আজকের দিন তারিখ ২৩শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, সোমবার, ৮ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সর্বশেষ সংবাদ
সম্পাদকীয় চুক্তিভিত্তিক বিবাহ জিনিসটা কী?

চুক্তিভিত্তিক বিবাহ জিনিসটা কী?


পোস্ট করেছেন: dinersheshey | প্রকাশিত হয়েছে: এপ্রিল ২৩, ২০২১ , ২:১৮ অপরাহ্ণ | বিভাগ: সম্পাদকীয়


শ্যামল দত্ত  :

কিছুতেই ঘরে আটকানো যাচ্ছে না মানুষকে। নানা উছিলায় বেরিয়ে পড়ছে। ছেলে শিং মাছের ঝোল খেতে চেয়েছে, তাই উত্তরা থেকে বাবাকে আসতে হয়েছে কারওয়ান বাজার। জনৈক মামুনুল হক তার তৃতীয় স্ত্রী জান্নাতের জন্য রঙিন ওড়না অর্ডার দিয়েছেন। অনলাইনের অর্ডার সরবরাহকারী শাহবাগে ধরা খেয়েছেন পুলিশের কাছে। একজন গাড়িতে ‘জরুরি বিবাহ’ স্টিকার লাগিয়ে বিবাহ করতে বেরিয়েছেন এবং লকডাউনের মধ্যেও বিবাহটা যে কত জরুরি, তা বোঝানোর চেষ্টা করছেন ম্যাজিস্ট্রেটকে। অ্যাম্বুলেন্সে থাকার কথা ছিল রোগীর। পুলিশ আটকাতেই বেরিয়ে পড়ল ৮-১০ জন যাত্রী। গণপরিবহন না পেয়ে অ্যাম্বুলেন্সের এই বিশেষ যাত্রীসেবা একমাত্র বাংলাদেশেই পাওয়া যায়। মাস্ক নেই, সামাজিক দূরত্ব নেই কিন্তু লকডাউন আছে। লোকে লোকারণ্য রাস্তাঘাটে রীতিমতো ট্রাফিক জ্যাম আবার গণমাধ্যম লিখছে প্রতিদিন মৃত্যুর রেকর্ড।

এক টেলিভিশন চ্যানেলে মাওয়া ঘাটে এক যাত্রীর সাক্ষাৎকার দেখলাম। কেন মাস্ক পরেননি- এর উত্তরে বললেন, ‘আমার বাড়িতে কেউ মরে নাই, আমার নানার বাড়িতেও কেউ মরে নাই, আমার গ্রামে কেউ মরে নাই, আমার পাশের গ্রামেও কেউ মরে নাই। মাস্ক পরে আমি মরব নাকি?’ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, লকডাউন আরো বাড়াতে হবে। আর দোকানদাররা বলছেন, দোকানপাট খুলে দিতে হবে। অন্যদিকে স্বাস্থ্যের মহাপরিচালক একহাত নিয়েছেন বিশেষজ্ঞদের।

বলেছেন, দায়িত্বে থাকার সময় আপনারা কী কাজটি করেছিলেন? এখন খালি জ্ঞান দিচ্ছেন? জ্ঞান না দিয়ে করোনা রোগীর পাশে এসে দাঁড়ান। টেলিভিশন খুললেই দেখা যাচ্ছে জ্ঞান আর জ্ঞান। বিনামূল্যে জ্ঞান বিতরণের এ রকম জায়গা পৃথিবীতে আর খুঁজে পাওয়া ভার। তবে এই লকডাউনে জ্ঞানের ভারে ভারাক্রান্ত ঘরবন্দি মানুষের বিনোদনের বড় অভাব। বিনোদন দিচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। পুলিশ আর এক ডাক্তারের বাহাস অতি উচ্চ মার্গের বিনোদনের পর্যায়ে পড়েছে। আইডেন্টিটি কার্ড দেখতে চাওয়ায় পুলিশকে একহাত নিয়েছেন এ ডাক্তার। সদম্ভে গাড়ি থেকে নেমে বললেন, দেখব আজ কে বড়? ডাক্তার না পুলিশ? ডাক্তার বললেন, আমি মুক্তিযোদ্ধার কন্যা। পুলিশ বললেন, আমিও মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তীর প্রাক্কালে এই দুই মুক্তিযোদ্ধার সন্তানের বাহাসে কে বড়, সেই প্রশ্নের মীমাংসা হয়নি। তবে ছোটবেলায় পড়েছিলাম, ‘আপনারে বড় বলে বড় সে নয়, লোকে যারে বড় বলে বড় সে হয়।’ কে বড়? সেটা পাঠক আপনারাই মীমাংসা করুন। তবে এর মধ্যে এক নারী আইনজীবীও এই প্রশ্ন নিয়ে মাঠে নেমেছেন। রাস্তায় আটকাতেই তিনি বলেন, দেখে নেব আজ কে বড়? পুলিশ না আইনজীবী? এসব দেখে অনেকের মন্তব্য, সমাজ থেকে বিনয় শব্দটি বোধ হয় উঠেই গেছে।

