রেন্টাইনে ‘কিং লিয়ার’ লিখেছিলেন শেক্সপিয়ার?
পোস্ট করেছেন: dinersheshey | প্রকাশিত হয়েছে: এপ্রিল ১, ২০২০ , ৬:৫৫ পূর্বাহ্ণ | বিভাগ: সাহিত্য কথা
মহাকবি ও নাট্যকার উইলিয়াম শেক্সপিয়রের সময়ও কিন্তু প্লেগ বা মহামারির সংক্রমণ হয়েছিল। সেই সময় কোয়ারেন্টাইনের নির্জনবাসের সময়েই কি তিনি তার সময়ের সদ্ব্যবহার করে লিখেছিলেন ‘কিং লিয়ার?’ মড়কের সংক্রমণ এড়াতে একাকি সবার সঙ্গ বাঁচিয়ে দিন যাপনের সময়েই কি এই নিরানন্দ, মরীয়া নাটকের রচনা করেন তিনি? যখন কিনা আমাদের এই করোনার সময়ে স্বেচ্ছা-অন্তরীণ অবস্থা মেনে নিতে হচ্ছে আর বাসা থেকেই অফিসের কাজ করতে হচ্ছে, সময় কাটাতে হচ্ছে টিকটক ভিডিও দেখে, লাইভ ব্লগগুলো সতেজ করতে হচ্ছে, তখন একটি কৌতুক ঘুরতে দেখা যাচ্ছে সেই সময়ে এই দাবি তোলা হয়েছে, শেক্সপিয়ার প্লেগ বা মহামারির কারণে নির্জনবাস বা স্বেচ্ছা-অন্তরীণ থাকার সময়ে ‘কিং লিয়ার’ রচনা করেছেন। ইংরেজি ভাষার এই মহাকবি সম্ভবত প্লেগের কারণে তিনি যে থিয়েটার কোম্পানিতে কাজ করতেন সেই ‘গ্লোব’ কোম্পানি দীর্ঘদিনের জন্য ছুটি হবার সময়টি ভালোই কাজে লাগিয়েছেন। ‘ম্যাকবেথ’ এবং ‘অ্যান্টনি ও ক্লিওপেট্রা’ শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে সমাপ্ত করছেন ‘কিং লিয়ার’-ও। আজ করোনার এই সময়ে ঘরে বসে বসে আপনার যদি মনে হয় যে কাজকর্ম কিছুই হচ্ছে না, তবে শেক্সপিয়রের জীবনের এই ঘটনাটি জানলে আপনার হতাশা কেটে যাবে। যে উপন্যাস বা চিত্রনাট্যটি এতদিন লেখেননি, সেটার ধুলো কেন ঝাড়ছেন না? আপনার জায়গায় মহাকবি থাকলে তিনি তো নিশ্চিত তাই করতেন।
এখন নিশ্চিত প্রশ্ন করবেন যে, শেক্সপিয়ার মড়কের সময়েই ‘কিং লিয়ার’ লিখেছিলেন, এই দাবিটা সত্য কিনা? এটা তো নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে, সেই সময়ে, অন্যসব এলিজাবেথীয় পর্বের নারীদের মতই, মহান এই নাট্যকারের কর্মজীবন বা ক্যারিয়ারও মড়কে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। শেক্সপিয়রের জীবদ্দশায় যে মড়কটি হয়েছিল তাকে বলা হত ‘ব্যুবোনিক প্লেগ’ বা যে মড়কে কিনা মানবদেহের বিভিন্ন গ্রন্থি ফুলে যেত। আজকের এই কোভিড-১৯-এর সময়ে তখনকার মড়কের চেহারাটি ঠিক কেমন ছিল তা আমাদের পক্ষে কল্পনা করাও কঠিন। যতদূর জানা যায়, শেক্সপিয়রের জন্মের পরপরই বৃটেনে একবার মহামারি দেখা দিয়েছিল। তবে শিশু শেক্সপিয়ার সেই মড়কে বেঁচে যান। হ্যাঁ, ১৫৬৪ সালের গ্রীষ্মকালে তার জন্মস্থান স্ট্রাটফোর্ড-আপন-আভনে এক ভয়াবহ মহামারির প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। বড় হয়ে কেয়ামতের সমান সেই