আজকের দিন তারিখ ২১শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শনিবার, ৬ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সর্বশেষ সংবাদ
এক্সক্লুসিভ যে কারণে লাওসে করোনায় একজনও মরেনি

যে কারণে লাওসে করোনায় একজনও মরেনি


পোস্ট করেছেন: Dinersheshey | প্রকাশিত হয়েছে: জুন ২৭, ২০২০ , ৬:৩৬ পূর্বাহ্ণ | বিভাগ: এক্সক্লুসিভ


দিনের শেষে ডেস্ক : শুধুমাত্র ভালো অভ্যাসের কারণে কোন দেশ যে করোনায় মৃত্যু এড়াতে পারে তার প্রমাণ রাখল দক্ষিণ এশিয়ার ছোট্ট একটি দেশ লাওস। এদেশের মানুষ অভ্যাসগতভাবে অনেক আগে থেকেই মাস্ক ব্যবহার করে। তারা মনে করে একজনের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস কিংবা নিশ্রিত তরল পদার্থের মাধ্যমে অন্যের জন্য অহেতুক বিরক্তির কারণ সৃষ্টি সমীচীন নয়। এ ছাড়া সাধারণত এদেশের মানুষকে কারো সামনে কখনো হাঁচি, কাশি বা সর্দি ফেলতে দেখা যায় না। এ আর কারণেই করোনা ভাইরাস তাদেরকে আক্রমণ করতে পারেনি।

নয়নাভিরাম পাহাড়, সবুজে ঘেরা সমতল ভূমি আর ছোট ছোট নদী পরিবেষ্টিত দক্ষিণ এশিয়ার ছোট্ট  দেশ লাওস। সারাবিশ্ব যখন করোনা মহামারি মোকাবিলায় ব্যতিব্যস্ত ঠিক তখন লাওস সফলভাবে এ পর্যন্ত মৃত্যু এড়াতে পেরেছে; অথচ সম্পূর্ণ স্থলবেষ্টিত এই দেশটির চারপাশে রয়েছে থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, চীন, ভিয়েতনাম আর কম্বোডিয়ার মতো রাষ্ট্রগুলো। লাওস দেশটি একদলীয় শাসনভিত্তিক সমাজতন্ত্র প্রভাবিত দেশ। লাওসের একমাত্র রাজনৈতিক দল লাও পিপলস  রেভ্যুলুশন পার্টি (এলপিআরপি) মার্ক্সিজম ও লেনিনিজম তত্ত্বে বিশ্বাসী। এই দেশটির সঙ্গে চীনের বেশ ভালো সম্পর্ক ও  যোগাযোগ রয়েছে। কিন্তু করোনার প্রশ্নে এই দেশের এ পর্যন্ত সফলতার কারণ কি শুধু রাষ্ট্রীয় সু-ব্যবস্থাপনার প্রভাব আর চীনের সহযোগিতা নাকি সাধারণ জনগণেরও এই সাফল্যের  পেছনে বড় ভূমিকা রয়েছে? এমনকি, এদেশের মানুষ এতটাই সচেতন যে কখনোই কাউকে রাস্তায় থু থু ফেলতে দেখা যায় না।
লাওসের মানুষ অর্গানিক খাবার গ্রহণ আর নিয়ন্ত্রিত জীবন ব্যবস্থায় অভ্যস্ত। তারা থানকুনি পাতা, পুদিনা পাতা, লেবু পাতাসহ বিভিন্ন প্রকার ভেষজ খাবার গ্রহণ করে থাকে। ব্যাপারটা এমন- এই ধরনের জীবন ব্যবস্থায় তারা অনেক আগে থেকেই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। এই দেশে গণপরিবহন ব্যবস্থা প্রায় নেই বললেই চলে। গণপরিবহনগুলোতে যাত্রী খুব কম দেখা যায়। এখানকার অধিকাংশ মানুষই সাইকেল,  মোটরসাইকেল কিংবা যাদের সামর্থ্য আছে তারা ব্যক্তিগত মোটরগাড়ি নিয়ে চলাচল করে। তাই এক ব্যক্তির সঙ্গে অন্য ব্যক্তির সরাসরি সংমিশ্রণের সম্ভাবনা অনেকটা কম থাকে। লাওসের মানুষ সবসময় পরিপাটি ভাবে জীবনযাপন করতে পছন্দ করে। উচ্চ কিংবা নিম্ন যে  পেশায়ই থাকুক না কেন, এদেশের মানুষ একদিন পরিধান করা পোশাক পরবর্তীতে আবার  ধৌত না করে পরিধান করে না। এমনকি এই অভ্যাসটি বিভিন্ন আবাসিক এলাকায় গৃহ পরিচারিকা হিসেবে কর্মরত  মেয়েদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। প্রতিদিন কাজে আসার সময় তারা পরিষ্কার, ইস্ত্রি করা কাপড় পরে। তারা যে যেই পেশায়ই থাকুক না কেন প্রতি শনিবার এদেশের মানুষ নিজেদের কাপড়- চোপড় ধৌত করে রোদে শুকাতে  দেয়। এই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রমে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা  থেকে শুরু করে নিম্ন পদবির কর্মকর্তা-কর্মচারীগণও নিজ নিজ এলাকায় যোগদান করে। এই দেশের মানুষ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে এতটাই সচেতন যে, অফিসে প্রবেশ করার পর কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ প্রত্যেকেই নিজেদের পরিহিত জুতা পরিষ্কার করেন, যাতে জুতায় ধুলাবালি না থাকে এবং অনেকটা চকচকে দেখায়। অফিসে প্রবেশের পর মহিলা কর্মকর্তা-কর্মচারীরা প্রাথমিক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার পর লিপস্টিকসহ সামান্য মেকআপ করে তারপর কাজকর্ম শুরু করেন। এইভাবে পরিপাটি ও সুন্দরভাবে নিজেদের উপস্থাপন করার অভ্যাস গড়ে ওঠায় অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মনোবল সবসময় চাঙ্গা থাকে। বর্তমানে করোনার কারণে অফিসে প্রবেশের পূর্বেই প্রয়োজনীয় জীবাণুনাশক ব্যবহার করে অফিস কক্ষ জীবাণুমুক্ত করা হচ্ছে। সাধারণ মানুষের ব্যক্তিগত অভ্যাস ছাড়াও লাওস দেশটি সম্পর্কে কয়েকটি তথ্য এখানে উল্লেখ না করলেই নয়। এই  দেশটি বিশ্বের সবচেয়ে কম কার্বন নির্গমনকারী দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। যান্ত্রিকতামুক্ত জীবনধারা, গাছপালা সংরক্ষণে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া আর সাধারণ মানুষ অর্গানিক দ্রব্য ব্যবহারে অভ্যস্ত হওয়াই এর বড় কারণ বলে অনুমেয়। তথাপি এই  দেশের মানুষের মাথাপিছু বাৎসরিক আয় ১৯৫০ ডলার, যা বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয়ের চেয়ে বেশি। তবে এটা ঠিক ২ লাখ ১৮ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই  দেশটিতে মাত্র ৭০-৮০ লাখ  লোকের বসবাস, অথচ ১ লাখ ৪৭ হাজার বর্গ কিলোমিটারের বাংলাদেশে প্রায় ১৭ কোটি মানুষের বসবাস। বাংলাদেশের জন্য বিষয়গুলো অত সহজ নয়। লাওস দেশটির জিডিপি (পিপিপি) দক্ষিণ এশিয়ার  দেশগুলোর মধ্যে চতুর্থ, অর্থাৎ সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া আর থাইল্যান্ডের পরেই এর অবস্থান। এই দেশ নিজেদের বনভূমি থেকে উৎপাদিত কাঠ আর বিভিন্ন প্রকার অর্গানিক দ্রব্যসামগ্রী রপ্তানি করে  বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে থাকে। আবহাওয়ার দিক থেকে লাওসের সঙ্গে বাংলাদেশের যথেষ্ট মিল রয়েছে। তবে দিনের বেলায় বেশ গরম পড়লেও রাতের বেলায় পাহাড় আর বিপুল বনভূমিবেষ্টিত লাওসের আবহাওয়া বাংলাদেশের তুলনায় ঠাণ্ডা থাকে।

