আজকের দিন তারিখ ২১শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শনিবার, ৬ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সর্বশেষ সংবাদ
সাহিত্য কথা, সাহিত্য কথা লীড ধর্ম-দর্শনের’ দৃষ্টিতে রমজান

ধর্ম-দর্শনের’ দৃষ্টিতে রমজান


পোস্ট করেছেন: admin | প্রকাশিত হয়েছে: জুন ৮, ২০১৬ , ৩:৫৩ অপরাহ্ণ | বিভাগ: সাহিত্য কথা,সাহিত্য কথা লীড


যে কোন বিষয়েরই অসম্প্রদায়িক ও সার্বিক বিশ্লেষণ সবার কাছেই গ্রহণীয়। রমজানকে সচরাচর দেখা যায় শুধু কোরআন ও হাদিসের আলোকেই ব্যাখ্যা করা হয়।

কোরআন ও হাদিসের দৃষ্টিকোণ ছাড়াও ধর্ম দর্শন অর্থাৎ Theology দিয়ে ব্যাখ্যা করা হলে রমজান শুধু ইসলাম নয় সব ধর্মীয় ও অধর্মীয় দৃষ্টি কোন থেকে সার্বজনীন ভাবে বোধগম্য হবে। কোরআন ও হাদিস ইসলামী ধর্ম গ্রন্থ বিধায় ইসলাম ছাড়া অন্যান্য ধর্ম্ অনুসারীরা রমজান এর উপকারিতা ও বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পারেনা। তাই সামগ্রিক ও সার্বজনীন ব্যাখ্যার জন্য বিশেষ কোন ধর্মীয় গ্রন্থের আলোকে বিশ্লেষণ করা ছাড়াও যদি সার্বিক দৃষ্টিকোণ অর্থাৎ ধর্ম দর্শন বা Theology’ দিয়ে যুক্তির আলোকে উপস্থাপন করা যায় তা হবে অনেক বেশী সমাদৃত। আর সে কারনেই এ বিষয়ের অবতারণা।

মুল বিষয়ে যাওয়ার আগে ধর্ম দর্শন বা Theology কি সেটা একটু পরিষ্কার করা দরকার। ধর্ম দর্শন বা Theology হল যুক্তি ও মুক্ত বুদ্ধির আলোকে ধর্মকে বিশ্লেষণ করা। কেবলমাত্র ধর্মগ্রন্থ অথবা কু-সংস্কার এর বাইরেও মুক্ত চিন্তা ও বাস্তবতার নিরিখে ধর্মকে পরিচর্চা ও অনুশীলন করা হল ধর্ম দর্শন বা Theology।

শুধু অন্ধ বিশ্বাস দিয়ে ধর্ম চর্চা করাটা প্রকৃত ধার্মিক বাক্তির বৈশিষ্ঠ্য নয় বরঞ্চ তা যদি যুক্তি ও প্রজ্ঞার আলোকে ব্যাখ্যা করা যায় তা ভিন্ন ধর্ম অনুসারীদেরকে ও আকৃষ্ট করতে পারে। ধর্ম দর্শন- ধর্মের সরূপ ও আচার অনুষ্ঠান গুলো যুক্তি ও বুদ্ধির আলোকে বিশ্লেষিত করে। ধর্মপ্রান বাক্তি দর্শনের আলোকে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান গুলো ব্যাখ্যা করেন তার ধর্মীয় বিশ্বাসকে পরিত্যাগ করার জন্য নয় বরঞ্চ সেই বিশ্বাসের ভিত্তিকে আরও মজবুত করার জন্য। ধর্ম দর্শন, ধর্ম বিশ্বাসকে সুদৃঢ় করে- কারন তা প্রজ্ঞার আলোকে অর্জিত বিশ্বাস।

