বাউফলে ভাঁড়ের কলসীতে দুধ লয়ে ওরা পাড়ি দেয় তেঁতুলিয়া নদী
পোস্ট করেছেন: Dinersheshey | প্রকাশিত হয়েছে: জুলাই ১১, ২০২৩ , ১২:৩১ অপরাহ্ণ | বিভাগ: সারাদেশ
বাউফল প্রতিনিধি : উত্তাল তেঁতুলিয়া। আসা যাওয়ায় পাড়ি দেয় দু’বার। দুধভর্তি ভাঁড়ের কসলী কাধে দুর্গম চরের দীর্ঘপথ পায়ে হাটার পরেও তেঁতুলিয়া নদী পাড়ি জমায় তারা কেবলই পরিবারের দু’মুঠো ভাতের জোগারে। শহিদুল, জালাল খলিফা, ফিরোজ, আকবর, খোকন, উজ্জল, হানিফ ব্যাপারী, জলিল দালাল, শিপন, খোকন মৃধা, খালেক পন্ডিত ও মানিক গাজী পেশায় সবাই দুধ বিক্রেতা। স্থানীয়রা এদের ‘ঘোস’ বা ‘গোয়ালা’ বলে জানে। পটুয়াখালীর বাউফলের মুলভূখন্ড বিচ্ছিন্ন চন্দ্রদ্বীপের বিভিন্ন এলাকায় এদের বাড়ি। কোন দিন নদী পাড় হয়ে পৌর সদরের বাজার ধরতে না পারলে অনাহারি বা অর্ধাহারে থাকাতে হয় পরিবারের সবাইকে। তাই ঝড় বৃষ্টির মৌসুমেও উত্তাল ঢেউ ঠেলে পাড়ি দিতে হয় তেঁতুলিয়া নদী। নদীর ভাঙনে ভিটেবাড়ি হারিয়ে দুধ বিক্রির মতো চরম কষ্টের পেশা বেছে নেয় ঘোসরা। দ্রব্যমূল্যের লাগাতার উর্ধ্বতির এ সময়ে কেবল দুধ বিক্রির আয়ে চলে তাদের সংসার। বাজার খারাপ গেলে প্রায়ই গুনতে লোকসান। এদের অনেকেরই মাথায় আবার মহাজনের দাদনের বোঝা। অসুখ-বিসুখ কিংবা কোন উৎসব পার্বণে ঋনের বিকল্প থাকে না অনেকেরই। মাথায় চাপে তখন নতুন ঋন। কারো আছে ছেলে মেয়ের লেখাপড়ার খরচ। দিন দিন বৈরী পরিস্থিতির কারণে পূর্বপুরুষের পেশা ছেড়ে তবুও দুধ বিক্রির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছেন ঘোসারা।
জানা গেছে, ঘোসা বা গোয়ালারা একসময় মাছ ধরা কিংবা কৃষিভিত্তিক নানা কাজে জড়িত ছিল। ওই সব কাজের আয়ে সংসার চলে না এখন। তাই এরা পরিবারের খাই-খবরচ জোটাতে বেছে নেয় দুধ বিক্রির মতো পেশা। তবে এই পেশাতেও নানান ঝক্কি ঝামেলার কথাও জানায় এরা। এদের অনেকেরই নেই নিজস্ব কোন গরু-মহিষ। মাসিক চুক্তিতে সংগ্রহ করতে হয় অন্যের গাভী অথবা মহিষের দুধ। কাকডাকা ভোরে অন্যের গোয়লঘর বা বাধানে পৌঁছে দুধ দুয়ে আনতে হয় নিজের হাতে। এরপর চরের মেঠোপথ পেড়িয়ে এসে খেয়ার নৌকায় প্রায় কিলোমিটারের প্রসস্ত তেঁতুলিয়া পাড় হয়ে ছুটতে হয় মুলভূখন্ডে। নদী পার হয়ে ভাঁড়ে কলসী বোঝাই দুধ নিয়ে পৌর সদরের উদ্দেশে আবারো ছুটে চলতে হয় ৫কিলোমিটার। কারো আবার মাসিক অথবা বাৎসরিক চুক্তি করে নিতে হয় খুচরা বিক্রির ঝামেলা এড়াতে মিষ্টির দোকানে, আইসক্রিম কারখানায়, অথবা চায়ের দোকান মালিকের সঙ্গে। এতেও বিড়ম্বনার যেন অন্ত: নেই। দাদন নেয়া থাকলে বাজার দর ওপরে উঠলেও চুক্তি অনুযায়ি কমদামেই দুধ দিতে হয় মহাজনের ঘরে। পুরো বছরে ওঠা নামা নেই মহাজনের দরের। বাজারে দর বেশি হলেও তার তোয়াক্কা করে না মহাজন। চর মিয়াজানের ঘোসাদের একজন মানিক গাজী (৬৫)। এ বয়সে ভাঁরে দুধের কলসী বইতে পারে না সে। ২ছেলে ১মেয়ে সহ ৫জনের সংসার। পরিবারের সকলের ভাত কাপড় জোগাতে নিরুপায় হয়ে রোজ সিলভারের এক কলসী দুধ মাথায় নিয়ে ছুটে যান পৌর সদরের বাজারে। তিনি বলেন, ‘দুধ বেহেস্তের মেওয়া, প্যাটটার দোজখ ঠান্ডার লইগ্যা বইতে অয়। আর না বইলে মহাজনের দাদন শোধ করমু ক্যামনে। ঘরের মাইনষেরে খাওয়ামু কি?’
