এবার মাঈনুদ্দিন-আশরাফকে ফিরিয়ে আনতে তৎপর সরকার
পোস্ট করেছেন: admin | প্রকাশিত হয়েছে: জুন ৭, ২০১৬ , ১১:৩৫ পূর্বাহ্ণ | বিভাগ: জাতীয়
কাগজ অনলাইন প্রতিবেদক: ১৮ জন বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডসহ মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা চৌধুরী মাঈনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামান খানকে ফিরিয়ে আনার চূড়ান্ত উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে সরকার। তাদেরকে দেশে ফিরিয়ে এনে ফাঁসির রায় কার্যকর করতে সরকার নানামুখী তৎপরতা চালাবে।
জামায়াতের কর্মপরিষদ সদস্য মীর কাসেম আলীর ফাঁসির রায় কার্যকরের পর পলাতক এই দুই কুখ্যাত আলবদর নেতাকে ফিরিয়ে আনার চূড়ান্ত তৎপরতা চালানো হবে বলে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে।
২০১৩ সালের ০৩ নভেম্বর চৌধুরী মাঈনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামান খানকে মৃত্যুদণ্ড দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এর অনেক আগে থেকেই তারা যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে আছেন। তাদেরকে পলাতক ঘোষণা করেই পুরো বিচারিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়।
চৌধুরী মাঈনুদ্দিন লন্ডনে এবং আশরাফুজ্জামান খান নিউইয়র্কে বসবাস করছেন। তাদেরকে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে সরকার দীর্ঘদিন ধরেই প্রক্রিয়া চালাচ্ছিল। তবে এবার বিশেষভাবে ও চূড়ান্ত উদ্যোগ নেওয়া হবে।
সরকার সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, এই দুই যুদ্ধাপরাধীকে ফিরিয়ে আনতে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে জোর কূটনৈতিক তৎপরতা চালানো হবে। মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের শাস্তি কার্যকরের কথা উল্লেখ করে দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদেরকে ফিরিয়ে দিতে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কাছে জোর দাবি জানানো হবে। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে দেশ দু’টির সর্বোচ্চ পর্যায়ে তৎপরতা চালানো হবে। ইন্টারপোলেরও সহযোগিতা চাইবে সরকার। আন্তর্জাতিকভাবে চাপ সৃষ্টির জন্যও নানামুখী কূটনৈতিক তৎপরতা চালানো হবে।
সুত্রগুলো আরও জানায়, এই দুই কুখ্যাত আলবদর নেতাই ওই দুই দেশের নাগরিক এবং পাসপোর্টধারী। যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্দি বিনিময় চুক্তি না থাকায় এই দুই মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে ফিরিয়ে আনা বিলম্বিত হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার প্রক্রিয়া শুরু আগে থেকেই তাদের ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সরকার। ওই দুই দেশের আপত্তির কারণে এতোদিন সেটি সম্ভব হয়নি। তবে সরকার এ ব্যাপারে এখনও হাল ছাড়েনি। তাদের ফিরিয়ে আনতে সরকার যা যা করার করবে। বিশেষ করে নানামুখী কূটনৈতিক তৎপরতা ওপর জোর দেবে সরকার।
এদিকে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটিসহ বিভিন্ন মহল থেকে ওইসব দেশে এবং আন্তর্জাতিকভাবে এই দুই যুদ্ধাপরাধীকে ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে জনমত তৈরির কাজ অব্যাহত রয়েছে।
ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘আমরা ওইসব দেশের সরকার এবং জনগণকে বোঝানোর চেষ্টা করছি, মানবতাবিরোধী ও গণহত্যাকারীদেরকে তারা কেনো বিচারের রায় কার্যকরের জন্য ফিরিয়ে দেবে না? তাদের দেশ কেনো গণহত্যাকারীদের আশ্রয়স্থল হবে?’
