আজকের দিন তারিখ ২৪শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, রবিবার, ৯ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সর্বশেষ সংবাদ
সারাদেশ বাড়ির উঠানের সামনে ভারতের সীমানা প্রাচীর

বাড়ির উঠানের সামনে ভারতের সীমানা প্রাচীর


পোস্ট করেছেন: Dinersheshey | প্রকাশিত হয়েছে: মার্চ ৩১, ২০২১ , ২:৪৭ অপরাহ্ণ | বিভাগ: সারাদেশ


যশোরের নোম্যান্সল্যান্ড গ্রাম গাতিপাড়া প্রতিনিধি : সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধা কোহিনুর বেগম। আদি বাড়ি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার রানাঘাট এলাকায়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি বাবা-মাসহ নদীয়া জেলার বগলুতে আসেন তার ফুফু বাড়িতে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সেখান থেকে যোগাযোগের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তান সীমান্ত এলাকা যশোরের পুটখালির ইছামতি নদীর পাড়ে গাতিপাড়া গ্রামে বিয়ে হয়। বিয়ের পর থেকে কোহিনুর বেগমের আর রানাঘাট এলাকায় যাওয়া হয়নি। তবে বেঁচে থাকা পর্যন্ত তার বাবা-মা মাঝেমধ্যে গাতিপাড়া গ্রামে এসে দেখা করে যেতেন।
বিয়ের পর থেকে কোহিনুর বেগমের কাছে গাতিপাড়া গ্রাম অন্য দেশের গ্রাম বলে মনে হতো না। শ্বশুরবাড়ির পাশেই যে বাড়ি, সেটি ভারতের তেরঘর গ্রামে পড়েছে। তেরঘর গ্রামের মোটামুটি সবার বাড়িতেই যাতায়াত কোহিনুরের। ২০০৮ সালে ১৩ ঘর গ্রাম ও গাতিপাড়া গ্রামের মধ্যে বাঁশের বেড়া দিয়ে সীমানা প্রাচীর স্থাপন করা হয়। বাড়ির সামনে কোহিনুরের শ্বশুর-শাশুড়ির কবর ঘেঁষে সীমানা প্রাচীর তৈরি করা হয়। নারিকেল গাছ, আম গাছ, বেল, কদবেল, বরইসহ পুরাতন গাছের গোড়া ঠিকই গাতিপাড়া গ্রামে। কিন্তু গাছের অর্ধেক ফল পড়ে ভারতের তেরঘর গ্রামে। দুই গ্রামের পুরাতন বাঁশঝাড়ও সীমানা প্রাচীরের কারণে দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেছে। আমবাগানের অনেক গাছের আম পড়ে ভারতের তেরঘর গ্রামে।
চৈত্রের দুপুরে বাড়ির হেঁসেলে বসে কোহিনুর বেগম এমনই কথা জানালেন। হেঁসেলের সামনে দাঁড়িয়ে ওপারে বাঁশের বেড়ার সীমানা প্রাচীর দেখা যায়। ওটাই ভারত। ভারতের তেরঘর গ্রাম। কোহিনুর বলেন, ‘বাঁশের বেড়া দিয়ে সীমানা প্রাচীর দেওয়ার পর থেকে বুকটা দুরুদুরু করতে থাকে। আগে ভাই-বোনরা আসত দেখা করতে। সীমানা প্রাচীর দেওয়ার পর বন্ধ হয়ে গেছে। কত দিন ধরে নিজের ভাই-বোনদের দেখি না। এখন তো আর দেখারও সুযোগ নেই।’
বাড়ির উঠানের সামনে ভারতের সীমানা প্রাচীর : ইছামতী নদীর বাংলাদেশ পাড়ে ভারতের গ্রামটিতে ১৩ টি পরিবার থাকত বলে এটাকে তেরঘর গ্রাম বলা হয়। আগে এই গ্রামের সবারই যাতায়াত ছিল যশোর এলাকায়। নৌকা বেয়ে ইছামতি নদী পেরিয়ে নদীয়া জেলা শহর প্রায় ৬০ কিলোমিটার পথ। এর চেয়ে তারা পুটখালি বাজার ও বেনাপোল বাজারে দৈনিন্দন চাহিদা মেটাতেন। তেরঘর গ্রামের সঙ্গে আত্মীয়তার বন্ধন ছিল। সীমানা প্রাচীর দেওয়ার পর তারা এখন ইছামতি নদী পাড়ি দিয়ে নদীয়া ও বনগাঁতে যাতায়াত করেন। গাতিপাড়ার কামাল উদ্দিন নামে এক বাসিন্দা বলেন, ‘আগে তেরঘর গ্রাম দিয়ে বাংলাদেশে অবাধে শাড়ি, মূল্যবান কাপড়, মসলা, ফেনসিডিল, লবণ, চিনি এমনকি বিস্ফোরক উপাদান পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাচার হত। বছর তেরো আগে বাঁশের বেড়া দিয়ে সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করা হয়। গাতিপাড়া গ্রামে বিজিবির একটি বিওপি স্থাপন করা হয়। এরপর থেকে চোরাচালান বন্ধ হয়ে যায়।’
গত ২৬ মার্চ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে গাতিপাড়া গ্রামে এই প্রতিবেদকের সাথে কথা হয় গ্রামের শান্তা বেগমের সাথে। তার বাড়ির গোসলখানার পাশ দিয়ে বাঁশের বেড়ার সীমানা প্রাচীর। বাড়ির প্রবেশ গেটের ঠিক ৪-৫ হাত সামনেই সীমানা প্রাচীর, যেটির নাম ভারতের তেরঘর গ্রাম।
জানতে চাইলে শান্তা বেগম বলেন, ‘তার স্বামীর নাম অনিক। ৩ বছর হলো তাদের মধ্যে বিয়ে। তার বাবার বাড়ি বেনাপোলে। শুনেছি ১০-১২ বছর আগেই বাড়ির সামনে বাঁশের বেড়া দিয়ে সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করা হয়। আগে গাতিপাড়া ও তেরঘর গ্রামে মাদক কারবারিদের আনাগোনা ছিল। বিজিবির বিওপি স্থাপনের পর চোরাকারবারির আনাগোনা নেই বললেই চলে। এখন আমরা শান্তিতে আছি। বাড়ির উঠানের সামনে আরেকটি দেশের গ্রাম ও তাদের চলাচল, কেমন লাগে? জানতে চাইলে শান্তা বেগম বলেন, ‘আমার শ্বশুর-শাশুড়ির অনেক আত্মীয়-স্বজনদের বাড়ি ইছামতি নদীর ওপারে ভারতের কালিয়ানী গ্রামে। এই বাড়ি বউ হয়ে আসার পর থেকে তাদেরকে কখনই আসতে দেখিনি। তবে শ্বশুর-শাশুড়ির মুখ থেকে তাদের গল্প শুনেছি।’
গাতিপাড়া গ্রামের এক পাশ জুড়ে আমের বাগান। গাছে গাছে গুটি আম ঝুলে আছে। আরেকদিকে বাঁশ ঝাড় যেটি সীমানা প্রাচীর দিয়ে দুই ভাগ করা হয়েছে। এক অংশ পড়েছে বাংলাদেশে, অপরটি ভারতে।
বাগানের আম গাছগুলো দেখিয়ে স্থানীয় বাসিন্দা সয়ের আলী বলেন, ‘বাগানের আম নামানোর সময় কোনো সমস্যা হয় না। ওপারে আম পড়লে, আমরাই গিয়ে নিয়ে আসি। ওরা কোনো ঝামেলা করে না। তবে ইছামতি নদীর ওপারে ভারতের সীমান্ত ঘেঁষে আমার ৩ বিঘা জমি আছে। ওই জমিতে চাষাবাদ করতে পারি না ঝামেলার কারণে। কারণ ইছামতি নদী পার হয়ে চাষাবাদ করা ঝুঁকিপূর্ণ।’ গাতিপাড়া গ্রামের বাঁশের সীমানা প্রাচীরের পাশে ৪-৫ ফুট প্রস্থের কাঁচা রাস্তা। এটা করা হয়েছে বিওপিতে (বর্ডার অবজারভেশন পোস্ট) বিজিবির সদস্যদের যাতায়াতের জন্য। বিজিবির বিওপি ইছামতি নদীর পাড়ে। চৈত্র মাসে ইছামতির প্রস্থের এক চতুর্থাংশ জুড়ে কোমর পানি। কচুরিপানার কারণে নদীর পানি ঠিকমত দেখা যায় না। বিজিবির বিওপি থেকে ইছামতির পাড়ে নামলে বাংলাদেশের সীমান্ত পিলার। বর্ষাকালে থৈথৈ পানিতে সীমান্ত পিলার ডুবে যায়। ইছামতির পানি এসে ঠেকে বিজিবির বিওপিতে। ঠিক ওপারে ভারতেও একই পরিস্থিতি।
তেরঘর গ্রামে অন্তত ১০-১২ টি পাকা বাড়ি। এক বাড়ির খোলা গোসলখানায় কাপড় পরিষ্কার করছিলেন নারীরা। একজন নারীকে দিদি সম্বোধন করে ডাক দেওয়া হল। বললাম, ‘আমরা বাংলাদেশ থেকে এসেছি। কেমন আছেন?’ দিদি বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষের সাথে কথা বলার খবর জানতে পারলে বিএসএফ এসে ঝামেলা করবে।’
বিজিবি’র বিওপিতে উপস্থিত জনসংযোগ কর্মকর্তা শরীফুল ইসলাম জানালেন, নোম্যান্সল্যান্ড অতিক্রম করে বাংলাদেশের কেউ ওপারে যায় না। ওরাও কেউ আসে না।