করোনা ঝুঁকির মধ্যেই চলছে অনেক গার্মেন্টস
পোস্ট করেছেন: dinersheshey | প্রকাশিত হয়েছে: এপ্রিল ১০, ২০২০ , ১১:১৬ পূর্বাহ্ণ | বিভাগ: /////হাইলাইটস/////
দিনের শেষে প্রতিবেদক : গাজীপুরে এখনও খোলা অনেক গার্মেন্ট কারখানা করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে আগামী ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত পোশাক কারখানাগুলোতে ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। তবে ছুটি ঘোষণার বাধ্যবাধকতা না থাকায় করোনা সংক্রমণের ঝুঁকির মধ্যেই বিভিন্ন এলাকায় কারখানা খোলা রাখার খবর পাওয়া গেছে। ছুটি না দিয়ে আগে থেকেই গাজীপুরে প্রায় তিনশ’ কারখানা তাদের উৎপাদন কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। এসব কারখানায় কয়েক লাখ শ্রমিক কাজ করছেন। করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধের সব নিয়মও মেনে চলা হচ্ছে না। ঢাকার সাভারেও বেশকিছু কারখানায় কাজ চলছে। প্রথম দফার ঘোষণা অনুযায়ী ১০ দিন ছুটি কাটিয়ে গত রবিবার (৫ এপ্রিল) কাজে যোগ দিতে লাখ লাখ শ্রমিক দূর দূরান্ত হতে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে গাজীপুরে আসেন। কিন্তু দ্বিতীয় দফায় এক সপ্তাহ ছুটি বৃদ্ধি করায় ওইসব শ্রমিকের অধিকাংশই আবারও গ্রামের বাড়িতে ফিরে যাচ্ছেন। গত কয়েকদিন ধরেই রাস্তায় বিভিন্ন স্থানে তাদের জড়ো হয়ে অপেক্ষা করতে দেখা গেছে। গাদাগাদি করে বিভিন্ন যানবাহনেও চড়ছেন তারা। এত বিপুল সংখ্যক লোক সমাগম ও তাদের চলাচল এবং আসা-যাওয়ার কারণে করোনা সংক্রমণের আতঙ্ক দেখা দিয়েছে গাজীপুরবাসীর মধ্যে। গাজীপুর শিল্প পুলিশের ইন্টিলিজেন্স শাখার ইনচার্জ ইন্সপেক্টর ইসলাম হোসেন জানান, করোনা ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী গাজীপুরের বিভিন্ন কারখানা ছুটি ঘোষণা করে বন্ধ রাখা হয়। তবে এ পর্যন্ত জেলার নলজানী এলাকার (জিএমপি হেডকোয়ার্টারের সামনে) কোজিমা গার্মেন্টস, দক্ষিণ সালনার মোল্লাপাড়া এলাকার টিএমএস ফ্যাশন, ডেগেরচালা এলাকার এমাজিন ফ্যাশন, শ্রীপুরের বহেরারচালা এলাকার নান্তাবুর গ্রুপের তাকওয়া গার্মেন্টস, বড়বাড়ি এলাকার পাক স্টার বাংলাদেশ লিমিটেডসহ ২৭৭টি কারখানার উৎপাদন অব্যাহত রয়েছে। কর্তৃপক্ষ নিজ দায়িত্বে তাদের এসব কারখানা খোলা রেখেছেন। শ্রীপুর উপজেলার মাওনা ইউনিয়নের পাথার পাড় এলাকার ‘ক্রাউন এক্সক্লুসিভ ওয়ার্স লিমিটেড’ (সোয়েটার কারখানা) শ্রমিকদের কোনও রকম স্বাস্থ্য নিরাপত্তা ছাড়াই জোর করে তাদের কাজে যোগদান করাচ্ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কারখানার নিটিং জ্যাকার্ড অপারেটর, মেন্ডিং অপারেটর, সুইং অপারেটর ও ক্লিনারসহ অন্যরা জানান, করোনা আতঙ্কের মধ্যেও কর্তৃপক্ষ কারখানা খোলা রেখে শ্রমিকদের জোর করে কাজ করাচ্ছে। তাদের অভিযোগ, নামমাত্র হাত ধোয়ার ব্যবস্থা করে শ্রমিকদের কোনও ধরনের নিরাপত্তা ছাড়াই কর্তৃপক্ষ কারখানাটি চালু রেখেছেন। তারা আরও বলেন, করোনার বিষয়ে আরও অধিকতর সতর্কতার কথা বললে কর্তৃপক্ষ চাকরিচ্যুত করে দেয়। চাকরিচ্যুতির ভয়ে শ্রমিকেরা বাধ্য হয়ে ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন। কারখানার মহাব্যবস্থাপক (অপারেশন) আবুল কালাম আজাদ বলেন, আমরা করোনাভাইরাসের সরকারি নির্দেশনার শতভাগ নিয়ম মেনে কারখানা চালু রেখেছি। শ্রমিকদের অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, কিছু শ্রমিক কারখানার ভালো চায় না। তাই তারা কারখানার নামে বদনাম রটাচ্ছে। শিপমেন্টর অর্ডার থাকায় আমরা শ্রমিকদের শতভাগ স্বাস্থ্য নিরাপত্তা দিয়েই কাজ করাচ্ছি। শ্রীপুরের ধনুয়া এলাকার রিদিশা নিট কারখানার শ্রমিক সাইদুল ইসলাম বলেন, স্থানীয় একটি মেসে থেকে কারখানায় কাজ করি। কিন্তু কারখানা বন্ধ দেওয়ার পর রান্না করার বুয়াও চলে যায়। এতে থাকা-খাওয়ার কষ্টের কারণে গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ এলাকায় যাওয়ার জন্য রাস্তায় বের হই। শ্রীপুরের নয়নপুর থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার উত্তরে জৈনা বাজার পর্যন্ত হেঁটে গিয়েও কোনও গাড়ি পাইনি। তাই চিন্তা করছি থেমে থেমে হেঁটেই গন্তব্যে যাবো। গাজীপুর মেট্রোপলিটন জিএমপি’র ট্রাফিক পুলিশের (দক্ষিণ) সহকারী কমিশনার পীযূষ কুমার দে জানান, গাজীপুরের সড়ক-মহাসড়কে পণ্যবাহী কাভার্ডভ্যান, ট্রাক, অ্যাম্বুলেন্স ও চিকিৎসকের গাড়ি ও দুয়েকটি অটোরিকশা ছাড়া যাত্রীবাহী কোনও যানবাহন চলছে না। চলতে গেলে তা আটকে দেওয়া হচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে। তারপরও কিছু মানুষ ঘর ছেড়ে পথে চলছে। আসলে করোনা সংক্রমণের জন্য মানুষের মাঝে যতটুকু সচেতনতা থাকা দরকার তা নেই। এখনও এক শ্রেণির মানুষ ও যানবাহনশূন্য মহাসড়ক খালি পেয়ে ঘুরতে বেরোয়। আবার অনেকে পিকআপে চড়ে দূর-দূরান্তে যাওয়ার চেষ্টা করে। সকালে এরকম কিছু যানবাহনের চালককে সতর্ক ও সচেতন করা হয়েছে এবং কয়েকটির বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। গাজীপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (এডিশনাল এসপি) রাসেল শেখ জানান, পুরো গাজীপুরে বাইরের কোনও যানবাহন চলাচল করতে দেওয়া হচ্ছে না। এজন্য গাজীপুরের রাজেন্দ্রপুর, শ্রীপুরের জৈনা বাজার, কালিয়াকৈরের চন্দ্রা (স্কয়ার কারখানার সামনে) এবং কালীগঞ্জের উলুখোলা এলাকায় চেকপোস্ট বসানো হয়েছে যাতে জরুরি সেবার গাড়ি ছাড়া অন্য কোনও গাড়ি গাজীপুরে ঢুকতে এবং বাইরে যেতে না পারে। তবে কোনও জরুরি কাজে কেউ যদি নিজস্ব গাড়িতে তাদের গ্রামের বাড়ি যেতে চান, সেক্ষেত্রে কিছুটা শৈথিল্য দেখানো হচ্ছে। তবে দুই শ্রেণির মানুষকে রাস্তায় নামতে দেখা গেছে, তাদের মধ্যে একটি হলো অসচ্ছল মানুষ, যাদের টাকা বা খাবারের প্রয়োজনে রোজগারের জন্য বাইরে চলতে দেখা গেছে। অন্যরা হলো সম্পদশালী মানুষ, তারা নানা অজুহাতে গাড়ি নিয়ে বাইরে চলতে চেষ্টা করছেন। তিনি বলেন, গাজীপুর সদরের এক ব্যক্তিকে আটক করলে ওই ব্যক্তি পুলিশকে জানায়, পোশাক কারখানায় পিপিই, মাস্ক তৈরি করা হচ্ছে, সেখানে তাকে যেতে হবে। অপর এক যাত্রী প্রাইভেটকারে সপরিবারে বের হয়েছেন ডাক্তারের কাছে যাবেন বলে। পরে চিকিৎসাপত্র যাচাইকালে দেখা গেছে তাতে ফ্লুইড দিয়ে দুই বছর আগের তারিখ মুছে হাল সনের তারিখ লিখে নিয়ে রাস্তায় বের হয়েছে অন্য কাজে। গাজীপুর মহানগর পুলিশের কমিশনার আনোয়ার হোসেন জানান, মহানগরের ঢাকা-ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল মহাসড়কের টঙ্গীর স্টেশনরোড, গাজীপুরা, বোর্ডবাজার, চান্দনা-চৌরাস্তা, বিআরটিসি ক্রসিং, শিববাড়ি, রাজবাড়ি, কোনাবাড়ি ও রাজেন্দ্রপুর এলাকায় চেকপোস্ট বসিয়ে যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। শাখা সড়কে অটোরিকশা, সিএনজি চলার চেষ্টা করছে। তবে কাঁচাবাজার, জরুরি চিকিৎসা, ব্যাংক বা কারখানার কথা বলে নানা লোকজন চলাচল করছে। তবে আমাদের এসব ব্যাপারে আরও কড়াকড়ি আরোপ করতে হবে। জেলার কাঁচাবাজারসহ বিভিন্ন বাজারে জনসমাগম বেশি হচ্ছে। করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে কাঁচাবাজারও একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত খোলা রেখে মানুষ চলাচল নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। দুপুর ২টার পর কোনও দোকানপাট খোলা থাকবে না। আমাদের আরও সচেতন হতে হবে। করোনা পরিস্থিতিতে দেশের সব ইপিজেডে কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হলেও সাভার ও আশুলিয়ার একাধিক কারখানা চালু আছে। চাকরি বাঁচানোর তাগিদে শ্রমিকরা করোনার ঝুঁকি মাথায় নিয়ে সকাল থেকে কাজে যোগ দিয়ে উৎপাদন অব্যাহত রেখেছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আশুলিয়ার কলমা, নরসিংহপুর, জামগড়া, কাঠগড়া ও সাভার এলাকায় প্রায় ২০টিরও বেশি কারখানা সকাল থেকে তাদের উৎপাদন কার্যক্রম শুরু করে। এর মধ্যে হামিম গ্রুপের কারখানাটির শ্রমিকরা বেতনের দাবিতে কারখানার ভেতরে কর্মবিরতি শুরু করে। পরে মালিকপক্ষ বেতন দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে কারখানাটিতে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেন। এসব কারখানায় কাজে যোগ দেওয়া একাধিক শ্রমিক বলেন, করোনার ঝুঁকি মাথায় নিয়ে তারা সকাল থেকে কারখানায় কাজে যোগ দিয়েছেন। তারা অভিযোগ করে বলেন, করোনায় আতঙ্কিত হয়ে কাজে না গেলে চাকরি চলে যাবে। এ কারণে তারা বাধ্য হয়েই কারখানায় কাজে যাচ্ছেন। বাংলাদেশ বস্ত্র ও পোশাক শিল্প শ্রমিক লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সরোয়ার হোসেন বলেন, সরকার ইপিজেডের অধীনে থাকা সব কারখানা ১৪ তারিখ পর্যন্ত সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে। যেভাবে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে দ্রুত সব কারখানা বন্ধ ঘোষণা না করলে ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হতে পারে। তিনি শ্রমিকের সুরক্ষা ও জীবন অনিশ্চয়তার মধ্যে না ফেলে দ্রুত দেশের সব কারখানায় সাধারণ ছুটির দাবি জানান। অন্যদিকে আশুলিয়া শিল্প পুলিশ-১ এর পরিদর্শক মাহমুদুর রহমান বলেন, মাসের শেষে অনেক কারখানায় এখন বেতন দেওয়ার সময়। ১৪ তারিখ পর্যন্ত সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। এছাড়া যে কোনও অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে পুলিশ প্রস্তুত রয়েছে বলেও তিনি জানান।