মহামারির গল্প শেক্সপিয়র অনেক শুনেছেন ও চার্চে মড়কের সময়ে নিহত নগরবাসীর পূণ্য আত্মার স্মরণে তাকেও নতজানু হতে হয়েছে। তার বাবা জন শেক্সপিয়রও নাকি মড়কের সময়ে ত্রাণ সাহায্য বিলানোর কাজে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন এবং স্ট্রাটফোর্ডের দরিদ্রতম মানুষদের সাহায্য করার জন্য একটি বৈঠকেও অংশ নিয়েছিলেন। বৈঠকটি উন্মুক্ত স্থানেই করা হয়। প্রাপ্তবয়স্ক শেক্সপিয়র পরে যতদিনে লন্ডনে এক নাটকের কোম্পানিতে একজন পেশাদার অভিনেতা, নাট্য রচিয়তা ও লভ্যাংশের অংশীদার বা থিয়েটারের শেয়ার-হোল্ডারও হয়ে উঠেছেন, তখন প্লেগ বা মহামারি আবার তাকে পেশাগত ও অস্তিত্বগত হুমকির মুখোমুখি করে। এলিজাবেথীয় যুগের ডাক্তারদের সেসময় কোনো ধারণাও ছিল না যে, এক ধরনের নীল মাছি থেকে মড়ক ছড়ায়। যাহোক, সেই গ্রীষ্মে যখন মড়ক শুরু হলো এবং ছড়িয়ে পড়লো—আবার সাধারণত বসন্ত বা গ্রীষ্মের সময়টিই থিয়েটারের তুঙ্গ মৌসুমও বটে—কর্তৃপক্ষ বাধ্য হলেন গণসমাবেশ নিষিদ্ধ করতে। যেহেতু সেসময়কার রক্ষণশীল সমাজ থিয়েটারের বিষয়ে স্বাভাবিকভাবেই সন্দেহপরায়ণ ছিল, কারণ থিয়েটারকে মনে করা হত ব্যভিচারের আখড়া, যেখানে অভিনেতারা মেয়েদের পোশাক পরে এবং ঈশ্বরই জানেন আরও কত না দুর্নীতি হয় সেখানে, নাট্যশালাগুলোই বন্ধ করা হলো সবার আগে। বন্ধ করা হলো গণিকালয় এবং পানশালা ও জুয়া খেলার জায়গাগুলোও। অনেক সময় থিয়েটারের মালিকরা বাড়তি আয়ের আশায় গণিকালয়, পানশালা ও জুয়া চালু রাখতেন। সেসময় ধর্মপ্রচারকরা দিব্যি এমন কথা বলে বেড়াতেন যে ‘পাপের কারণেই মড়ক হয় আর নাটক-থিয়েটারই সমাজে পাপ সৃষ্টি করে।’ ১৬০৩ থেকে ১৬১৩ সাল নাগাদ শেক্সপিয়রের লেখক বা নাট্যকার হিসেবে ক্ষমতা যখন তুঙ্গস্পর্শী, তখন গ্লোব ও লন্ডনের অন্যান্য নাট্যশালাগুলো মোট ৭৮ মাসের জন্য বন্ধ করা হয় যেটা শেক্সপিয়রের গোটা সক্রিয় লেখক জীবনের ৬০ শতাংশ সময়েরও বেশি। দীর্ঘ এই মড়কের সময়টা নানাভাবেই থিয়েটারের জন্য ‘কালো পর্ব’ ছিল। অভিনেতারা বাধ্য হয়েছেন অন্যত্র কাজ করতে এবং তাদের ভেতর অনেকেই মারা গেছেন (সাধারণত ১০ থেকে মধ্য-ত্রিশের মানুষেরা বিশেষ ঝুঁকিতে ছিলেন)। নাটকের কোম্পানিগুলো সব ভেঙে গেল এবং তারা বাধ্য হলো মফস্বল এলাকাগুলোয় ঘুরে বেড়াতে। হয়তো মফস্বল অব্দি মড়কের খবর পৌঁছায়নি, কাজেই মফস্বলে গিয়ে নাটক দেখিয়ে খানিকটা রোজগার করা যাবে বলেই থিয়েটার কোম্পানিগুলো মড়কের সময়ে লন্ডনের চেয়ে ছোট মফস্বল শহরে বেশি ঘুরতো। শেক্সপিয়রের অন্তত একজন জীবনীকার এটা দেখিয়েছেন যে, বড় শহরগুলোয় থিয়েটার বন্ধের ফলে একটি কৌতূহলোদ্দীপক