আজকের দিন তারিখ ২১শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, বৃহস্পতিবার, ৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সর্বশেষ সংবাদ
সম্পাদকীয় করোনার উৎস নিয়ে বিতর্ক ও ষড়যন্ত্র তত্ত্ব

করোনার উৎস নিয়ে বিতর্ক ও ষড়যন্ত্র তত্ত্ব


পোস্ট করেছেন: dinersheshey | প্রকাশিত হয়েছে: এপ্রিল ২০, ২০২০ , ৭:৪১ পূর্বাহ্ণ | বিভাগ: সম্পাদকীয়


শ্যামল দত্ত,সম্পাদক : উনিশ শতকের গোড়ায় (১৯১৪-১৯১৮) অনুষ্ঠিত প্রথম বিশ্বযুদ্ধ বিশ্ববাসী দেখল অস্ত্র হিসেবে বিধ্বংসী ট্যাংকের আগমন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে ১৯৪৫ সালে দেখল পারমাণবিক বোমার ব্যবহার এবং জাপানে এর নৃশংসতম ধ্বংসলীলা। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কা যারা করছেন তারা এখন দেখছেন জীবাণু অস্ত্রের ব্যবহার শুরু হয়ে গেছে।
পৃথিবীতে এখনো সেই যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে কিনা এই মীমাংসায় আসার সময় হয়তো হয়নি, কিন্তু আকারে অতি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র একটি ভাইরাসের সঙ্গে যে যুদ্ধ এখন পৃথিবী করছে, সেটা হচ্ছে বাস্তবতা এবং সেই যুদ্ধ পুরো স্তব্ধ করে দিয়েছে সমগ্র মানব জাতিকে। পৃথিবীর প্রায় অধিকাংশ দেশই এখন লড়াই করছে ভাইরাসের বিরুদ্ধে। অন্যদিকে এই যুদ্ধের সৃষ্টি নিয়ে শুরু হয়ে গেছে নানা বিতর্ক। কেউ একে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব হলে উড়িয়ে দিতে পারেন কিন্তু কিছু কিছু প্রশ্ন বরাবরই থেকে যাচ্ছে উত্তরহীন। কিছু ঘটনা মেলানো যাচ্ছে না অন্যকিছুর সঙ্গে। কিছু চিন্তার কোনো মীমাংসা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, যার জন্য ষড়যন্ত্রের গন্ধ খুঁজনেওয়ালারা প্রশ্নগুলো করে যাচ্ছেন বারবারই।
প্রথম প্রশ্ন, যেটা গোড়া থেকেই ঘুরপাক খাচ্ছে বিভিন্ন চিন্তাশীল মহলে, সেটা হলো কোথা থেকে এলো এই করোনা ভাইরাস বা কোভিড-১৯। চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরের বন্য পশুপাখি বাজার থেকে এর সৃষ্টি এমন বক্তব্য এসেছে চীনের পক্ষ থেকে। কিন্তু উহানে যে ব্যক্তি প্রথম আক্রান্ত, তিনি এই বাজারের ধারেকাছে যাননি। ফলে এর কোনো যৌক্তিক ব্যাখ্যা নেই। যেটা আছে সেটা হলো, এই বাজার থেকে কিছুটা দূরে আছে ‘চায়না সেন্টার ফর ভাইরাস কালচার কালেকশন’ এবং তাদের ওয়েবসাইটে আছে যে, তারা এই ল্যাবে প্রায় ১৫০০০ ভাইরাস সংগ্রহে রেখেছেন। উহানেই এই ল্যাবরেটরি তৈরি হয়েছিল ২০১৫ সালে প্রায় ৩০০ মিলিয়ন ইয়ান (৪২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) খরচ করে এবং ফরাসি একটি বায়ো ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফার্মের সহযোগিতায়। এলিন মারিও ছিলেন এর ফরাসি কনসালট্যান্ট এবং উহানের নিভৃত এলাকায় এখানে ৩ হাজার বর্গমিটারের একটি পি ৪ ল্যাবরেটরি আছে।
এএফপির এক সাম্প্রতিক রিপোর্টে বলা হচ্ছে, বাইরে থেকে এর ভেতরের কোনো কর্মকাণ্ড চলছে বলে বোঝা যায় না। ল্যাবরেটরির গেটে সাঁটানো একটি পোস্টারে লেখা আছে ‘দৃঢ় প্রতিরোধ এবং নিয়ন্ত্রণ, ভয় পাওয়ার কিছু নেই, সরকারি বক্তব্যগুলো শুনুন, বিজ্ঞানে বিশ্বাস করুন এবং কোনো গুজব ছড়াবেন না।’
