ভালোবাসার কাছে করোনা পরাজিত
পোস্ট করেছেন: Dinersheshey | প্রকাশিত হয়েছে: জুন ২১, ২০২০ , ৪:৫৯ পূর্বাহ্ণ | বিভাগ: এক্সক্লুসিভ
ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি : ভালোবাসার কাছে যে করোনাভাইরাস কিচ্ছু না, সেটাই আবার প্রমাণ করলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিন ভাই মাসুম, মারুফ ও মোস্তাক। ৭২ বছর বয়সী বাবার শরীরে ধরা পড়া করোনার বিরুদ্ধে প্রায় এক মাসের লড়াই শেষে জয়ী হয়েছেন তারা। বাবা মতি মিয়ার যেদিন করোনা পজিটিভের ফলাফল এল, সেদিন ছিল চাঁদ রাত। ঈদের আগের দিন এমন ফলাফলে তিন সন্তানই মুষড়ে পড়লেন। তবে সেটা কাটিয়েও উঠলেন কিছু সময়ের মধ্যে। শুরু হলো বাবাকে নিয়ে নতুন লড়াই। তবে লড়াইতে শেষ হাসিটা সন্তানদের পক্ষেই এসেছে। এক মাসের বেশি সময় চেষ্টার পর বাবার করোনা পরীক্ষার দ্বিতীয় টেস্টে নেগেটিভ রেজাল্ট পেয়েছেন তারা। রমজান মাসের প্রায় মাঝামাঝি সময়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জের বাসিন্দা ৭২ বছর বয়সী মতি মিয়া জ্বরে আক্রান্ত হন। তিনি যখন জ্বরে পড়েন, এর আগে ওই এলাকার কারও করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া যায়নি। পরিবারের লোকজনও তাই সাধারণ জ্বরই ধরে নিয়েছিলেন। তবে দিন যায় আর মতি মিয়ার শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে। জ্বরের সঙ্গে যোগ হতে থাকে শ্বাসকষ্ট, কাশি বা শরীর ব্যথার মতো উপসর্গ। স্থানীয় হাসপাতাল থেকে তাই বাবাকে ঢাকা নিয়ে আসেন সন্তানেরা। ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে তারা যখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পৌঁছান, শুরুতেই তার অক্সিজেন স্যাচুরেশন চেক করা হয়। অবস্থা তখন এতই খারাপ যে স্যাচুরেশন তখন ৬২–এর ঘরে। সাধারণ অবস্থায় স্যাচুরেশন ৯৫ থাকলে সুস্থ ধরে নেওয়া হয়। সেখানে ৬২ তো ভয়াবহ! দ্রুত মতি মিয়াকে ভর্তি করে করোনা সাসপেক্টেড ইউনিটে পাঠানো হয়। মতি মিয়ার বড় ছেলে ও আইনজীবী মাহফুজুর মাসুম বলেন, ‘এই অবস্থা দেখে ডাক্তাররাও একরকম আশাই ছেড়ে দিয়েছিলেন। তবে সন্তান হিসেবে আমরা শেষ পর্যন্ত লড়াইটা চালিয়ে যেতে চেয়েছি।’ এর মধ্যে হাসপাতালে ভর্তির পর মতি মিয়ার করোনা পরীক্ষা করা হয়। দুই দিন পর ফলাফল আসে পজিটিভ। এরপরও সন্তানদের একবারের জন্য মনে হয়নি বাবাকে একা রেখে চলে যাবে। আর তাই তিন ভাই মিলে বাবাকে সাসপেক্টেড ইউনিট থেকে ট্রান্সফার করে হাসপাতালের করোনা ইউনিটে নিয়ে আসেন। ঈদের দিন থেকে হাসপাতালের ৯০২ নম্বর করোনা ইউনিটের ৪৯ নম্বর বেডে শুরু হলো তিন সন্তানের লড়াই। মতি মিয়ার মেজ ছেলে মোস্তাফিজুর মারুফ গ্রামের বাড়িতেই থাকেন। সেখানেই ব্যবসা করেন। আর ছোট ছেলে মোস্তাক ফুটবল খেলোয়াড়। বর্তমানে খেলছেন বসুন্ধরা কিংসে। মোস্তাক বলেন, ‘আব্বা নিজেও একজন খেলোয়াড় ছিলেন। তাই বয়স হলেও বেশ শক্ত–সমর্থ ছিলেন। সব সময়ই মনে হয়েছে আমাদের করোনা হলে হবে। তবে নিজেদের যা–ই হোক, আব্বাকে সুস্থ করার কাছে সেসব কিছুই না।’ তিন ভাই তাই নিয়ম করে ২৪ ঘণ্টা ডিউটি দিচ্ছেন বাবার পাশে। একজন বাসায় বিশ্রাম করেন, বাকি দুজন থাকেন হাসপাতালের করোনা ইউনিটে বাবার বেডের পাশেই। বাবার কখন খিদে লাগে, কখন অসুস্থবোধ করেন—বিদ্যুৎগতিতে বাবার সেসব প্রয়োজন মেটান এই তিন সন্তান। পাশের বেডের রোগী হিসেবে এসব দৃশ্য আমিও ১০ দিন ধরে নিয়মিত দেখছি। ওষুধের প্রতিক্রিয়ায় মতি মিয়া মাঝেমধ্যে গভীর রাতে অক্সিজেন মাস্ক খুলে ফেলেন। তখন দ্রুত নেমে যেতে থাকে অক্সিজেন লেভেল। মাঝেমধ্যে অসুস্থতার ঘোরে সন্তানদের কিল–ঘুষিও মারেন। তবে সন্তানেরা ২৪ ঘণ্টা পাখির চোখে নজরে রাখেন বাবাকে। দিন যায়, রাত যায়। পাশের বেডে রোগী এসে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যায়। কিন্তু মাসুম-মারুফ-মোস্তাকদের অপেক্ষা ফুরোয় না। অবশেষে বাবার অবস্থা কিছুটা ভালো হলে দিন সাতেক আগে করোনার দ্বিতীয় টেস্ট করান তারা। তিন দিন পর ফলাফল আসে নেগেটিভ। আনন্দ তিন ভাইয়ের মনেই। তবে করোনার আঘাতে মতি মিয়ার এখনো উঠে দাঁড়ানোর মতো অবস্থা হয়নি। হয়তো আরও কিছুদিন থাকতে হবে হাসপাতালের বিছানায়। এখনো দরকার পড়ছে অক্সিজেন। ডাক্তাররাও আশাবাদী মতি মিয়াকে নিয়ে। দ্রুত উন্নতি হচ্ছে তার শরীরের। সন্তানেরা আছেন বাবার পাশে ছায়ার মতো। প্রায় এক মাস হাসপাতালের করোনা ইউনিটে এত রোগীর মধ্যে থাকায় তিন ভাই ধরেই নিয়েছিলেন তারাও হয়তো করোনায় আক্রান্ত হবেন। তাই এরই মধ্যে তিন ভাই করোনার টেস্ট করেছেন, রেজাল্টও হাতে (মুঠোফোনে) চলে এসেছে। তিন ভাইয়েরই ফলাফল নেগেটিভ! বাবার ভালোবাসা যে সন্তানদের সঙ্গে আছে, তাদের তো করোনাভাইরাস ভয় পাবেই।