এর মধ্যে পুরনো এক শব্দ নতুন করে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। চুক্তিভিত্তিক শব্দটি বাংলাদেশে বহুল পরিচিত। প্রশাসনে এ শব্দটির ব্যাপক জনপ্রিয়তা আছে। সরকারি আমলারা চাকরির মেয়াদ শেষে নানা চেষ্টা-তদবির করে সাধারণত এটি পেয়ে থাকেন। যারা পান তারা বেজায় খুশি, যারা পান না তারা রীতিমতো বেজার। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ না পেয়ে অনেক সরকারি কর্মকর্তা সুশীল হয়ে যান। টেলিভিশনে গরম গরম বক্তৃতা দিয়ে থাকেন সরকারের বিরুদ্ধে। সরকারে থাকতে কেন এ বিষয়গুলো দেখেননি, এই প্রশ্ন করলে চুপ মেরে যান। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের এই দ্যোতনার মধ্যে নতুন মাত্রা যোগ করেছে চুক্তিভিত্তিক বিয়ে। মনুষ্য সমাজে এ বিষয়টা মনে হচ্ছে একেবারেই নতুন। আরব দেশে এক সময় ‘মুতা বিবাহ’ নামে একটি বিবাহ পদ্ধতি চালু ছিল, যেটা পরবর্তীতে অপব্যবহারের কারণে নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু শিয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে এখনো এ ব্যবস্থা চালু আছে বলে কথিত আছে। তথ্য-উপাত্ত ঘেঁটে দেখা যায়, মুতা বিবাহ একটি নির্দিষ্ট ও স্বল্প সময়ের জন্য বিবাহ ব্যবস্থা। এটা কয়েক ঘণ্টা হতে পারে, আবার কয়েক দিনও হতে পারে। সময় শেষ হলে আপনা-আপনি এ ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে যায়। কোনো তালাকের প্রয়োজন হয় না। কিন্তু চুক্তিভিত্তিক বিবাহ বিষয়টি অনেকের কাছেই নতুন।

সম্প্রতি হেফাজত নেতা মামুনুল হকের দুটি এ ধরনের বিবাহ ‘চুক্তিভিত্তিক বিয়ে’র বিষয়টিকে সামনে নিয়ে এসেছে। পুলিশ হেফাজতে থাকা এ হেফাজত নেতা জানিয়েছেন, তার প্রথম স্ত্রীর পাশাপাশি দুই জান্নাতকেই তিনি চুক্তিভিত্তিক বিয়ে করেছেন। এরা কোনো দিন স্ত্রীর মর্যাদা পাবেন না, কোনো সম্পত্তিও পাবেন না কিন্তু ভরণ-পোষণের খরচ হিসেবে কিছু টাকা পাবেন। টাকার বিনিময়ে এ ধরনের স্ত্রী রাখার বিধানটি একেবারেই অভিনব। অন্যদিকে এই পুরো চুক্তিটিও আবার মৌখিক। কোনো কাগজপত্র নেই। তিনি এর মধ্যে অভিযোগ করেছেন তার তৃতীয় স্ত্রী দ্বিতীয় জান্নাত এরই মধ্যে এ চুক্তি ভঙ্গ করেছেন। কারণ তার ভাই বোনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না বলে মোহাম্মদপুর থানায় একটি মামলা করেছেন। তার মতে, এই ধরনের মামলা চুক্তিভঙ্গের শামিল। অন্যদিকে বাংলাদেশের বিদ্যমান আইনে এ ধরনের কোনো বিবাহ ব্যবস্থা আছে কিনা, তা আইন বিশেষজ্ঞরাই ভালো বলতে পারবেন। তবে হাক্কানি আলেম সমাজ সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, চুক্তিভিত্তিক বিবাহের কোনো বিধান বাংলাদেশে নেই। এর মধ্য দিয়ে মামুনুল হক জেনা করেছে। জেনা শব্দটির অর্থ কী, এ সম্পর্কে আমার খুব একটা ভালো ধারণা নেই। তবে বিভিন্ন মহলে শুনছি, এই চুক্তিভিত্তিক বিবাহ শব্দটি পুরুষ সমাজের মধ্যে ব্যাপক আলোড়ন ও আগ্রহ গড়ে তুলেছে।

দেশে দেশে লকডাউন চলছে। প্রতিবেশী ভারতে লকডাউনের গুরুত্ব বোঝানোর জন্য দিল্লিতে একে কার্ফু হিসেবে অভিহিত করা হচ্ছে। কার্ফু শুরু হওয়ার আগেই দিল্লির বিভিন্ন মদের দোকানে লম্বা লাইন। গাদা গাদা দেশি-বিদেশি মদ কিনে বাসাভর্তি করে ফেলছেন অনেকে। এক মহিলা ক্রেতা তো বলেই ফেললেন, করোনাকে ঠেকাতে হলে ওষুধ নয়, দরকার কয়েক পেগ। এই পেগ কীভাবে করোনা ঠেকাচ্ছে, তা অবশ্য এখনো জানা সম্ভব হয়নি। তবে তিনি একটি প্রেসক্রিপশন দিয়েছেন। গ্লাসে এক পেগ হুইস্কি ঢালবেন। নাকের কাছে নিয়ে যদি গন্ধ পান, তাহলে বুঝবেন আপনার করোনা হয়নি। আর যদি গন্ধ না পান তাড়াতাড়ি হাসপাতালে ভর্তি হন। করোনার রোগী নির্ণয়ের জন্য এটি বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যবস্থা কিনা সন্দেহ আছে। তবে লকডাউন বা কারফিউ যেমন চলছে, তেমনি ভারতে নির্বাচন চলছে, কুম্ভ মেলাও চলছে। আবার করোনাও বাড়ছে।

কুম্ভ মেলায় স্নান করতে এসে নেপালের সাবেক রাজা জ্ঞানেন্দ্র এবং তার স্ত্রী করোনা আক্রান্ত হয়েছে। কুম্ভ মেলায় স্নানের দৃশ্য দেখার মতো। একদল সাধু নেংটি পরে পুণ্যস্নান করছেন। নেংটিটি দেখতে আবার মাস্কের মতো। এটি দেখে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক কর্মকর্তা মুখ্যমন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করেছেন, মাস্ক এত নিচে কেন?

নিচে বা উপরে নয়, মাস্ক পরতে হবে যথাযথ জায়গায়। স্বাস্থ্যবিদরা নানা উপদেশ দিচ্ছেন, তবুও জনগণকে মাস্ক পরানো যাচ্ছে না। হাঁসফাঁস লাগে, শ্বাস ফেলতে পারি না, বাসায় ফেলে এসেছি, গাড়িতে আছে, এইতো পকেটে- এ রকম নানা অজুহাত। ইউরোপের এক দেশে দেখলাম মাস্ক না দেখলেই পুলিশ সপাটে লাঠি চালাচ্ছে। ইন্দোনেশিয়ায় মাস্ক না পরলে কানে ধরে উঠবস করানোর শাস্তি চালু করেছে। কী করলে বাংলাদেশের মানুষকে মাস্ক পরানো যাবে তা অবশ্য বলা কঠিন।

তবে এই লকডাউনে সবাই বাসায় থাকার কথা থাকলেও সামাজিক সংকট কিন্তু থেমে নেই। মারামারি খুনোখুনি চলছে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক হচ্ছে লকডাউনের মধ্যে গাঁজার ব্যাপক আমদানি। কি কারণে গাঁজার চাহিদা বেড়ে গেল সামাজিক গবেষকরাই এটা ভালো বলতে পারবেন। কেজিতে কেজিতে গাঁজা ধরা পড়ছে বিভিন্ন জেলায়। শৈশবে গ্রামের বাজারে দেখেছি লাইসেন্সকৃত গাঁজা ও আফিমের দোকান। তার মানে সে সময় গাঁজা খাওয়ার একটি প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা চালু ছিল। ইউরোপের অনেক দেশে গাঁজার গাছ লাগানোর অনুমতি দেয়া হয়েছে। তবে এর জন্য ট্যাক্স দিতে হয়। বাংলাদেশে গাঁজা চাষের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিলে বোধহয় রাজস্ব বাড়ানো সম্ভব হতো। নকল ও ভেজাল মদ খেয়ে সম্প্রতি অনেকেই বেঘোরে প্রাণ হারিয়েছেন। সাপ্লাই অব্যাহত থাকলে এসব প্রাণহানি বোধহয় ঠেকানো যেত।

তবে এর মধ্যে বাসায় থাকতে থাকতে অনেকে কাপড়-চোপড় পরা ভুলে যাচ্ছেন, অনেক দামে কেনা মেকআপগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে এমন অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। পুরুষরা লুঙ্গির ওপর নির্ভরতা বাড়িয়েছেন। লুঙ্গিকে এর আগেই শাহরুখ খান অত্যন্ত জনপ্রিয় করেছেন ‘চেন্নাই এক্সপ্রেস’ ছবিতে লুঙ্গি ডান্স গানটি গেয়ে। লুঙ্গি পরতে পরতে লুঙ্গির ওপর ভালোবাসায় লুঙ্গি নিয়ে নাতিদীর্ঘ রচনা লিখে পাঠিয়েছেন একজন। তিনি লিখেছেন, লুঙ্গি একটি অত্যন্ত বিপজ্জনক বাঙালি পোশাক। যদিও এর ভেন্টিলেশন সিস্টেম অনেক চমৎকার। সুন্দর বায়ুপ্রবাহ ভেতরের পরিবেশকে অত্যন্ত ঠাণ্ডা রাখে। মাঝে মাঝে প্রবল বায়ুপ্রবাহ ভেতরের সবকিছু দেখিয়ে দিতে পারে, তবে তা হবে অত্যন্ত রোমাঞ্চকর। কপাল ও লুঙ্গির মধ্যে মিল ও অমিল আছে। মিল হচ্ছে, দুটোই যে কোনো সময় খুলে যেতে পারে। অমিল হচ্ছে একটা খুললে পৌষ মাস, অন্যটায় সর্বনাশ। তবে এর বাঁধন বা গিট্টু অত্যন্ত শৈল্পিক একটি ব্যাপার। শৈল্পিক এই ব্যাপারটি জানেন না বলে অনেকেই সকালে উঠে লুঙ্গি বাবাজির দেখা পান না। তাই সাবধান। ভালো করে গিট্টু দিতে শিখুন। মনে রাখবেন… একটি দুর্ঘটনা সারা জীবনের কান্না।

শেষ করব স্বামী-স্ত্রীর এক গল্প বলে। ঘরবন্দি দম্পতি রাতে জানালা খুলে দিয়ে পূর্ণিমার চাঁদ দেখছেন। স্ত্রী কোমল কণ্ঠে স্বামীকে জিজ্ঞেস করছেন, এমন একটি সুন্দর জিনিসের নাম বল তো, যেটা দেখা যায় কিন্তু ছোঁয়া যায় না। স্বামী নির্বিকার কণ্ঠে বলল, পাশের বাড়ির ভাবি। এরপরই শুরু হয়ে গেল ঝগড়া।