সিরাজগঞ্জে স্বেচ্ছাশ্রমে তৈরি হলো ১০৩৩ ফুট সাঁকো
পোস্ট করেছেন: Dinersheshey | প্রকাশিত হয়েছে: জুলাই ২০, ২০২০ , ১১:৪৪ পূর্বাহ্ণ | বিভাগ: সারাদেশ
সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি : রেলপথের মতো এঁকেবেঁকে গেছে বাঁশের তৈরি দীর্ঘ এক সাঁকো। পার হতে গেলে বোঝা যায় এর দৈর্ঘ্য। একটি বাঁক শেষ হতেই শুরু হয় আরেকটি বাঁক। নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের দাবি, এটির দৈর্ঘ্য ১ হাজার ৩৩ ফুট। বেলকুচি উপজেলার প্রত্যন্ত যমুনার চরে রানীপুরা গ্রামের বাসিন্দাদের স্বেচ্ছাশ্রমে তৈরি হয়েছে এই সাঁকো।
প্রতিবছর বর্ষা এলেই ডুবে যায় উপজেলার যমুনা পরিবেষ্টিত রানীপুরা, মনতলার চর, চর আগুরিয়া, মুলকান্দি, বেলির চর ছোট বেড়াখারুয়া, বড় বেড়াখারুয়াসহ অন্তত ১০টি গ্রাম। তখন পানিবন্দী মানুষের যোগাযোগের একমাত্র ভরসা কলাগাছের ভেলা আর কিছু নৌকা। এ সময় কৃষক, শ্রমিক, তাঁতি, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগের শেষ থাকে না।
বিষয়টি ভাবায় রানীপুরা গ্রামের আনিসুর রহমানকে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। করোনার কারণে এখন বাড়িতে আছেন। গ্রামের কয়েকজন যুবকের সঙ্গে কথা বলেন, সাঁকো তৈরির প্রস্তাব দেন। তার প্রস্তাবে এগিয়ে আসেন গ্রামের উদ্যমী যুবক নূর আলম শেখ, বাবু রাজ, শহিদুল ইসলাম, আবদুল লতিফ ও আবদুল শেখ। এরপর তাদের সঙ্গে একাত্মতা জানিয়ে এলাকার মানুষও এগিয়ে আসে।
প্রথমে চিহ্নিত করা হয় অপেক্ষাকৃত সচ্ছল পরিবারগুলোকে। এমন ২১০টি পরিবারের কাছ থেকে নেওয়া হয় ৩০০ টাকা করে চাঁদা। ১০ জনের কাছ থেকে নেওয়া হয় ১০ হাজার করে টাকা। একজন ইউপি সদস্য দেন দুই হাজার টাকা। বাঁশের ব্যাপারী ও কাঠের দোকানিরা বকেয়ায় উপকরণ দেন।
এপ্রিলের প্রথম দিকে সাঁকো তৈরির কাজ শুরু হয়। দিনে সাত থেকে আট ঘণ্টা করে চলে কাজ। শেষ হতে সময় লেগেছে প্রায় দেড় মাস। শেষ দিকে যমুনার পানি বেড়ে যায়। থেমে থেমে বৃষ্টি হতে থাকে। প্রবল স্রোতের মধ্যে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে কাজ শেষ করতে বেশ বেগ পেতে হয়। সাঁকোটি নির্মাণে ১ হাজারের বেশি বাঁশ, ৮৫ সিএফটি কাঠ, ২ মণ ১৫ কেজি রশি, ১ মণ ২৫ কেজি তারকাটা লেগেছে।
আনিসুর রহমান বলেন, ‘সাঁকো নির্মাণে ব্যয় হয়েছে প্রায় সোয়া তিন লাখ টাকা। গ্রাম থেকে সাধ্যমতো আর্থিক সহায়তা পাওয়ার পরও বাঁশ ও কাঠের দোকানে ১ লাখ ১০ হাজার টাকা বকেয়া রয়েছে। এখন পর্যন্ত আমরা পাঁচ উদ্যোক্তা কোনো আর্থিক সহায়তা করতে পারিনি, শুধু শ্রম দিয়ে যাচ্ছি।’
উদ্যোক্তাদের আরেকজন নূর আলম শেখ জানালেন, ১৯৮৮ সালের পর যমুনা নদীর গতিপথ পরিবর্তিত হওয়ায় এই অঞ্চলে জেগে ওঠে চর। তবে মাঝখান দিয়ে প্রবাহিত যমুনার শাখা নদী এখনো বয়ে চলেছে। বর্ষা মৌসুমের চার মাস এই অঞ্চল পানিতে ডুবে থাকায় অন্তত ১০টি গ্রামের মানুষের দুর্ভোগের অন্ত থাকে না। তাদের দুর্দশা লাঘবে এই প্রচেষ্টা। পুরা গ্রামের হালিমা বেওয়া (৬০) বলেন, ‘বন্যার সময় আমরা পানির মধ্যে বাইরেই যাইব্যার পারি নাই। এহুন শুকনার মধ্যেই পায়ে হাইট্যা সড়কে যাই। সাঁকোডা অয়া গ্রামের মাইনষের মেলা সুবিদ্যা ওইছে।’
আবদুল লতিফ জানালেন, সাঁকোটি নির্মাণের ফলে এই অঞ্চলের অন্তত ১০টি গ্রামের মানুষ সুবিধা পাচ্ছে। যদিও চরাঞ্চলের এই সব গ্রামের অনেক বাড়িতেই পানি প্রবেশ করেছে। তবু এই সাঁকো দিয়ে চলাচলের কারণে এখন আর তাদেরকে বুকপানি সাঁতরে পাকা সড়কে উঠতে হচ্ছে না। বাবু রাজ দাবি করেন, সাঁকোটির দৈর্ঘ্য ১ হাজার ৩৩ ফুট। তাদের জানামতে, দেশের কোথাও এত বড় দীর্ঘ বাঁশের সাঁকো আর নেই।
শাহ্পুর গ্রাম থেকে সাঁকোটি দেখতে এসে আবদুল হালিম বলেন, ‘এত বড় বাঁশের সাঁকো আমি জীবনেও দেখি নাই। লোকমুখে সাঁকোটির কথা শুনে দেখতে এসেছি। প্রবাহমান যমুনার ওপর এমন একটি সাঁকো আসলেই আশ্চর্য ব্যাপার। আশপাশের প্রায় ১০ গ্রামের মানুষ এর সুফল পাবে।’
বেলকুচি ইউপির চেয়ারম্যান সোলায়মান হোসেন বলেন, ‘প্রতিদিন বিভিন্ন উপজেলা থেকে শত শত মানুষ এই সাঁকো দেখতে আসছে। এমন একটি মহৎ উদ্যোগ সত্যি আমাকে অভিভূত করেছে। উদ্যোক্তাদের সাধুবাদ জানাই।’
এমন উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়ে বেলকুচি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আনিছুর রহমান দিনের শেষে প্রতিনিধিকে বলেন, এমন উদ্যোগ মডেল হতে পারে। শুধু সরকারের মুখাপেক্ষী না হয়ে গ্রামের ছোট ছোট সমস্যা যে খুব অনায়াসেই সমাধান করা যায়, এলাকাবাসী সেই দৃষ্টান্ত রেখেছেন।