শুরু করেন। শেষ পর্যন্ত সেখানে গড়ে ৩০০ টাকা প্রতিটিচামড়ার দাম বলছেন বলে জানান তিনি। তার গাড়ির সঙ্গে ছুটতেই সামনে এগিয়ে চামড়ার অনেক স্তুপ দেখা যায়। দাম আরও কম। ছোট চামড়া ১০০ টাকা বড় চামড়া ৫০০ টাকা। হতাশ হয়ে শহীদুল ইসলামের চামড়ার ভ্যান সামনে যতই এগিয়ে যাচ্ছে ততই তার কষ্ট বাড়ছে।
শেষ পর্যন্ত দেখা হয় পোস্তার আড়তে গিয়ে, দাম জানতে চাইলে তিনি বলেন, নির্ধারিতদাম দূরের কথা কেনাদামেও বিক্রি করতে পরেননি। উল্টো লোকশান দিতে হয়েছে। এভাবে চামড়ায় লোকসান হওয়ায় এবার হাতেগোনা অল্পসংখ্যক ব্যবসায়ী চামড়া কিনেছেন। বেশিরভাগ চামড়া মাদ্রাসাগুলো নিয়েছে। তারা যে দাম পেয়েছে তা খুবই কম। ঢাকার চামড়ার গত বছরের মতো একই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
চামড়ার দামে এই চিত্র রাজধানীর জুরেই ছিল। শনিবার সন্ধ্যায় পোস্তার আড়তে সারিসারি চামড়াবোঝাই ট্রাক ঢুকতে দেখা গেছে। ট্রাকে থাকা শ্রমিকদের কাছে কতদামে কেনা হয়েছে জানতে চাইলে তারা বলেন, ১০০ থেকে ৬০০ টাকার মধ্যে এ চামড়া কেনা হয়েছে। গত বছরও এমন দর ছিল। তবে এর আগের বছরে ভাল চামড়া দেড় হাজার টাকা পর্যন্ত দরে তারা কিনেছেন।
এ বিষয়ে কাঁচা চামড়া আড়তদারদের সংগঠন বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশেনের সাধারণ সম্পাদক টিপু সুলতান বলেন, মুলধন লুণ্ঠন হলে কিছুই করার থাকে না। বকেয়া পাওনার ক্ষেত্রে সক্রিয় ট্র্যানারিগুলোর মধ্যে মাত্র ৪টি ট্যানারি সাম্পূর্ণ টাকা দিয়েছে। আর ৫ শতাংশ থেকে ৩০ শতাংশ টাকা দিয়েছে ১৫টি ট্যানারি। বাকি ট্যানারিগুলো কোন টাকা দেয়নি। ট্যানারি মালিকরা টাকা না দেওয়ায় এবারও একই অবস্থা হয়েছে। শুধু ট্যানরি নয়। ব্যাংকগুলো ৬৮০ কোটি টাকা দেওয়ার কথা বলছে। অথচ বাস্তবে নগদ ১৮০ কোটি টাকা পেয়েছে ট্যানারিগুলো। এর ফলে চামড়া কেনাবেচায় বিপর্যয়ে পুনাবৃত্তি হয়েছে।
বাংলাদেশ ফিনিসড লেদার, লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোটার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ মাহিন সমকালকে বলেন, ট্যানারি মালিকরা লবণযুক্ত চামড়া নির্ধারিত দরেই কিনবেন। যারা নির্ধারিত দরের চয়ে অনেক দাম কমিয়ে কিনেছেন। তাদের বিরুদ্ধে তদারকিতে থাকা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। প্রতিবছর ট্যানারি মালিকদের দোষারোপ করার খেলা চলছে। এটা হতে পারে না। মধ্যস্বত্বভোগিরা (আড়তদার) অতিমুনাফা করতেই চামড়ার দাম কমিয়ে কিনছেন।
বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহীন আহমেদ বলেন, নির্ধারিত দরের চেয়ে কম দামে বেচাকেনার দায় আমাদের নয়। আমরা সবাইকে লবণ দিয়ে সংরক্ষণ করতে বলেছি। লবণ দিয়ে সংরক্ষণ করলে নির্ধারিত দামে ট্যানারিগুলো চামড়া কিনবে।