করোনা কাহিনী : তিনটি মৃত্যু একটি জন্ম একই সুতোয় গাঁথা
পোস্ট করেছেন: dinersheshey | প্রকাশিত হয়েছে: এপ্রিল ৩, ২০২০ , ১১:০৩ পূর্বাহ্ণ | বিভাগ: সম্পাদকীয়
সম্পাদক, শ্যামল দত্ত :
তিনটি মৃত্যু, একটি জন্ম। এই চারটি আলাদা আলাদা ঘটনা। আলাদা আলাদা দেশে। কিন্তু একই সূত্রে গাঁথা এই চার ঘটনা। মৃত্যু এবং জন্ম যে একই সুতোয় গাঁথা হতে পারে এই শিক্ষা আমাদের দিয়েছে একটি সংকট, যে সংকটে বিপর্যস্ত এখন পুরো বিশ্ব। খোলা বাতায়নের যুগে মানুষ যখন ঘরবন্দি, তখন এক নতুন ভাইরাস বিশ্বকে বেঁধেছে আতঙ্কের সুতোয়। মন্ট্রিল থেকে মেলবোর্ন- পুরো পৃথিবী এখন এই শঙ্কার সুতোই বাঁধা।
জার্মানির হেসে প্রদেশের অর্থমন্ত্রী টমাস সাফেরের মৃতদেহ পাওয়া গেছে দ্রুতগামী ট্রেন লাইনের পাশে। করোনাই বিপর্যস্ত সম্ভাব্য অর্থনৈতিক সংকটের চিন্তা তাকে এমন একটি জায়গায় নিয়ে গেছে, যার কারণে তিনি আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। আমরা স্মরণ করতে পারি, চীনের সেই ডাক্তার লিউয়েন লিওনের কথা, যিনি হুবেই প্রদেশের প্রধান শহর উহানে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা করতে গিয়ে নিজের জীবন উৎসর্গ করে দিয়েছেন। আমরা স্মরণ করতে চাই, পাকিস্তানের সে? চিকিৎসক- যিনি উহানে কর্মরত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছেন, সেই উসামা রিয়াজের কথা। এই তিন মৃত্যু আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে, আমাদের চেনা পৃথিবীটার অচেনা এক নতুন চেহারাকে। প্রশ্ন উঠেছে, পৃথিবীটা যেভাবে চলছিল, সেভাবেই কী চলবে- না নতুন এক বিশ্ব ব্যবস্থার জন্ম হবে। যে ব্যবস্থা হবে কোনো নির্দিষ্ট দেশ নয়, কোনো নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠী নয়- সবার জন্য, সব মানুষের জন্য কল্যাণকর। করোনার মহামারি সংকট সারা পৃথিবীর জন্য যে লেভেল প্লেইং ফিল্ড তৈরি করেছে, সেই চোখেই আমরা বিশ্বটাকে দেখব, না বিদ্যমান বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা অব্যাহত রাখব।
অন্যদিকে এই সংকটের সময় একটি সন্তানের জন্ম দিয়ে আমাদের নতুন একটি বাস্তবতা শিখিয়েছেন ভারতীয় চিকিৎসক ডা. মিনাল দাখাবে ভোঁসলে। পুনের মাইল্যাব ডিসকভারি ও গবেষণা উন্নয়নের প্রধান তিনি। এই গবেষক বলেছেন, আগে ভাইরাস শনাক্তকরণ কিটের জন্ম দেব, তারপর আমার সন্তানের। স্বল্প দামে নতুন একটি শনাক্তকরণ কিটের আবিষ্কারের পরদিন হাসপাতালে গিয়ে ভর্তি হয়েছেন এই সন্তানসম্ভবা নারী এবং জন্ম দিয়েছেন এক নতুন সন্তানের। এই পৃথিবীটাকে নিয়ে আমরা যারা ভাবি- তাদের জন্য কিছু কি শিক্ষণীয় আছে তার কাছ থেকে? বাংলাদেশের একজন গবেষক ডা. বিজন কুমার শীল গণস্বাস্থ্যের উদ্যোগে স্বল্পমূল্যের একটি কিট আবিষ্কার করে এই মহাসংকটের সময় মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। এ দেশে কত বিত্তশালী মানুষের কত হাজার হাজার কোটি টাকা আছে। কোটি কোটি টাকা পাচারের গল্প শুনতে শুনতে মানুষ যখন হতাশায় নিমগ্ন, তখন আমাদের আশান্বিত করে এ রকম কিছু মানুষের কাজ যারা নিজের দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করতে প্রস্তুত ব্যক্তিগত কোনো স্বার্থের কথা চিন্তা না করেই।