‘এ বিষয় নিয়ে আমরা বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছি। গত ২৯ মার্চ আমরা লন্ডনে সর্ব ইউরোপীয় সম্মেলন করেছি। সেখানে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটিসহ মানবাধিকার সংগঠনগুলো অংশ নিয়েছে’।
মাঈনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামান দু’জনেই ছাত্রজীবন থেকে ছিলেন জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের সক্রিয় সদস্য। দু’জনের মধ্যে চৌধুরী মাঈনুদ্দীন একাত্তরে ছিলেন পূর্বদেশ পত্রিকার সাংবাদিক। পরবর্তী সময়ে তারা ছাত্রসংঘের হাইকমান্ডের সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সহযোগী বাহিনী হিসেবে আলবদর বাহিনীতে রুপান্তরিত হয় ইসলামী ছাত্রসংঘ। স্বাধীনতার উষালগ্নে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের নীলনকশা বাস্তবায়নে আলবদর বাহিনীর কিলিং স্কোয়ার্ড গঠিত হয়।
মাঈনুদ্দীন ওই বাহিনীর ‘অপারেশন ইনচার্জ’ এবং আশরাফুজ্জামান খান ‘চিফ এক্সিকিউটর’ বা ‘প্রধান জল্লাদ’ ছিলেন।
স্বাধীনতার পরে পাকিস্তান হয়ে যুক্তরাজ্যে পালিয়ে যান মাঈনুদ্দীন। তিনি লন্ডনের টেন্টহাম মসজিদের চেয়ারম্যানও ছিলেন। অন্যদিকে চৌধুরী আশরাফুজ্জামান বিভিন্ন দেশে পালিয়ে থেকে স্থায়ী হন যুক্তরাষ্ট্রে।
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মূল এই দুই ঘাতকের বিচার একটি মামলায়ই সম্পন্ন হয়। তাদের বিরুদ্ধে আনা বুদ্ধিজীবীদের অপহরণ, আটক, নির্যাতন, হত্যা ও গণহত্যা- এ ৫ ধরনের ১১টি মানবতাবিরোধী অপরাধের সবগুলোই প্রমাণিত হয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে।
রায়ে বলা হয়েছে, স্বাধীনতার উষালগ্নে দেশকে মেধাশূন্য করতে বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ছাত্রসংঘের সদস্যরা হাইকমান্ডের নির্দেশে সরাসরি আলবদর বাহিনীতে রূপান্তরিত হয়। বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের চূড়ান্ত রুপ দিতে একাত্তরের ডিসেম্বরে ছাত্রসংঘের সদস্যদের নিয়ে আলবদর বাহিনীর কিলিং স্কোয়ার্ড গড়ে তোলা হয়। অভিযুক্ত চৌধুরী মাঈনুদ্দীন ওই বাহিনীর ‘অপারেশন ইনচার্জ’ এবং আশরাফুজ্জামান খান ‘চিফ এক্সিকিউটর’ বা ‘প্রধান জল্লাদ’ ছিলেন। এ দু’জন বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে নির্মম নির্যাতন শেষে হত্যা করে রায়েরবাজার ইটখোলা ও মিরপুর বধ্যভূমিতে মরদেহ ফেলে দেন।
রায়ে বলা হয়, আশরাফুজ্জামান ও মাঈনুদ্দিনের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ও নেতৃত্বে বুদ্ধিজীবীদের বাড়ি থেকে তুলে মোহাম্মদপুরের ফিজিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারে আলবদর হেডকোয়ার্টারের নির্যাতন ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আটকে রেখে তাদের ওপর নির্যাতন করা হয়। তারপর মিরপুর ও রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে নিয়ে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়।
এভাবে ১৯৭১ সালের ১০ থেকে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে ১৮ জন বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দশ জন শিক্ষক, ছয় জন সাংবাদিক ও দুই জন চিকিৎসক।
যে ১৮ জন বুদ্ধিজীবীকে হত্যার জন্য আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মাঈনুদ্দীন দায়ী হয়েছেন তাদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ শিক্ষকরা হচ্ছেন, অধ্যাপক গিয়াস উদ্দিন আহমদ, অধ্যাপক রাশিদুল হাসান, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, ড. আবুল খায়ের, ড. সন্তোষ ভট্টাচার্য, ড. সিরাজুল হক খান, ডা. মো. মর্তুজা, ড. ফয়জুল মহিউদ্দিন, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী ও অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী। শহীদ চিকিৎসকরা হচ্ছেন, বিশিষ্ট চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. আব্দুল আলীম চৌধুরী ও বিশিষ্ট কার্ডিওলজিস্ট ডা. ফজলে রাব্বী। শহীদ সাংবাদিকরা হচ্ছেন, দৈনিক ইত্তেফাকের নির্বাহী সম্পাদক সিরাজ উদ্দিন হোসেন, পিপিআইয়ের চিফ রিপোর্টার সৈয়দ নাজমুল হক, দৈনিক পূর্বদেশের চিফ রিপোর্টার আ ন ম গোলাম মোস্তফা, বিবিসির সংবাদদাতা ও পিপিআইয়ের সাবেক জেনারেল ম্যানেজার নিজামউদ্দিন আহমেদ, শিলালিপি পত্রিকার সম্পাদিকা সেলিনা পারভীন এবং দৈনিক সংবাদের যুগ্ম সম্পাদক ও বিশিষ্ট সাহিত্যিক শহীদুল্লাহ কায়সার।
সর্বোচ্চ আদালতে ফাঁসির রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার সুযোগ থাকলেও পলাতক থাকার কারণে কোনো আপিল হয়নি।