আজকের দিন তারিখ ২৫শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, সোমবার, ১০ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সর্বশেষ সংবাদ
অর্থ ও বাণিজ্য সঙ্কটে দেশের ব্যাংক খাত

সঙ্কটে দেশের ব্যাংক খাত


পোস্ট করেছেন: dinersheshey | প্রকাশিত হয়েছে: জুন ২৪, ২০২০ , ৫:৩৭ পূর্বাহ্ণ | বিভাগ: অর্থ ও বাণিজ্য


দিনের শেষে প্রতিবেদক :  করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে বিশ্ব অর্থনীতির পাশাপাশি দেশীয় অর্থনীতিও থমকে দাঁড়িয়েছে। অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি ব্যাংকিং খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিতে পড়েছে। তার উপর ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যাংকখাতকে অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালন করতে হচ্ছে।

এতে একদিকে ব্যাংকগুলোকে ঋণ বিতরণের চাপ থাকলেও আদায় হচ্ছে না। ফলে কমে গেছে ব্যাংকের আয়। এছাড়া, খেলাপি ঋণ, তারল্য সংকট, মুনাফা কমে যাওয়াসহ নানা ধরনের সংকটে পড়েছে দেশের ব্যাংকখাত।

এমন কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও আগামী অর্থবছরের বাজেটের বিশাল অঙ্কের ঘাটতি পূরণে ৮৫ হাজার কোটি টাকা ব্যাংক ঋণের লক্ষ্যমাত্রা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। এর আগেই মানুষের জীবন ও জীবিকা বাঁচাতে এক লাখ কোটি টাকারও বেশি প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ব্যাংক খাতকে।

ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনা ভাইরাসে সৃষ্ট বৈশ্বিক মহামারিতে দেশের আমদানি-রপ্তানি কমে গেছে। তাছাড়া সরকার ব্যাংকগুলোতে সুদের হার ৯ শতাংশে নির্ধারণ করেছে চলতি বছরের এপ্রিল থেকে। আমদানি-রপ্তানি হ্রাস ও সুদহার কমায় ব্যাংকগুলোর আয়ও কমে যাচ্ছে। এদিকে ব্যবসায়ীদের করোনাকালের ক্ষতি কমানোর জন্য ব্যাংকগুলোকে দুই মাসের সুদ আয় স্থগিত করতে বলা হয়েছে। এবিবি’র হিসাব অনুযায়ী, দুই মাসের সুদ স্থগিত থাকলে ব্যাংক খাতের প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা আয় কমে যাবে।

একইসঙ্গে ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করলেও সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গ্রাহকদের খেলাপি না করার নির্দেশনা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে সরকার আগের চেয়ে ব্যাংক থেকে বেশি ঋণ নিচ্ছে। ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা এক দফা বাড়ানো হয়েছিল। করোনা পরিস্থিতিতে সেই লক্ষ্যও ছাড়িয়ে গেছে। এছাড়া, ব্যাংকে এখন নতুন আমানত একবারেই জমা হচ্ছে না। এতে তারল্য সংকটের আশঙ্কা থাকলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি ছাড়ে তা কিছুটা কমেছে।

এদিকে, করোনা সংক্রমণরোধে ঘোষিত সাধারণ ছুটির কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য, কারখানা, উৎপাদন সব বন্ধ ছিল। তাদের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সরকার ১৯টি প্যাকেজের আওতায় এক লাখ তিন হাজার ১১৭ কোটি টাকা প্রণোদনা ঘোষণা করেছে। এই টাকার সিংহভাগ ঋণ হিসেবে দেবে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। এর মধ্যে সরকার যদি ব্যাংকখাত থেকে বেশি পরিমাণে ঋণ নেয় তাহলে বেসরকারি খাত চাহিদামাফিক ঋণ পাবে না। বেসরকারি খাত ঋণ না পেলে বিনিয়োগ বাড়বে না। বিনিয়োগ না বাড়লে কর্মসংস্থান হবে না। ফলে করোনার কারণে যেসব মানুষ কাজ হারিয়েছেন তারা কাজের সুযোগ পাবেন না। আবার প্রণোদনার অর্থ দেয়া না হলে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার সম্ভব হবে না। ব্যাংকগুলোর পক্ষ থেকে রাষ্ট্রের কাছ থেকে ঋণঝুঁকি গ্যারান্টি স্কিম করার কথা বলা হয়েছে; যদিও সে ব্যাপারে এখনো পরিষ্কার কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি সরকারের পক্ষ থেকে। ব্যাংকারদের মতে, যদি সরকারের এই প্রণোদনা মেটাতে গিয়ে ব্যাংকের ঋণখেলাপি হয়ে যায় তাহলে তার দায় ব্যাংক কিভাবে নেবে।

জানা গেছে, যে কোনো ব্যাংকের আয়ের প্রধান উৎস হলো বিতরণকৃত ঋণ থেকে প্রাপ্ত সুদ। এর বাইরে বিভিন্ন ধরনের ফি আর এলসি কমিশন থেকেও বড় অংকের আয় করে থাকে ব্যাংকগুলো। কভিড-১৯ পরিস্থিতিতে ব্যাংকগুলোর আয়ের এ দুটি উৎসই প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছে। একই সঙ্গে স্থগিত করা হয়েছে এপ্রিল ও মে মাসের ঋণের সুদও। এ অবস্থায় ব্যবসা-বাণিজ্য সচল আছে, এমন সামর্থ্যবান গ্রাহকরাও ব্যাংকঋণের কিস্তি পরিশোধ বন্ধ রেখেছেন। আমদানি-রপ্তানিসহ দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা নেমে আসায় ব্যাংকের কমিশন আয়ও নেমে এসেছে এক-তৃতীয়াংশে। এ অবস্থা দেশের প্রায় সব ব্যাংকের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এ পরিস্থিতিতে টিকে থাকতে ব্যাংকগুলো, বিশেষত বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলো এখন ব্যয় সংকোচনেই জোর দিচ্ছে সবচেয়ে বেশি। এরই অংশ হিসেবে কয়েকটি বেসরকারি খাতের ব্যাংক বাধ্য হয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন কমিয়ে দিয়েছে। যদিও বেশিরভাগ ব্যাংক তা করেনি।