এবার আসা যাক লাওস সরকারের করোনা সংশ্লিষ্ট প্রস্তুতির কথায়। এই দেশে এ পর্যন্ত করোনায় কেউ মৃত্যুবরণ না করলেও শুরু থেকেই আন্তর্জাতিক সীমান্ত ও বন্দরসমূহে সতর্ক ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করা হয়েছিলো। এ ছাড়া, অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন বিষয় সমূহে ব্যাপক পূর্ব প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছিলো। এই দেশ কোনো প্রকার লকডাউনে যায়নি। তবে কিছু কিছু নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। যেমন, ৫০ জনের অধিক কোনো সমাবেশ করা যাবে না, বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা বন্ধ থাকবে ইত্যাদি।  রেস্টুরেন্টগুলো খোলা রাখার আদেশ থাকলেও নাইট ক্লাবগুলো বন্ধ রাখার আদেশ রয়েছে। অবশ্য সাধারণ মানুষের চাহিদার কথা চিন্তা করে কিছু কিছু নাইট ক্লাব চালু রয়েছে। ব্যবসায়িক প্রয়োজনে এই দেশে কেউ আসতে চাইলে, তাকে সরকার কর্তৃক নির্দিষ্ট কিছু হোটেলে থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ঐ ব্যক্তি লাওসে পৌঁছানোর পর নির্দিষ্ট হোটেলে ১৪ দিন কোয়ারেন্টিনে থাকবেন।  কোয়ারেন্টিনে থাকা অবস্থায় তার খাবার ও অন্যান্য সামগ্রী তার রুমে পৌঁছে দেয়া হবে। কিন্তু সরকার কর্তৃক নির্ধারিত হোটেলগুলো উচ্চমানের হওয়ায় সার্বিক ব্যয় বেশি হয়ে থাকে। তবে সার্বিক ব্যয় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকেই বহন করতে হয়। ফলশ্রুতিতে একেবারে জরুরি  কোনো প্রয়োজন না হলে শুধুমাত্র চিত্তবিনোদনের জন্য দেশটিতে বর্তমানে করোনা পরিস্থিতিতে ভ্রমণ প্রকারান্তরে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। চীনের সঙ্গে লাওসের সম্পর্ক অত্যন্ত বন্ধুত্বপূর্ণ ও মধুর। করোনাভাইরাস সম্পর্কে নিজেদের অভিজ্ঞতার আলোকে চীন থেকে লাওসে একটি টাস্কফোর্স পাঠানো হয়েছে বেশ আগেই। ঐ টাস্কফোর্স লাওস সরকারকে করোনা সংক্রান্ত বিষয়ে ক্রমাগত পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে।