প্লাজমা ডোনার সেজে প্রতারণার নতুন ফাঁদ
পোস্ট করেছেন: Dinersheshey | প্রকাশিত হয়েছে: জুলাই ২, ২০২০ , ৬:৫০ পূর্বাহ্ণ | বিভাগ: এক্সক্লুসিভ
দিনের শেষে প্রতিবেদক : ‘আপনার মায়ের জন্য প্লাজমা লাগবে?’ কথিত ডোনারের ফোন পেয়ে আগ্রহ নিয়ে রিজেন্ট এয়ারওয়েজের কর্মকর্তা রুশলান শাহ আদিব ‘হ্যাঁ’ বলেন। এরপরই ফোনের অপর প্রান্ত থেকে বলা হয় তিনি গাজীপুরের মাওনা রয়েছেন। ঢাকায় আসতে গাড়ির জ্বালানি খরচ বাবদ ৬ হাজার টাকা মোবাইল ব্যাংকিংয়ে পাঠাতে হবে। আদিব টাকা না পাঠিয়ে তাকে গাড়ি দিয়ে সেখান থেকে ঢাকা আনতে চান। শেষ পর্যন্ত ফোনটি বন্ধ করে দেন প্লাজমা দিতে চাওয়া ওই ব্যক্তি।
আদিবের মা ফারজানা ইয়াসমিন (৪৮) করোনা আক্রান্ত হয়ে ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। চিকিৎসকরা তার সুস্থতায় প্লাজমা চাইলে আদিব ও স্বজনরা ফেসবুকে প্লাজমা চেয়ে স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত প্রতারকের খপ্পরে পড়ে প্লাজমা তো পাননি, উল্টো অকালেই হারিয়েছেন মাকে।
করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসায় পৃথিবীতে এখনও সুনির্দিষ্ট ওষুধ নেই। তবে নানা চিকিৎসা পদ্ধতির সঙ্গে করোনা থেকে সুস্থ হওয়া মানুষের দেহ থেকে প্লাজমা (রক্ত রস) সংগ্রহ করে মুমূর্ষু করোনা রোগীর দেহে প্রয়োগ করলে সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনার কথা বলে আসছেন চিকিৎসকরা। এ জন্য করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির স্বজনরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট দিয়ে প্লাজমা ডোনারের সন্ধান করেন।
মৃত্যুপথযাত্রী মানুষ আর ওই সময়টাতে তাদের স্বজনদের মানসিক অবস্থাটা পুঁজি করে প্লাজমা ডোনারের নামে প্রতারণার ভয়ঙ্কর ফাঁদ পেতে বসেছে। ওই চক্রটি যাতায়াত ভাড়ার নামে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে টাকা দাবি করে। অনেকে আবার নিজেকে দরিদ্র দাবি করে বড় অঙ্কের টাকাও দাবি করে। রোগীর কথা চিন্তা করে স্বজনরা টাকা পাঠানোর পর প্রতারকচক্রটি মোবাইল ফোনটি বন্ধ করে দেয়। বহু মানুষ এই প্লাজমা প্রতারকের খপ্পরে পড়লেও বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরের বাইরেই রয়ে যাচ্ছে।
মায়ের জন্য প্লাজমা চেয়ে নিজের রূঢ় অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে রুশলান শাহ আদিব বলেন, তার মাকে ৩১ মে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এরপরই চিকিৎসকরা প্লাজমা সংগ্রহের কথা বলেন। তারা তা চেয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন। গাজীপুর ছাড়াও ঢাকার দক্ষিণখান থেকে এক ব্যক্তি প্লাজমা দিতে চান। সে জন্য যাতায়াত ভাড়া হিসেবে তিনি ১৫শ’ টাকা দাবি করেন। তিনি তা পাঠিয়ে দেন। শেষ পর্যন্ত ওই লোকটি না এসে মোবাইল ফোনটি বন্ধ করে দেন। এমন করে তার এক স্বজনের কাছে ২০ হাজার টাকা দাবি করা হয়। একই ভাবেই ৭ জন প্রতারক তাদের ফোন দিয়ে টাকা দাবি করে। তিনি বলেন, প্লাজমা দিতে পারলে হয়তো তার মা বেঁচে যেতেন। তা আর সম্ভব হলো না। যারা এই সময়ে প্রতারণা করেছে, তারা অমানুষ। এই চক্রটিকে আইনের আওতায় নেওয়া দরকার।
নাফিসা তাবাসসুম বেসরকারি নর্দান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক। তিনিও তার করোনা আক্রান্ত বাবার জন্য ফেসবুকে প্লাজমা চেয়ে প্রতারণার শিকার হন। তিনি বলেন, ফেসবুকে নিজের নম্বর দিয়ে প্লাজমা ডোনার খুঁজছিলেন। এক ব্যক্তি ফোন করে তা দিতে রাজি হন। ওই ব্যক্তি বলেন, তার গাড়ি নেই। হাসপাতালে আসতে বন্ধুর মোটরসাইকেল নিয়েছেন। এ জন্য জ্বালানি খরচ বাবদ অগ্রিম টাকা পাঠাতে বলেন। অবশ্য তার আগেই তার বাবার জন্য স্বজনদের মাধ্যমে প্লাজমা পেয়ে যাওয়ায় প্রতারকের হাত থেকে রক্ষা পান। তার বাবাও এখন সুস্থ।
বাবার জন্য প্লাজমা চেয়ে একই ধরনের প্রতারকের খপ্পরে পড়েন একটি আইটি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিকুর রহমান। তিনি বলেন, ফেসবুকেও এই চক্র সক্রিয়। এদের নম্বরে ফোন দিলেই নানা কারণ দেখিয়ে টাকা চায়। আবার অনেকে ফোন করেও প্লাজমা দেওয়ার কথা বলে টাকা দাবি করে।
প্লাজমা সংক্রান্ত সরকারের কারিগরি কমিটির প্রধান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক অধ্যাপক মহিউদ্দিন আহমেদ খান (ডা. এম এ খান) বলেন, কার প্লাজমা দরকার বা কার দরকার নেই- সে বিষয়ে দেশে নীতিমালা নেই। এটা নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে কার্যক্রমও নেই। কিন্তু প্লাজমা থেরাপি নিতে রোগী আগ্রহী। সে তুলনায় সচেতনতার অভাবে তা পাওয়া যাচ্ছে না। এই সুযোগটাই কাজে লাগাচ্ছে প্রতারক চক্র। তিনি বলেন, এটা বন্ধে প্লাজমা নিয়ে সরকারের নির্ধারিত একটা সেল বা প্লাজমা ব্যাংক হওয়া দরকার। পাশাপাশি মানুষকে উৎসাহী করতে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্লাজমা ডোনারকে সনদ দেওয়া উচিত। প্রতারকদেরও আইনের আওতায় আনা উচিত।
পুলিশের অপরাধ বিভাগের (সিআইডি) কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্লাজমা ডোনার সংগ্রহ করে রোগীর স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেন। তিনি বলেন, প্লাজমা নিয়ে জাতীয়ভাবে সমন্বিত কার্যক্রম না থাকায় প্রতারকরা সুযোগ নিচ্ছে।