কিন্তু ওয়াশিংটন পোস্টের মতো একটি দায়িত্বশীল পত্রিকা ও ফক্স নিউজ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সূত্রকে উদ্ধৃত করে বলেছে, দুর্ঘটনাবশত এই সেন্টার থেকেই ভাইরাস ছড়িয়েছে। ওয়াশিংটন পোস্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক‚টনৈতিক তারবার্তায় উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছে, অপর্যাপ্ত নিরাপত্তা ও ব্যবহারিক স্ট্যান্ডার্ড গবেষকরা মেনে চলেননি বলেই এই ভাইরাস উহানবাসীর মধ্যে ছড়িয়েছে। ফক্স নিউজ বলেছে, বাদুড় থেকে ছড়ানো সার্চ ভাইরাসের গবেষণা করতে গিয়ে এই ভাইরাস মহামারি আকারে বাইরে ছড়িয়ে গেছে। সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প উসকে দিয়েছেন এই চিন্তাকে। সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, এ ধরনের খবর আমরা বারবার শুনছি। যুক্তরাষ্ট্র এর পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত করবে।
উহানের এই গবেষণাগার থেকে অবশ্য এসব অভিযোগের কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। তবে চীন সরকারের দেয়া বক্তব্যে শুধু এটুকু জানা যায়, গত ৩০ ডিসেম্বর তারা একটি অজানা ভাইরাসের সন্ধান পায়। এর ভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্স তারা চিহ্নিত করতে পারে ২ জানুয়ারি এবং এর প্যাথোজেন বা রোগজন্ম দেয়ার শক্তি সম্পর্কে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানায় ১১ জানুয়ারি। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ঝাউ লিজিয়ান গত ১৭ এপ্রিল শুক্রবার এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বলেন, উহানের ল্যাবরেটরি থেকে ভাইরাস ছড়ানোর খবরটি সঠিক নয়। তিনি অভিযোগ করেন, জনগণের দৃষ্টি অন্যত্র সরানো ও দায়িত্ব এড়ানোর লক্ষ্যে এগুলো করা হয়ে থাকে। তবে খুবই মজার বিষয় হচ্ছে, চীনের এই মুখপাত্র নিজেই কিছুদিন আগে আরেক ষড়যন্ত্র তত্ত¡ প্রচার করেছিলেন এই বলে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী এই ভাইরাস চীনে নিয়েছে। কারণ একটি সামরিক প্রশিক্ষণে মার্কিন বাহিনীর একটি দল উহানে গিয়েছিল এবং তারা এ ভাইরাস ছড়াতে পারে।

চীন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই ষড়যন্ত্র তত্ত্বের বিনিময় শুরু হয়েছে গত মার্চ মাস থেকে চীনের বহু গবেষক টুইটারের মতো তাদের দেশে যে ‘উইবো’ ব্যবহার করে, সেখানে উল্লেখ করেছে এই ভাইরাস এসেছে মূলত যুক্তরাষ্ট্র থেকে। চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ঝাউ লিজিয়ন এই ষড়যন্ত্র তত্ত্বের সঙ্গে নাইন ইলেভেনের ঘটনার ষড়যন্ত্র তত্ত্বের কিছু উদ্ধৃতি ও বক্তব্য সংযুক্ত করে দিয়ে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই প্রকৃত সত্যে না গিয়ে ষড়যন্ত্রের ওপর ভিত্তি করে থাকে। অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ডালি ইয়াং বলেছেন, ঝাউ লিজিয়ান সম্ভবত তার সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরতেই ষড়যন্ত্রের বক্তব্য সংযোজন করেছেন। ঝাউ তার এক টুইটার বার্তায় উল্টো এক প্রশ্ন তুলে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র কেন গত জুলাই মাসে মেরিল্যান্ডের ডেট্রিক আমেরিকান বায়োকেমিক্যাল রিসার্চ সেন্টার আকস্মিকভাবে বন্ধ করে দিল এবং এটি বন্ধ করার পরপরই যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন জায়গায় নিউমোনিয়া অথবা একই ধরনের রোগ ছড়িয়ে পড়ল? যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে এই প্রশ্ন বারবার উত্থাপনের পর পাল্টা প্রশ্ন ছুড়েছে প্যারিসের চীনা দূতাবাস। দূতাবাসের এক মুখপাত্র গত ২৩ মার্চ বলেছে, সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রে যে ২০ হাজারের বেশি মানুষ বিভিন্ন জ্বরে মারা গিয়েছিল, তার মধ্যে কতজন কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত ছিলেন?
চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের এই পারস্পরিক ষড়যন্ত্র তত্ত্বের বিনিময়ে নতুন কিছু বৈশ্বিক বাস্তবতার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে, যা আগে অনেকের অজানা ছিল। উহানের সামুদ্রিক পণ্যের বাজারে বাদুড় এবং প্যাঙ্গোলিনকে (যা বাংলাদেশে বনরুই হিসেবে পরিচিত) প্রথমে করোনা ভাইরাস সৃষ্টির ভিলেন হিসেবে পরিচিত করানো হলেও পরে নানা তথ্য বেরিয়ে আসছে, যা বিশ্বকে ভাবাচ্ছে নতুন করে।
ভারতের প্রখ্যাত চীন গবেষক লেফটেন্যান্ট জেনারেল প্রকাশ কাটোচ (অব.) লিখেছেন, চীনের কাছ থেকে প্রকৃত সত্য জানা হয়তো কখনোই সম্ভব হবে না। বিশ্বজুড়ে প্রভাব বলয় তৈরি করার জন্য চীনের কৌশল হচ্ছে একটি ‘ডিপ কোয়ালিশন’ তৈরি করা, যেখানে রাষ্ট্রের বাইরে নানা ধরনের প্রতিষ্ঠান-ব্যক্তি সংযুক্ত থাকে। ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি থেকে ড্রাগ মাফিয়া পর্যন্ত সবাই এই প্রক্রিয়ার অংশ হয়ে যায়। সম্প্রতি চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ উদ্যোগ নিয়ে তিনি এর একটি শক্তিশালী প্রয়োগ দেখিয়েছেন এবং ব্যক্তি, গোষ্ঠী, করপোরেশন ও নাগরিক সংগঠনকে এর সঙ্গে যুক্ত করে প্রভাব বলয় বানিয়ে বিশ্বে তার বিস্তৃতি বাড়িয়েছেন আশঙ্কাজনকভাবে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন, বিশেষ করে ইউএনডিপি, ইউএনএইচসিআর ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ বিভিন্ন সংগঠনকে কিনে নিয়েছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। যে কারণে মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের ওপর অমানবিক নির্যাতন করে তাড়িয়ে দেয়ার পরও ইউএনএইচসিআরের জোরালো ভ‚মিকা না রাখার কারণে তাদের নিজ দেশে ফেরাতে কোনো কার্যকর উদ্যোগ কেউ নিতে পারেনি। ইউএনডিপির বিরুদ্ধেও একই ধরনের অভিযোগ আছে। মিয়ানমারে দায়িত্ব পালনরত ইউএনডিপির আবাসিক প্রতিনিধির বিতর্কিত ভূমিকা পালন করেছে এই ইস্যুতে এবং আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বিভিন্ন খবর প্রকাশিত হয়েছে। অন্যদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা চীনকেন্দ্রিক হয়ে গেছে বলে অভিযোগ তুলে অর্থায়ন বন্ধ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিরুদ্ধে তথ্য গোপন এবং যথাযথ পদক্ষেপ না নেয়ার সরাসরি অভিযোগ তুলেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। যুক্তরাষ্ট্র সিনেটের সাতজন রিপাবলিকান সিনেটর গত ১৪ এপ্রিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাসচিবের কাছে লেখা এক চিঠিতে ৬টি সুনির্দিষ্ট প্রশ্নের জবাব