বাজেটে রাজস্ব আদায় বাড়ানোই মূল চ্যালেঞ্জ
পোস্ট করেছেন: dinersheshey | প্রকাশিত হয়েছে: জুন ৮, ২০২০ , ৪:৫৭ পূর্বাহ্ণ | বিভাগ: অর্থ ও বাণিজ্য
দিনের শেষে প্রতিবেদক : প্রতি বছরেই রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি থেকে যায়। আর এ বছর করোনাভাইরাসের প্রভাবে সেই ঘাটতি আরও বেড়ে যাবে। রাজস্ব আদায়ে এই নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি ঠেকানোই এখন এনবিআরের বড় চ্যালেঞ্জ।
এরই মধ্যে আসছে নতুন বাজেট। একদিকে করোনার প্রভাবে আগামী অর্থবছরে নতুন করারোপের চেয়ে বেশি কর ছাড় দেওয়ার চাপ, অন্যদিকে বাড়াতে হবে আদায়। এই চ্যালেঞ্জকে সামনে রেখেই আগামী ১১ জুন ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট দিতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল।
জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) শুল্ক-কর আদায়ে ঘাটতি ৬২ হাজার কোটি টাকা। বছর শেষে সংশোধিত লক্ষ্য থেকেই ঘাটতি ৮০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে মনে করছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
অন্যদিকে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডি মনে করছে, এবারের ঘাটতি ১ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। এ অবস্থায় আগামী অর্থবছরে এনবিআরকে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহের বিশাল লক্ষ্য দেওয়া হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে আগামী অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ে ৫০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে। যেখানে প্রতি বছর রাজস্ব আদায়ে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়। সবচেয়ে বেশি রাজস্ব আদায় করতে হবে ভ্যাটে। এই খাতে ১ লাখ ২৮ হাজার ৮৭৩ কোটি টাকা আদায় করার লক্ষ্য দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া আয়করে ১ লাখ ৫ হাজার ৪৭৫ কোটি টাকা এবং শুল্ক খাতে ৯৫ হাজার ৬৫২ কোটিটাকার লক্ষ্য থাকছে।
এনবিআরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত এপ্রিলে ১৯ হাজার ৫৮৫ কোটি টাকার রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ছিল। হয়েছে মাত্র ৮ হাজার ৭৮৯ কোটি টাকা। সার্বিকভাবে চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে ১ লাখ ৭৩ হাজার ৭৯৬ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় হয়েছে। এই সময়ে শুল্ক-কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ লাখ ৩৫ হাজার ৭৯৫ কোটি টাকা। ঘাটতি প্রায় ৬২ হাজার কোটি টাকা টাকা।
রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির জন্য নতুন ভ্যাট আইন চালু করা হয়। কিন্তু সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটির কারণে সবকিছু বন্ধ থাকায় এপ্রিল মাসে অর্ধেক প্রতিষ্ঠানই রিটার্ন জমা দিতে পারেনি। চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউস হলো রাজস্ব আদায়ের সবচেয়ে বড় জায়গা। কিন্তু সীমিত পরিসরে আমদানি চালু থাকায় গত এপ্রিল মাসে চট্টগ্রাম বন্দরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার এক-তৃতীয়াংশ অর্জিত হয়েছে।
চলতি অর্থবছরে এনবিআরের মূল লক্ষ্য ছিল ৩ লাখ ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। কাক্সিক্ষত হারে রাজস্ব আদায় না হওয়ায় এই লক্ষ্য কমিয়ে ৩ লাখ ৫০০ কোটি টাকা করা হয়েছে। সেই হিসাবে মে ও জুন মাসে এনবিআরকে ১ লাখ ২৬ হাজার ৭০ কোটি টাকা আদায় করতে হবে। করোনার সময়ে এই লক্ষ্য অর্জন কোনভাবেই সম্ভব নয়।
এই প্রসঙ্গে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের যে লক্ষ্য দেওয়া হয়েছে, সেটা অবাস্তব। রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে নতুন কোন উদ্যোগ নেই। গতানুগতিক কাঠামোর মধ্যেই রাজস্ব আদায়ের বড় লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হচ্ছে। যা কখনোই আদায় করা সম্ভব হবে না। ফলে বাজেট বাস্তবায়নে বড় ধরনের ঘাটতি তৈরি হবে। তিনি বলেন, রাজস্ব খাতে আমূল সংস্কার ছাড়া এত রাজস্ব আদায় করা সম্ভব নয়। এই সংস্কার এক দিনে করা সম্ভব নয়। আগামী অর্থবছর থেকেই স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার শুরু করা উচিত। প্রথমেই অটোমেশনে নজর দেওয়া উচিত। এতে দুর্নীতি-অনিয়ম কমবে। এ ছাড়া কর ফাঁকি প্রতিরোধে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। দ্রুত বিদ্যমান আইনগুলো যুগোপযোগী করতে হবে।
এনবিআরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ থাকায় গত এপ্রিল মাসে যে রাজস্ব আদায় হয়েছে, তা চলতি অর্থবছরের অন্য যে কোনো মাসের তুলনায় প্রায় অর্ধেক। এর মধ্যে বছরের প্রধান দুটি উৎসব চলে গেছে বাংলা নববর্ষ ও ঈদ। এই দুই উৎসবে সরকার বিপুল পরিমাণ ভ্যাট পেয়ে থাকে। কিন্তু এবার সেই সংগ্রহ অনেক কম।
এনবিআরের পূর্বাভাস অনুযায়ী, এবার বড়জোর ২ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার মতো শুল্ক-কর আদায় হতে পারে। করোনা ভাইরাসের কারণে আগামী অর্থবছরের প্রথমার্ধে (জুলাই- ডিসেম্বর) ব্যবসা-বাণিজ্য সেরকম চাঙা থাকবে বলে কেউই মনে করছেন না । লক ডাউন তোলার পর মানুষ ব্যক্তিগত ব্যয়ের ক্ষেত্রে অনেক সাবধানী থাকবে। এতে ভ্যাট আদায় কমে যাবে। তা সত্তে¡ও আগামী অর্থবছরে এনবিআরকে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহের বিশাল লক্ষ্য দেওয়া হচ্ছে।
এদিকে, করোনা পরিস্থিতিতে ব্যবসা-বাণিজ্যের স্থবিরতা কাটাতে করপোরেট কর কমানোর প্রস্তান দিয়েছে বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন (এফবিসিসিআই)। এছাড়াও সংগঠনটি ব্যক্তির করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো, অগ্রিম আয়করের হার কমানো, শিল্পের কাঁচামাল থেকে অগ্রিম কর তুলে নেয়া, রেয়াতযোগ্য মূল্য সংযোজন করের হার ১০ শতাংশে নামানো এবং আমদানি শুল্ক নিয়ে বেশকিছু প্রস্তাব দিয়েছে।
সংগঠনটির পক্ষ থেকে, করপোরেট কর আগামী তিন বছরে ২৫ শতাংশে নামানোর প্রস্তাব দেয়া হয়। বিস্তারিত প্রস্তাবে এ বছর করপোরেট কর ৫ শতাংশ কমানোর অনুরোধ করা হয়।
অগ্রিম আয়করের বিষয়েএফবিসিসিআইয়ের প্রস্তাব হলো, এটা ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩ শতাংশ করা হোক। শিল্পের কাঁচামালের ওপর থেকে অগ্রিম কর (এটি) পুরোপুরি তুলে নেওয়ার পক্ষে এফবিসিসিআই। আর অন্যদের ক্ষেত্রে এটি দ্রুত সমন্বয়ের তাগিদ দেওয়া হয় সংগঠনটির পক্ষ থেকে। করোনার মহামারিতে জীবনযাত্রার মানের অবনতির যুক্তি দেখিয়ে এফবিসিসিআই ব্যক্তিশ্রেণির আয়কর দাতার ক্ষেত্রে করমুক্ত আয়সীমা আড়াই লাখ থেকে বাড়িয়ে তিন লাখ টাকা করার প্রস্তাব দিয়েছে।
জানা গেছে, রাজস্ব আদায় বাড়াতে গত জুলাই মাস থেকে নতুন ভ্যাট আইন চালু হয়। মাঠপর্যায়ে নতুন আইনের নানা জটিলতার কারণে প্রথম দুই মাস ভ্যাট আদায়ে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়। আর প্রথম ছয় মাসে ভ্যাট আদায়ে প্রবৃদ্ধি হয় মাত্র ৭ শতাংশ। অন্য বছর এই সময়ে ভ্যাটের প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশের বেশি থাকে।