সব মিলিয়ে বিশাল বোঝার চাপ সৃষ্টি হয়েছে ব্যাংক খাতের ওপর। ভার বহন করার সক্ষমতা ব্যাংকগুলোর আদৌ আছে কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অর্থনীতিবিদরা।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এবং ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. আহসান এইচ মনসুর বাংলাদেশ জার্নালকে বলেন, অর্থনীতিতে সংকট তৈরি হলে ব্যাংকখাতে এর প্রভাব পড়বেই। অর্থনীতি পুনরূদ্ধারে ক্ষতিগ্রস্ত উদ্যোক্তাদের ঋণ খেলাপি না করা সহ বেশকিছু সুবিধা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সামর্থ্যবানরাও ঋণের কিস্তি ফেরত দিচ্ছে না। ফলে ব্যাংকগুলোর আয় কমে গেছে।

অন্যদিকে গত ৩ মাসে ঋণের কিস্তি না দিলেও খেলাপি না করার নির্দেশনা রয়েছে। এতে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়লেও কাগজে-কলমে তা কম দেখানো হচ্ছে। যা ভবিষ্যতে ভয়াবহ সংকট তৈরি করবে। তিনি বলেন, প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ব্যাংকগুলো বড় ধরনের ঝুঁকিতে পড়বে। বিশেষ করে এসএমই ঋণের ক্ষেত্রে এই ঝুঁকি অনেক বেশি। ফলে ব্যাংকগুলো এই খাতে ঋণ বিতরণে আগ্রহী হবে না। এতে করে এসএমই উদ্যোক্তারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হবেন।

এ সংকট থেকে করণীয় প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সরকারকে অবশ্যই প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নে যে ঋণঝুঁকি তৈরি হবে তার দায়ভার নিতে হবে। সরকার দুইভাবে এই দায়ভার নিতে পারে। এক. ঋণের ঝুঁকির নিশ্চয়তা দিতে হবে অথবা ঋণের সুদে আরো বেশি পরিমাণে ভর্তুকি দিতে হবে। কয়েকটি ব্যাংকে কর্মীদের বেতন-ভাতা কমানো প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ব্যাংকগুলো শখ করে এ কাজ করছে না। দেশের ব্যাংকখাত সত্যি সত্যি গভীর সংকটে পড়েছে। এ থেকে উত্তরণে সব পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তারা এখন এদিকে হাঁটছে। এ সংকট থেকে উত্তরণে সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে।

এদিকে ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনার কারণে ব্যাংকগুলোর আমানত বাড়ছে না। খুব শিগগিরই বাড়বেও না। বরং আমানত তুলে নেয়ার প্রবণতা বাড়ছে। ১ এপ্রিল থেকে ঋণে ৯ শতাংশ সুদহার কার্যকর করায় আয় আগের তুলনায় কমে গেছে। আবার করোনার কারণে ঋণের টাকা আদায় হচ্ছে না। সব মিলিয়ে টাকার সংকটে পড়ছে ব্যাংকগুলো। তাছাড়া করোনার কারণে ঋণ খেলাপিদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার অবস্থা এখন নেই। ফলে নতুন করে কোনো ঋণ আদায়ও হবে না। এতে করে ব্যাংকের আয়ে আরও এক ধাপ প্রভাব পড়বে। এ ছাড়াও ব্যাংকের ডিপোজিট অনেক দিন ধরেই কমছে, এটা আরও কমে যাবে। এখন কেউ ব্যাংকে টাকা রাখতে যাচ্ছে না; বরং যাচ্ছে টাকা ওঠাতে। সব মিলিয়ে ব্যাংকিং খাত অদূর ভবিষ্যতেই এক ধরনের তারল্য সংকটে পড়ার আশঙ্কা বাড়ছে।

প্রকৃত অর্থে ব্যাংকিং খাত করোনাভাইরাস সংক্রমণের আগে থেকেই বিপর্যস্ত অবস্থায় ছিল। নতুন করে এই সংকট তৈরি হওয়ায় অবস্থা আরও খারাপ হচ্ছে। করোনার কারণে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বন্ধ আছে; ফলে ঋণের প্রবাহ নেই। কারণ, উদ্যোক্তারা ঋণ নিয়ে কিছু করতে পারছেন না। আর ঋণ প্রবাহ না থাকায় ব্যাংকের আয় কমে যাবে। সব মিলিয়ে ব্যাংকিং খাতে সমস্যা আরও প্রকট হবে। করোনাভাইরাসের আগেও ব্যাংকখাতের অবস্থা ভালো ছিল না। তখন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছিল দেশের ব্যাংকিং খাত। এখন করোনার আচমকা আঘাতে লন্ডভন্ড অবস্থা। এই অবস্থা থেকে বের হতে হলে ব্যাংকগুলোতে টাকার প্রবাহ বাড়ানোর পাশাপাশি খেলাপি ঋণ আদায় করাসহ নতুন ঋণ যেন খেলাপি না হয়- সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি দিতে হবে।