একই পেশার অপর একজন খালেক পন্ডিত (৫০)। ৩ ছেলে ও ১ মেয়েসহ ৬ জনের সংসার। ছেলে মেয়েদের কারোরই লেখাপড়ার বালাই নেই। তার ধারণা দুধ বিক্রির পেশা নিচু মানের। ঘোসাদের ছেলে-মেয়েরা লেখাপড়া করে কি আর করতে পাড়বে। খালেক পন্ডিতের সহযাত্রি খোকন ঘোস (২৫) জানায়, চরমিয়াজান ও চরওয়াডেল থেকে প্রতিদিন গড়ে ৩৫-৪০ মন দুধ পাওয়া যায়। তবে শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন, কার্তিক এই চার মাস উৎপাদন থাকে কম। এ সময় সংসার সামাল দিতে মাছ ধরা, কামলা দেয়া বা অন্য কোন কাজ করতে হয় তাকে। এক ছেলে তার। বয়স ৮মাস। নিজে লেখাপড়া করতে পারেন নাই বলে তার ইচ্ছা ছেলেকে লেখাপড়া শেখাবেন তিনি। তিনি বলেন, ‘দুধ বেচি বোলে মাইনষে হিংসা কইর্যা আমারে গোয়াল (দুধ বিক্রেতা) কয়। পোলাডা ল্যাহাপড়া না জানলে এ নাম ঘুচপে ক্যামনে?’ আগের তুলনায় চন্দ্রদ্বীপের বিভিন্ন চরে গরু-মহিষের দুধ উৎপাদন কমে গেছে কয়েক গুনে। প্রতি লিটার গরুর দুধ ৭০থেকে ৮০ টাকা আর মহিষের দুধ ১০০থেকে ১২০ টাকা হলেও দাদনের কারণে মহাজন ঘোসদের কাছ থেকে গরুর দুধ ৫৫-৬০টাকা এবং মহিষের দুধ ৭০-৮০ টাকা দরে কেটে নেয় বলে জানা গেছে। আকবর (৪২) নামে পেশার অপর একজন বলেন, তেঁতুলিয়া দইরগা পাড়ি দিয়া অভাবের লইগ্যা এপাড় আই, দুধের দাম ওন্য সব জিনিসের মত বাড়ে নাই। এ ব্যবসায় আর চলন যাইবে না।’ পৌর সদরের ফারুক তালুকদার মহিলা কলেজের রসায়ন বিভাগের শিক্ষক অহিদুজ্জামান সুপন বলেন, ‘দিন দিন পেশা ছাড়ছেন ঘোসারা। বৈরী পরিস্থিতির কারণে খোকন, খালেক পন্ডিত, মানিক গাজীরমত চন্দ্রদ্বীপের বিভিন্ন চরের অর্ধশত ঘোস বা গোয়াল পরিবারের এখন ভাঁড়ে ঝোলান কলসীতে দুধ বইয়ে দৈন্য দশায় দিন কাটে। এদের অবহেলিত জীবনমান উন্নয়নে দৃষ্টি দেয়া উচিৎ।’