চেয়েছে এবং কোভিড-১৯ সংক্রান্ত সব আন্তর্জাতিক যোগাযোগ সিনেটের শুনানিতে জমা দেয়ার আহবান জানিয়েছে। সিনেটর রিক স্কট, সিনেটর রন জনসন, সিনেটর টড ইয়ং, সিনেটর কেবিন ক্রেমার, সিনেটর স্টিফেন্স উইংস, সিনেটর জনি আর্নেস্ট, সিনেটর মারতা ম্যাকখেলি স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে সুনির্দিষ্ট প্রশ্নগুলোর জবাব চেয়ে পাঠানো হয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কাছে। তারা উল্লেখ করেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের করের টাকায় দিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে অর্থায়ন করা হয়। মার্কিন জনগণের জানার অধিকার আছে কীভাবে টাকা ব্যয় হয়।

পারস্পরিক এই ষড়যন্ত্রের অভিযোগের প্রশ্ন যখন উঠছে, তখন ষড়যন্ত্রটাই বা কী এবং এর বিস্তৃতিটাই বা কতটুকু? এই প্রশ্নে কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপাদান সংযোজন করে, যখন উহানে মৃত্যুর সংখ্যা হঠাৎ করে দ্বিগুণ হয়ে যায়। গত ১৭ এপ্রিল চীন আকস্মিকভাবে ঘোষণা করে উহানে মৃতের সংখ্যা দ্বিগুণ হবে। আগে বলা হয়েছিল এই শহরে মারা গিয়েছিল ১২৯০ জন। কিন্তু শুক্রবার বলা হয়, মৃতের সংখ্যা হবে ৩৮৬৯ জন। মৃত্যুর কথা আগে কেন জানানো হয়নি তার ব্যাখ্যা দিয়ে নগর প্রশাসন বলেছে প্রথমদিকে আক্রান্তের সংখ্যা এত বেড়ে গিয়েছিল যে, স্বাস্থ্যকর্মীরা ঠিক হিসাব রাখতে পারেনি।
কয়েকদিন আগে ওয়াশিংটন পোস্টের খবরে আরো বলা হয়, গত দুই সপ্তাহ ধরে লম্বা লাইন পড়েছে উহানের সরকারি দপ্তরে। সবাই এসেছেন প্রিয়জনের দেহ ভস্মের ছাই সংগ্রহ করতে। সারাদিন দাঁড়িয়ে থেকেও ছাই পাননি। শুধু তাই নয়, এখনো পর্যন্ত দফায় দফায় লাশ গণকবর দেয়া হচ্ছে। উহানের এক অধিবাসী রেডিও ফ্রি এশিয়াকে বলেছেন, আক্রান্ত হওয়ার পর থেকে প্রতিদিন কমপক্ষে ৫শ শব দাহ করা হয়েছে। উহানের ৮৪টি লাশ পোড়ানোর চুল্লিতে ২৪ ঘণ্টা লাশ পোড়ানো হয়েছে। তাদের মতে, লকডাউনের আগে ও পরে ৪০ হাজারের বেশি উহানবাসী মৃত্যুবরণ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য চীনের দেয়া মৃতের সংখ্যা বিশ্বাস করছে না এবং প্রকাশ্যে প্রশ্ন তুলছে মৃতের সংখ্যা অফিসিয়াল সংখ্যা থেকে তা অন্তত কমপক্ষে ৪০ গুণ বেশি হবে।
