আজকের দিন তারিখ ২২শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, রবিবার, ৭ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সর্বশেষ সংবাদ
সম্পাদকীয় করোনোর সংকটে ঘূর্ণিঝড় দুর্যোগ ও পরিবেশ বিপর্যয়

করোনোর সংকটে ঘূর্ণিঝড় দুর্যোগ ও পরিবেশ বিপর্যয়


পোস্ট করেছেন: dinersheshey | প্রকাশিত হয়েছে: মে ২৩, ২০২০ , ৪:০৭ পূর্বাহ্ণ | বিভাগ: সম্পাদকীয়


শ্যামল দত্ত, সম্পাদক : করোনার মধ্যেও নানা কাজে যাদের বের হতে হয়, তারা প্রত্যক্ষ করছে এক নতুন ঢাকাকে। সবুজে ভরা, বৃষ্টিভেজা তরতাজা, প্রাণময় এক ঢাকা। ইদানীং ঢাকার রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা কিছুটা বাড়লেও গণপরিবহনের অসহনীয় চাপটি না থাকায় ঢাকার বাতাস মনে হয় অনেকখানি পাতলা, সিসামুক্ত। শ্বাস নিতেই টের পাওয়া যায় এটা। এর মধ্যে লক্ লক্ করে বেড়ে উঠছে ফুটপাত আর আইল্যান্ডের গাছগুলো। ডালপালা মেলছে অবাধে। ফুল ফুটছে নির্বিঘ্নে। ফলে কালো ধোঁয়ায় আবৃত্ত এই শহরটির এই নতুন অপরিচিত চেহারাটি একেবারেই করোনার দান বললে বোধহয় ভুল হবে না।
রাজধানীর রমনা পার্ক বা সোহরাওয়ার্দী উদ্যান কিংবা মানিকমিয়া এভিনিউর আশপাশের রাস্তা গুলশান, বনানী, বারিধারার অভিজাত রাস্তার ফুটপাত বা রাস্তার পাশের গাছপালার ডাল এতই অবাধে বেড়ে উঠছে যে, তা এক নতুন প্রাকৃতিক পরিবেশ তৈরি করছে বললে ভুল হবে না। একদিকে লকডাউনের কারণে সীমিত যান চলাচল, অন্যদিকে বর্ষার আগেই আগাম মৌসুমি বৃষ্টিতে অবাধে বেড়ে উঠছে লতাগুল্ম, ফুলের নানা গাছ কিংবা অপরিকল্পিতভাবে লাগানো গাছের ডালগুলো। কাকরাইল থেকে হেয়ার রোড ধরে মিন্টো রোডের দিকে এগুলোই দেখা যায়, আইল্যান্ডে লাগানো গাছের দুপাশে বিস্তৃতি। অন্যদিকে বিজয় সরণি ধরে কিছুটা এগিয়ে সংসদ ভবন এবং ক্রিসেন্ট রোডের মধ্য দিয়ে এগুলে রাধাচ‚ড়া আর কৃষ্ণচ‚ড়ার সমাহার এই বর্ষা মৌসুমে চোখ জুড়াবেই। গুলশানের ৫০ নম্বর সড়কের উল্টো পাশে রাস্তার দুপাশে লাগানো গাছের ডাল নির্বিঘ্নে চলে এসেছে রাস্তার মাঝ বরাবর। কাটার কেউ নেই, তাই অবাধেই তাদের এই বৃদ্ধি ইট-পাথরের এই ঢাকা নগরে চোখে দিচ্ছে এক নতুন সবুজের ছোঁয়া; যার সঙ্গে এই নগরবাসীর পরিচয় ছিল না আগে।
বিশ্ব জুড়ে করোনা দুর্যোগে লকডাউন ও কলকারখানা বন্ধের কারণে বৈশ্বিক আবহাওয়ায় যে পরিবর্তন এনেছে, তা নিয়ে নানা গবেষণা ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে বিভিন্ন পরিবেশ গবেষক সংস্থাগুলোর মধ্যে। করোনাপরবর্তী বিশ্বে পরিবেশ ও জলবায়ুর ব্যাপারে বিশ্বের দৃষ্টিভঙ্গির নানা বিশ্লেষণ চলছে গণমাধ্যমে। গত ২১ মে আলজাজিরায় কোভিড-১৯ পরবর্তী বিশ্ব জলবায়ুর পরিবর্তনকে কীভাবে দেখবে, তা নিয়ে এক আলোচনায় আশাবাদ ও হতাশার দুটো দিকই উঠে এসেছে। চীনসহ যেসব শিল্প-কলকারখানাভিত্তিক দেশ পরিবেশের তোয়াক্কা না করে উৎপাদন প্রক্রিয়া চালায়, তারা নতুন উদ্যমে আবার কলকারখানা খুলতে শুরু করেছে। এমনকি লকডাউনের ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে নিতে উৎপাদনে বেপরোয়া নীতি অনুসরণের ইঙ্গিতও দিচ্ছে। অন্যদিকে ইউরোপসহ পশ্চিমা দেশগুলো করোনায় এই দানবিক বিপর্যয়ে পড়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বা শিল্প উৎপাদন আরো কীভাবে পরিবেশ সহনীয় করা যায়, তা নিয়ে আলাদা আলোচনা চালাচ্ছে। করোনার এই মহাদুর্যোগের মধ্যে বৈশ্বিক আবহাওয়ার দুটো ঘটনা আমাদের বলে দিচ্ছে পৃথিবীর ধ্বংস ঠেকাতে হলে আমাদের আরো অনেক কিছু করণীয় আছে।
প্রথমে পরিবেশের এই দুই ঘটনা সম্পর্কে একটু বিশ্লেষণ করে দেখি। গত এপ্রিলের শেষের দিকে ইউরোপভিত্তিক সংগঠন কর্পানিকাস ক্লাইমেন্ট চেইঞ্জ সার্ভিস ও কর্পানিকাস এটমসফেরিক মনিটরিং সার্ভিসেস (কেমস) জানিয়েছে, মহাকাশে ওজোন স্তরে ২০১১ সাল থেকে যে বিশাল এক ছিদ্র তৈরি হয়েছিল, তা অনেকখানি মুছে গেছে। এই ওজোন স্তর সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মিকে পৃথিবীতে আসতে দেয় না এবং এই অতি বেগুনি রশ্মির কারণেই ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বেড়ে যায়। তাপমাত্রার এই বৃদ্ধি উত্তর মেরুতে জমাট বরফকে গলিয়ে দেয় এবং এই জলপ্রবাহ বৃদ্ধিতে বেড়ে যাচ্ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা। মহাকাশে ওজোন স্তরের বিশাল আকৃতির ছিদ্র বন্ধ হওয়ার এই পর্যবেক্ষণটি আসে গত ২৩ এপ্রিল কেমস-এর কাছ থেকে। এই ওজোন স্তরের ছিদ্র বন্ধ হওয়ায় পেছনে কোভিড-১৯ এর ভ‚মিকা নিয়ে এখনো নানা মত আছে বিজ্ঞানীদের। কলকারখানা বন্ধ, গাড়ি চলাচল কমে যাওয়া ও ক্লোরোফ্লোরো কার্বনের নিঃসরণ কমে যাওয়ার কারণে ওজোন স্তরের ছিদ্র বন্ধ হয়েছে এমন বিশ্লেষণে বিশেষজ্ঞরা আসলেও কোভিড-১৯ এর লকডাউন এতে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করেছে তা নিয়ে আরো গবেষণার পক্ষপাতী ক্লাইমেট চেইঞ্জ বিজ্ঞানীরা।
অন্যদিকে সম্প্রতি দক্ষিণ-পশ্চিম বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় আম্ফান গত ২০ মে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকা এবং স্থলভাগে যে তাণ্ডব চালিয়েছে, তাও নতুন করে ভাবাচ্ছে পরিবেশ ও আবহাওয়া বিজ্ঞানীদের। বিশেষ করে আম্ফানের সৃষ্টি, বৈচিত্র্য ও ক্ষমতা নতুন করে উদ্বেগে ফেলেছে গবেষকদের। সাগরের জলরাশির উষ্ণতা বৃদ্ধি ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির অন্যতম কারণ বলে প্রাথমিক কিছু বিশ্লেষণ ইতোমধ্যে এসেছে। পুনের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল মেটেরিয়োলজির বিজ্ঞানীরা বলছেন, মে মাসের প্রথম সপ্তাহে বঙ্গোপসাগরের একাধিক জায়গায় পানির উষ্ণতা ছিল ৩২ থেকে ৩৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মতো। বিজ্ঞানী রক্সি ম্যাথু কোলেরের মতে, সাগরের ২৬ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির অনুক‚ল পরিস্থিতি তৈরি করে। তার বিশ্লেষণ, তাপমাত্রা বেশি হলে বাষ্পীভবন বেশি হবে এবং ঘূর্ণিঝড় এই জলীয়বাষ্প শুষেই শক্তি বাড়ায়। বঙ্গোপসাগরে ২০১৭ সালে ৩টি, ২০১৮ সালে ৫টি এবং ২০১৯ সালে ৩টি ঘূর্ণিঝড় তৈরি হয়েছিল এবং তার মধ্যে ২০১৭ সালে অক্ষি, ১০১৮ সালে তিতলি ও গজ, ২০১৯ সালে ফণী ও বুলবুল অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড়ের চেহারা নিয়েছিল। আমেরিকার স্টেট ইউনিভার্সিটির গবেষকদের মতে, বিশ্ব উষ্ণায়নকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে সাগরে পানির উষ্ণতা বাড়বে। আর সাগর উষ্ণ হলেই আগামী দিনে এমন মারাত্মক ঘূর্ণিঝড় আরো বেশি সংখ্যায় তৈরি হবে।
পৃথিবীর অনেক দেশে যখন কোভিড-১৯ মহামারি মোকাবিলায় হিমশিম খাচ্ছে, তখন ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের ছোবল এই সংকটের নতুন মাত্রা দিয়েছে। করোনা দুর্যোগের সঙ্গে পরিবেশ দুর্যোগের সম্পর্ক নিয়ে গবেষকরা যেমন ভাবছেন, অন্যদিকে এসব দুর্যোগের নতুন চেহারা ও ভয়াবহতার মাত্রা আমাদের দুর্যোগ মোকাবিলার কৌশলকে নতুন করে ভাবাতে শুরু করেছে। বাংলাদেশের পরিবেশ গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর এনভায়রনমেল্টাল এন্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসের (সিইজিআইএস) নির্বাহী পরিচালক মালিক ফিদা আবদুল্লাহ খানের মতে, ঘূর্ণিঝড় আম্ফান আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, দেশের কোনো এলাকাই ঘূর্ণিঝড়ের বিপদ থেকে মুক্ত নয়। ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলার জন্য এতদিনকার উপক‚লভিত্তিক যে চিন্তা, তা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ বজলুর রশিদ বলেছেন, আম্ফান যেভাবে উপক‚ল পেরিয়ে বিস্তীর্ণ এলাকা ধরে তীব্র গতি নিয়ে উত্তরাঞ্চলে পৌঁছেছে, তা একেবারেই ব্যতিক্রম। তার মতে, এ ধরনের তীব্র মাত্রার ঝড় বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম। বাংলাদেশের ভূখণ্ডে প্রবেশ করে প্রায় ২৮ ঘণ্টা ধরে তাণ্ডব চালিয়েছে ঘূর্ণিঝড় আম্ফান, যা ঘূর্ণিঝড়প্রবণ বাংলাদেশের ইতিহাসে কখনো ঘটেনি। ফলে এই ঘূর্ণিঝড়টি বাংলাদেশের আবহাওয়াবিদ, পরিবেশ গবেষক, ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং উন্নয়ন কৌশল নির্ধারণকারীদের নতুন করে সব ভাবতে শেখাচ্ছে। অন্যদিকে করোনার মহামারি ও পরিবেশ দুর্যোগের মোকাবিলায় সমন্বিত উদ্যোগের চিন্তাও করার তাগিদ আছে বিশ্লেষকদের। এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ২১ মে বৃহস্পতিবার জাতিসংঘের এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কমিশনের এসকাপের ৭৬তম অধিবেশনে ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে দেয়া মূল বক্তব্যে বলেছেন, ‘কোভিড-১৯ মহামারি স্বাস্থ্য সমস্যার পাশাপাশি অর্থনীতিকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করলেও এটি জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক সম্পদের জন্য ক্রমবর্ধমান প্রতিযোগিতা মোকাবিলায় বিশ^ব্যাপী প্রচেষ্টার পরিবর্তনের ওপর কিছু আশার আলো দেখাচ্ছে।’ রাষ্ট্র নেতারা এখন দুটোকে মিলিয়ে একসঙ্গে দেখার যে দৃষ্টিভঙ্গি নিচ্ছেন, তা অনেককেই আশান্বিত করছে।
এ কথা আমাদের স্বীকার করতে হবে যে, পুরো বিশ্ব ব্যবস্থাকে এক নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে করোনা মহামারি। মাটির নিচ থেকে প্রাকৃতিক উপাদান উত্তোলনকারী দেশগুলো কখনো ভাবতেই পারেনি যে, এমন একটা সময় হয়তো আসবে যখন আকাশে কোনো বিমান উড়বে না আর রাস্তায় কখনো গাড়ি চলবে না এবং তেল কেনার কোনো লোক থাকবে না। এরকম একটি পরিস্থিতিতে কক্সবাজার সমুদ্রে সাদা আর লাল ডলফিনের আনাগোনা যদি বেড়ে যায়, কিংবা কুয়াকাটা বিচ যদি লাল কাঁকড়ায় ভরে যায়, অথবা ইট-পাথরের রাজধানী ঢাকায় পত্রপল্লব-পুষ্পে শোভিত রাস্তা দেখে যদি আনন্দিত হওয়া যায়, তাতেই বা ক্ষতি কী? পৃথিবীর যে আদি চেহারাটা আমাদের অদেখা ছিল, তা যদি দেখার একটি সুযোগ তৈরি হয়, তাইবা কম কী সে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার অধ্যাপক ঢালী আল মামুনের ভাষায়, এখন লকডাউনের কারণে গোটা পৃথিবীতে প্রকৃতি একটা শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়ার সুযোগ তো পেয়েছে। আমাদের প্রতিবেশী যে শুধুমাত্র মানুষ নয় বৃক্ষ, প্রাণী, কীটপতঙ্গও যে আমাদের প্রতিবেশী একথা তো ভুলতে বসেছিলাম। প্রকৃতির সঙ্গে যদি আমরা সঠিক আচরণ না করি, তাহলে ডাইনোসরের মতো একদিন মানুষও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। কারণ এই ধরিত্রী মানুষ ছাড়াও ছিল, মানুষসহও আছে এবং মানুষ ছাড়াও থাকতে পারবে। তাই মানুষকেই ভাবতে হবে ধরিত্রীর সঙ্গে সে কীভাবে আচরণ করবে।