ঘটনা ঘটে : এলিজাবেথীয় যুগের থিয়েটার দর্শকেরা নাটক দেখার সময় কাঠবাদাম খেতে ভালোবাসতেন যেটা মফস্বলে মড়ক বিস্তারকারী মাছির সংক্রমণ এড়াতে সহায়ক হয়েছিল। এখন তাহলে প্রশ্নটি হচ্ছে, শেক্সপিয়র এই মড়কের সময়েই ‘কিং লিয়ার’ লিখেছেন কিনা? দাবিটি আদৌ অসম্ভব নয় : আমরা জানি যে, ১৬০৬ সালে বক্সিং দিবসে নৃপতি জেমস প্রথমের সামনেই ‘কিং লিয়ার’ প্রথম মঞ্চস্থ হয়। কাজেই অনুমান করা যেতেই পারে যে, নাটকটি সে বছর বা এমনকি এক বছর আগেও রচিত হতে পারে। থিয়েটার বিষয়ক ইতিহাসবিদ জেমস শাপিরো দেখান যে, ১৬০৬ সালে লন্ডনে গ্রীষ্মে একটি বড় আকারের মহামারি ছড়িয়ে পড়ে যার ফলে ‘গ্লোব’সহ লন্ডনের নাটক কোম্পানিগুলো তাদের থিয়েটার বন্ধ করে দেয়। তবে সেবারের মড়ক আরও তিন বছর আগের মড়কের মতো ভয়াবহ ছিল না, যখন লন্ডনের এক-দশমাংশের বেশি মানুষ মারা গিয়েছিল। তবে ১৬০৬ সালের মড়ক গোটা গ্রীষ্মকাল ও শরতের শুরু পর্যন্ত প্রচণ্ডভাবেই ছিল এবং শেক্সপিয়র লন্ডনের যেখানে থাকতেন, সেই এলাকাটি বিশেষভাবেই মড়কে আক্রান্ত হয়েছিল। এমনকি নাট্যকারের নিজের বাসাই সংক্রমিত হয়েছিল যেহেতু তার বাড়িওয়ালী মেরি মাউন্টজয় মড়কে মারা যান। আর আমরা যখন জানতে পাই, মড়কের সময়েই যে শেক্সপিয়র ‘কিং লিয়ার’ লিখেছিলেন, তখন সম্ভবত, মহান এই নাট্যকারের লেখা বিষণ্নতম ট্র্যাজেডি এই রাজকাহিনিতে মড়কের প্রতিধ্বনি শুনতে কোনো বেগ পেতে হয় না। গোটা ‘কিং লিয়ার’ নাটকের মূল সুর বা ভাবটি দেখুন কেমন ভয়ানক—পরিত্যক্ত সব রাস্তা আর বন্ধ হয়ে যাওয়া দোকানপাট, কুকুরগুলো দৌড়ে বেড়াচ্ছে, নগর পরিষেবা দানকারীরা তিন ফুট লম্বা বোর্ড লাল রঙে এঁকে, সঙ্গে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে যাতে করে সবাই দূরত্ব রাখে, গির্জায় নিরন্তর ঘণ্টাধ্বনি বেজেই যাচ্ছে শোককৃত্যের আহ্বানে—‘কিং লিয়ার’-এর অসম্ভব ধূসর ও বিরাণ খাঁ-খাঁ নাট্যভূমি যেন সেই মড়কের সময়েরই প্রতিচ্ছবি। এই নাটকের গোটা টেক্সটই যেন মৃত্যু, বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্য ও হতাশার নানা চিত্রকল্পে পরিপূর্ণ, যেন সবাই বোধ করতে পারে হাড়ে কাঁটা দেয়া হিম অনুভূতি। নাটকের একটি জায়গায় গ্লুচেস্টার যেমন বিষণ্ন মুখে বলছে : ‘প্রেম শীতল হয়ে আসে, বন্ধুত্বের পতন হয়, ভাইয়েরা বিভক্ত হয়; প্রাসাদে ষড়যন্ত্র; এবং পিতা ও পুত্রের মাঝেও বন্ধনে ফাটল ধরে…আমরা দেখেছি আমাদের শ্রেষ্ঠ সময়।’ আমরা অবশ্য নিশ্চিত করে বলতে পারি না যে ‘কিং লিয়ার’ মড়ক নিয়েই রচনা—ঠিক যতটা প্রত্যক্ষভাবে বেন জনসনের ‘দ্য আলকেমিস্ট’ বা থমাস ডেক্কেরের কৌতুকোদ্দীপক সংবাদধর্মী প্রচারপত্র ‘দ্য ওয়ান্ডারফুল ইয়ার’ ১৬০৩ সালের ভয়ানক সব ঘটনাক্রমকে প্রচার করেছে, ‘কিং লিয়ার’ তত প্রত্যক্ষভাবে মড়কের কাহিনিকে উপস্থাপন করে না। তবে মড়কের খাঁ-খাঁ সময়ের এক সূক্ষ্ম উপস্থিতি গোটা নাটকেই টের পাওয়া যায়। শুধু যে, শেক্সপিয়রের নাটকেই মহামারির ভয়ানক দৃশ্য আঁকা হয়েছে তা নয়। তার সমসাময়িক অন্যান্য লেখক ও নাট্যকারদের রচনাতেও মড়ক এক বাস্তবতা। আবার শুধু ‘কিং লিয়ারে’ই নয়, শেক্সপিয়রের আরও কিছু নাটকেও প্লেগের বিবরণ পাওয়া যায়। যেন তার একাধিক নাটকে মড়ক ফ্রেমের বা চালচিত্রের প্রান্ত হয়ে আসে—তা যতটা দেখা যায়, তারচেয়ে বেশি অনুভব করা যায়। কখনো কখনো মড়ককে শেক্সপিয়র প্লটের বিবরণে একটি কৌশল হিসেবেও ব্যবহার করেছেন। যেমন, ‘রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট’-এ ফ্রায়ার লরেন্স দ্বারা প্রেরিত বার্তাবাহক মড়কে অসুস্থ হয়ে পড়েন। ফলে এই বার্তাবাহক নির্জনবাস অবলম্বনে বাধ্য হন। কাজেই বার্তাবাহকের কাছে যে চিঠিতে বলা হয়েছিল যে জুলিয়েট আসলে মারা যায়নি, সেই খবর রোমিওর কাছে আর পৌঁছায় না। এর আগেই নাটকের শুরুতে ‘তৃতীয় অঙ্কে’ মার্ক্যুশিওর সংলাপ দেখুন : ‘তোমাদের দু’জনের গৃহেই এক মড়ক দেখা দিয়েছে!’ এমন সংলাপে ‘মড়ক’ বলতে ‘প্রেম’ বুঝে দর্শকদের মধ্যে মৃদু হাসি দেখা দিলেও নাটকে সেসময়ের এক মড়ক বা দুর্যোগ গুটি বসন্তের কথাও বলা হতে পারে। কিন্তু ১৬০৩ সালের সেই আতঙ্কজনক মহামারির পর যখন কিনা রাজা জেমস প্রথমের রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠানও পিছিয়ে দেয়া হলো, শেক্সপিয়রের নাটকগুলোয় রোগের নানা অনুষঙ্গ ব্যবহৃত হতেই থাকে। তার অপেক্ষাকৃত কম মঞ্চায়িত নাটক ‘টিমোন অফ এথেন্স’-এ টিমোন এক স্বেচ্ছা-নির্বাসিত ব্যক্তি হয়ে ওঠেন যেখানে তার ঠোঁটে এমন সংলাপও উচ্চারিত হয় : ‘মড়ক…তোমার সবল, সংক্রামক জ্বর স্তুপীকৃত হচ্ছে/এথেন্সের ওপর!’ ‘মড়কের মুকুটে সজ্জিত’…‘তাদের কাছে ফিরিয়ে দাও মহামারি/যদি আমি তাদের জন্য এটা ধরতে পারতাম’ ইত্যাদি নানা সংলাপ লক্ষ্য করা যায়। আবার শেক্সপিয়রের আর একটি নাটক ‘মেজার ফর মেজার’-এ লক্ষ্য করা যায় কীভাবে নাট্যকার তার সময়ের লন্ডন নগরীকে বর্ণনা করছেন যেখানে গণিকালয় ও পানশালাগুলো এক স্বেচ্ছাচারী সরকারের সিদ্ধান্তেই বুঝি হুট করে বন্ধ হয়ে গেল। এমনটা তখন প্রায়ই হতো। ম্যাকবেথ, ১৬০৬ সালের মড়কের সময়েই রচিত বলে অনুমান করা হয়, এক সংক্ষিপ্ত কিন্ত জটিল বক্তব্য দিয়ে মোড়া যেটা বহু দর্শকের মনেই ভীতির সঞ্চার করে থাকবে : ‘মরণোন্মুখের আর্ত গোঙানি/কোথাও কি জিজ্ঞাসা করা হয়েছে যে কে এবং যত ভালো মানুষের জীবন/তাদের টুপির ফুল ঝরে পড়ার আগেই নির্বাপিত/হয় মরছে অথবা অসুস্থ বড়।’ শাপিরোর মতে, ‘যদিও চার পঙক্তির বেশি নয়, তবু এটুকুতেই মড়কের ভীতি ও দূর্বিপাকের এর চেয়ে ভালো বিবরণ আর হয় না।’ আর ‘কিং লিয়ার’ তো আরও বেশি প্রত্যক্ষ। লিয়ারের ডান হাত যে অনুচর কেন্ট, সে ভৃত্য অসওয়াল্ডকে চেঁচিয়ে বলছে, ‘তোমার ফেনা গাঁজানো মুখে মড়কের সংক্রমণ!’ লিয়ার আরো বলছেন ‘মড়ক যা ঝুলছে দোদুল্যমান বাতাসে’ আর এভাবেই মড়ক বায়ুবাহিত রোগ এই মুখে মুখে প্রচারিত তত্ত্বটি বলা হচ্ছে নাটকে। নাটকের নানা জায়গায় লিয়ারের মুখের দীর্ঘ বক্তব্যগুলোর একটিতে রাজা কন্যা গনেরিলকে এই বলে ডাকছেন, ‘যেন একটি মড়কের ক্ষত, যেন বা সূচিছিদ্র শোভিত বিষ্ফোটক/জেগে আছে আমার দূষিত রক্তে’—সেই সময়ের মড়কে মানবদেহের লিম্ফনোড বা লসিকা গ্রন্থি ফুলে ওঠার কথা এসেছে এই সংলাপে। তবে এতকিছুর পরও মড়ক শেক্সপিয়রের জন্য ভালো কিছু ছিলো কিনা সেটা বলা কঠিন। দুটো নাট্যশালা ও একটি থিয়েটার কোম্পানির শেয়ার হোল্ডার হয়ে আজ এই ২০২০ সালের যে কোনো ওয়েস্ট এন্ড প্রযোজকের মতই থিয়েটার বন্ধের বিপর্যয়ে তারও কাতর হবারই কথা ছিল। আবার মড়কে মঞ্চায়ণ বন্ধ থাকলে নতুন নতুন নাটকের পাণ্ডুলিপি লিখেই বা তার কী লাভ? আর একটি বিষয় হলো যে, আমরা জানি তিনি কী আন্তরিকভাবে তার অভিনেতাদের সঙ্গে কাজ করতেন এবং থিয়েটার ভবনে বসেও অনেক সময় নাটক লিখেছেন। যেহেতু ব্যস্ত অভিনেতা-নাট্যকার-ম্যানেজার হিসেবে তাকে একসাথে ১৭ ধরনের কাজ করতে হতো— কাজেই দীর্ঘ অন্তরীণাবস্থা তার জন্যও খুব কি ভালো ছিল? এছাড়া লন্ডন শহরেই যেহেতু তাকে থাকতে হয়েছে, কাজেই মড়ক তাকে খুব স্বস্তি দিয়েছে কি? দিতে পেরেছে? সিলভার স্ট্রিটে যেখানে তার বাড়ি ছিল, তার বাড়ির মুখোমুখি ছিল একটি চার্চ যেখানে মড়কের রোগিদের জন্য নিরন্তর ঘণ্টা বাজতো, কোনো ছাড় নেই। আরও একটি লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, ১৫৯২ সালের জুনে যখন আরও একটি প্রবল মড়ক দেখা দিয়েছিল তখন থিয়েটারগুলো প্রায় ছয় মাস বন্ধ থাকে। শেক্সপিয়র এসময় ঝুঁকে যান কবিতায় : তার দীর্ঘ কবিতা ‘ভেনাস ও অ্যাডোনিস’ বা ‘দ্য রেপ অফ লুক্রেশে’ দুটাই এসময় রচিত হয়েছিল, কারণ তরুণ কবির দরকার ছিল কিছু আয়ের ব্যবস্থা করা। প্রেক্ষাগৃহগুলো সারাটা সময় বন্ধ থাকলে শেষপর্যন্ত তার ‘কিং লিয়ার’ অথবা ‘রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট,’ ‘হ্যামলেট,’ ‘ম্যাকবেথ,’ ‘অ্যান্টনি অ্যান্ড ক্লিওপেট্রা’ অথবা তার অন্য কোনো সেরা কাজই আত্মপ্রকাশ করতে পারত না।
সূত্র : দ্য গার্ডিয়ান