প্রায়শ ধর্মীয় ব্যাখ্যার বিকৃত প্রচারণার কারনে আজকাল পুরো ধর্মকে কলুষিত করার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। তার কারন ধর্ম দর্শন বা Theology’র যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছেনা। সত্যিকার অর্থে ধর্ম ও দর্শনের অনুশীলন পদধতি ভিন্ন হলেও চূড়ান্ত লক্ষ একই- আর তা হোল মানব কল্যাণ। এক্ষেত্রে বাক্তিগত জ্ঞানের স্বল্পতা কিংবা ধর্মীয় জ্ঞানের পরিপূর্ণ প্রজ্ঞা সম্মত বিশ্লেষণ না করে যদি কেবল সল্প-শিক্ষিত কু-সংস্কারে আছন্ন ধার্মিক বাক্তিদের মতামতকে অবলম্বন করে পুরো ধর্মকে ঘৃনা ও নেতিবাচক দৃষ্টিতে প্রচার করা হয় তার দায়বদ্ধতা সেই বাক্তি বিশেষের নিজের। কোন ধর্মের নয়। প্রত্যেক ধর্মেই ধর্মে উল্লেখিত মৌল নীতিকে অপরিবর্তিত রেখে সমসাময়িক ভাবে উদ্ভূত সমস্যা সমাধানের উপায় রাখা হয়েছে।

তেমনি ইসলাম ও তার বহির্ভূত নয়। ইসলামে কোরআন, হাদিস, ইজমা ও কিয়াস এ চারটি মুল ধারা আছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে উদ্ভুত নতুন নতুন সমস্যা সমাধানের জন্য রাখা হয়েছে ইজমা ও কিয়াস। কিন্তু শুধু কোরআন ও হাদিস নিয়ে সব সমস্যার সমাধান দেয়ার চেষ্টা করা হয় বলে অনেক ক্ষেত্রে বিষয়টির সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা পাওয়া যায়না। ইজমা ও কিয়াস হল ইসলামের ধর্ম দর্শন বা Theology’।

এবার আসা যাক রমজান প্রসঙ্গে ধর্ম দর্শন এর বিচারমুখী বিশ্লেষণে। আমরা বরাবরই কোরআন ও হাদিসের আলোকে রমজানকে ব্যাখ্যা করে থাকি। অবশ্যই কোরআন ও হাদিসের ব্যাখ্যা সর্বাগ্রে গ্রহণযোগ্য। কিন্তু ধর্ম দর্শন থেকে ব্যাখ্যা করা হলে বিষয়টি বোধহয় আরও বেশী সার্বজনীন হয়। তাতে শুধু ইসলাম নয় অন্যান্য মতানুসারিরা ও বিষয়টি সাধারণ ভাবে অনুধাবন করতে পারবে।

রমজান’ হিজরি সাল বা ইসলামী বছরের নবম মাস। ইসলাম ধর্মে কলেমা, নামাজ, রোজা, হজ, যাকাত এ পাঁচটি মূল ভিত্তির মধ্যে রমজান তৃতীয় গুরত্তপূন বিষয়। এ মাসে ইসলাম ধর্ম অনুসারীরা সারাদিন অর্থাৎ সূর্য উঠার আগ থেকে সূর্য ডোবা পর্যন্ত না খেয়ে থাকে। পানি সহ যে কোন ধরণের খাবার খাওয়া নিষেধ। এখানে বলে রাখা দরকার যে শিশু, অতিশয় বৃদ্ধ ও ভ্রমণকারী তাদের ক্ষেত্রে রমজান বা রোজা অত্যাবশ্যকীয় নয়। শুধু মাত্র যারা সমর্থ ও শাররিক ভাবে সুস্থ তাদের উপর ফরজ বা অবশ্য করনীয় করা হয়েছে।

বলা বাহুল্য নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই রমজান ফরজ। এখানে পুরুষ ও নারীকে আলাদা গুরত্ত বা বেশী সুযোগ দেয়া হয়নি যাতে করে কেউ কারো প্রতি অবমূল্যায়ন করতে পারে। নারী-বাদীতা বা পৌরুষ-সুবিধা বলে কোন বৈষম্য করা হয়নি। তাই রমজান এর ব্যাপারে ইসলাম ধর্মকে একপেশে বা কঠোর বলা যায়না।

বরঞ্চ সাম্যবাদ বা নারী-পুরুষের সমান অংশগ্রহণ বাধ্যতা মুলক করা হয়েছে। আবার অসুস্থ ও শাররিক ভাবে অসমর্থদের ব্যাপারে ইসলাম, রমজানের ব্যাপারে কোন কঠোর প্রযোজ্যতা আরোপ করেনি।

তাহলে এই যে সারাদিন না খেয়ে থাকা তার উপকারিতা বা প্রয়োজনীয়তা কি। তার বিজ্ঞান সম্মত ব্যাখ্যা হল সারা দিন না খাওয়া হলে পাকস্থলীর বিশ্রাম হয়। কারন খাদ্য হজম করার জন্য পাকস্থলীর যে শক্তি দরকার, খাবার না পেলে হজম করার জন্য তাকে বাড়তি পরিশ্রম করতে হয়না। সে শক্তি টুকু সঞ্চয় হয়।

আর পাকস্থলী যখন বিশ্রাম নেয় রক্তের শ্বেত-কণিকা বা white blood cells রক্তে বিদ্যমান যে কোন বাড়তি জীবাণু বা বাকটরিইয়ার উপস্থিতি ও আক্রমণকে সহজে শনাক্ত করতে পারে। তাই স্বাস্থ্যগত দিক থেকে রমজান উপকারী। যুক্তি ও বাস্তবিক উদাহরন তুলে ধরা হলে রমজান শুধু ধর্মের জন্য নয় শাররিক উপকারের জন্য ও প্রযোজ্য।

এদিকে সারাদিন না খেয়ে থাকার কারনে আমাদের কিছু না কিছু খাবার সাশ্রয় হয় বটে। অতিরিক্ত খাবার কেনা থেকে কিছুটা অর্থ ও সঞ্চিত হয়। সেই সঞ্চিত অর্থ আমরা দুঃস্থ ও অনাহারী মানুষ দের দান করতে পারি বাড়তি পরিশ্রম ছাড়াই। তারচে বড় কথা অনাহারী মানুষের ক্ষুদার যন্ত্রণা কিছুটা হলেও অনুভব করতে পারি না খেয়ে থাকার অভিজ্ঞতা থেকে। এসব শুধু ধর্মীয় অনুশাসন থেকে নয় মানবতা থেকে ও করতে পারি। দুঃস্থ ও অনাহারী মানুষের প্রতি মানুষের সহমর্মিতা ও সহানুভূতি শুধু ধর্ম নয় মানবিক আবেদন থেকে ও আসতে পারে। ইসলাম মানবতাকেই জোড় দিয়েছে বলে রমজানকে ফরজ করা হয়েছে। কেননা অনেক সময় কোন কিছু জোড় না দেয়া না হলে কর্তব্য নয় বলে করা হয়না।

এতো গেল শুধু সমবাদীতা, স্বাস্থ্য উপকারিতা ও মানবতার কথা। এছাড়াও রয়েছে বিশ্বাস ও বুদ্ধির, প্রত্যাদেশ ও প্রজ্ঞার, স্রষ্টার ও সত্তার বিশ্লেষণের বিশেষ পদ্ধতি। যারা অতীন্দ্রিয় সত্তা বা স্রষ্টায় বিশ্বাসী নন তারা রমজানকে মনে করতে পারেন ডায়েট কিংবা মেডিটেশন–এর বিকল্প হিসেবে এতে অন্তত ধর্ম বিশ্বাসীদের অনুভুতিতে কিছুটা হলেও সহিষ্ণুতা বা সহমর্মীতা প্রদর্শন করা হবে। আসলে রমজানের ধর্ম তাত্ত্বিক আরও বিস্তৃত ব্যাখ্যা রয়েছে যা ছোট পরিসরে বলে শেষ করা যাবেনা। সবচেয়ে বড় কথা মানুষের অনুভুতি ও মূল্যবোধে আঘাত করা কোন মানবিকতা বা মানব ধর্ম হতে পারেনা। মানবিকতার মূল কথা হল সব মানুষকে সমান দৃষ্টিতে দেখা ও তাদের মূল্য বোধকে শ্রদ্ধা করা। রমজানের আরও বহুমাত্রিক ও সার্বজনীন দার্শনিক বিশ্লেষণ পরবর্তীতে তুলে ধরার প্রয়াস রইলো।

কাজী সুলতানা শিমি, অস্ট্রেলিয়া থেকে।