লেফটেন্যান্ট জেনারেল প্রকাশ কাটোচ (অব.) সাউথ এশিয়া মনিটরে চীনের বায়োলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার নামের এক প্রবন্ধে লিখেছেন, চীন এ ধরনের মৃত্যুকে ‘কোলেটারেল ড্যামেজ’ হিসেবে মেনে নেয়। এর আগে ‘গ্রেট লিপ ফরওয়ার্ড’ নামক যে কৃষিভিত্তিক পুনর্গঠন শুরু করা হয়েছিল পঞ্চাশের দশকে, তাতে প্রায় ২৫ লাখ চীনা নাগরিকের মৃত্যু ঘটেছিল। এমনকি মাও সেতুংয়ের সাংস্কৃতিক বিপ্লবে ১৫ লাখ চীনা নাগরিক জীবন হারিয়েছিল। চীনের কাছে এগুলো কোনো বিষয় নয়। তাদের প্রধান লক্ষ্য, যে উদ্দেশ্য নিয়ে তারা কাজ করছে সেটি অর্জন করা। উহান যখন ভাইরাসের সঙ্গে যুদ্ধ করছে, তখন চীন সরকার বিতর্কিত দক্ষিণ চীন সাগরে গত ২১ মার্চ ফিয়ারি প্রবাল দ্বীপে নতুন ২টি ভাইরাস গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন করেছে। ফিলিপাইন ও ভিয়েতনামের দাবিকৃত এই বিতর্কিত প্রবাল দ্বীপে এর আগেও চীন একটি গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন করেছিল, যা নিয়ে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে ২০১৬ সালের জুলাই মাস থেকে একটি মামলা বিচারাধীন আছে।
এক সময় চীন বায়োলজিক্যাল যুদ্ধের ভিকটিম ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপর কোরিয়া যুদ্ধে চীন ও উত্তর কোরিয়ায়ই এ ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করেছিল যুক্তরাষ্ট্রে। এর বিরুদ্ধে বিশ্বজনমত গড়তে ১৯৫২ সালের অক্টোবর মাসে কমিউনিস্ট দেশ ও চীনের বন্ধুভাবাপন্ন কিছু দেশের প্রতিনিধিদের নিয়ে ১২ দিনব্যাপী বিশ্বশান্তি সম্মেলন করেছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের শান্তি পরিষদের প্রতিনিধি হিসেবে এই সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর লেখা ‘আমার দেখা নয়াচীন’ বইতে এই জীবাণুযুদ্ধের নানা ভয়াবহতার কথা উল্লেখ আছে।
চীন সেই সময় থেকেই গোপনে এ ধরনের একটি বৈশ্বিক যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে গবেষকরা মনে করেন। আগামীতে পৃথিবীর যুদ্ধ যে এর ওপর ভিত্তি করে হবে তার প্রস্তুতি হিসেবে নিজেকে প্রস্তুতি করছিল চীন। চীন-উত্তর কোরিয়ার যৌথ প্রয়াসে আরো নানা প্রকল্প আছে বলে অনেকের ধারণা।
অনেক বিশেষজ্ঞই দীর্ঘদিন থেকে বলে আসছেন, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হবে কোনো অস্ত্রের যুদ্ধ নয়, এই যুদ্ধ হবে বায়োলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার। চিন্তাশীল মানুষরা পৃথিবীতে বহু আগে থেকে সতর্ক করে আসছিলেন। বিল গেটস ‘টেড টক’ অনুষ্ঠানে ২০১৫ সালে বলেছেন, আগামীতে পৃথিবীর জন্য অস্ত্র কোনো ভয়ের বিষয় নয়, সংকট হবে ভাইরাসের সঙ্গে যুদ্ধ করা। তিনি বলেছিলেন পৃথিবীর সবচেয়ে দামি বস্তু হবে অস্ত্র নয়, খাদ্য, পানি, ওষুধ সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনীয় জিনিস হয়ে দাঁড়াবে। কিন্তু বিশ্ব নেতৃত্ব সে কথা শুনেননি বলেই সাধারণ মানুষকে আজ জীবন দিতে হচ্ছে খাদ্য, পানি আর ওষুধের অভাবেই।