এ দেশে চিকিৎসার অভাবে মারা যায় কত মানুষ। করোনায় আক্রান্ত কত মানুষ চিকিৎসা পাচ্ছে না। হাসপাতালগুলো নিতে রাজি হচ্ছে না করোনায় আক্রান্ত রোগীদের। ১৭ কোটি লোকের দেশে পর্যাপ্ত আইসিইউ নেই, নেই ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা। অথচ মাত্র এক হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করলে এক লাখ ভেন্টিলেটর আনা সম্ভব। এ দেশ থেকে জনগণের সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা নিয়ে নির্বিঘ্নে পালিয়ে যায় একজন পিকে হালদার। তারা অবলীলায় থেকে যায় সরকারের ধরাছোঁয়ার বাইরে। কিন্তু হাসপাতালের চেহারা পাল্টায় না, থেকে যায় আগের মতো। ডাক্তার আছেন, যন্ত্রপাতি নেই, আবার যন্ত্রপাতি থাকলে ডাক্তার নেই।
এই বিশ্বে কত শক্তিধর রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধান আছেন নিজের দেশকে তারা কত নিরাপদ ভেবেছেন, তৈরি করেছেন নানা রকমের মারণাস্ত্র। অথচ ছোট ভাইরাসের কাছে এখন কত অসহায় তারা। এই মুহূর্তে প্রশ্ন উঠেছে, অর্থনৈতিকভাবে অসম্ভব উন্নত দেশ যে সংজ্ঞাই নিজেদের নিরাপত্তার কথা ভেবেছে, বাস্তবে তা যে কত ঠুনকো, তা প্রমাণ হয়ে যাচ্ছে এখন। কেউ যদি এখন প্রশ্ন তোলেন বর্তমান পরিস্থিতিতে কোন দেশ বেশি নিরাপদ? মহাপরাক্রমশালী পারমাণবিক শক্তিধর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র না ছোট্ট অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল দেশ ভুটান। এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতে নিশ্চয়ই কষ্ট হওয়ার কথা নয়। অনেক দেশ জীবাণু যুদ্ধের জন্য অস্ত্র তৈরি করেছে কিন্তু যুদ্ধ হলে রোগীদের চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল তৈরি করেনি, পর্যাপ্ত ডাক্তার বানায়নি। তাই ডাক্তারদের মুখোমুখি হতে হচ্ছে অচেনা শত্রুর সঙ্গে এক যুদ্ধের। আর অকাতরে প্রাণ যাচ্ছে সাধারণ মানুষের। এমনকি প্রাণ হারাচ্ছেন ডাক্তাররাও। শুধু চিকিৎসা দিতে গিয়ে ইতালিতে প্রাণ হারিয়েছেন ৫৭ জন চিকিৎসক। অথচ কত আধুনিক চিকিৎসা এই দেশে।
এই মুহূর্তে মনে পড়ছে আলবেয়ার কামুর লেখা সে বিখ্যাত ‘দ্য প্লেগ’ উপন্যাসটি। ফরাসি ভাষায় লেখা ‘লা পেস্তে’ বা ‘দ্য প্লেগ’ উপন্যাসটি শুরু হয়েছিল একটি ইঁদুর আর একজন ডাক্তারের গল্প দিয়ে। নিশ্চয়ই মনে করতে পারছেন উপন্যাসের নায়ক ডাক্তার রিওয়ের কথা। উপন্যাসে নয়, বাস্তবে এখন অনেক চিকিৎসক ডা. রিওয়ের মতো এই মহামারির সময় অগ্রসৈনিক হয়ে কাজ করছেন। বাংলাদেশে বহু চিকিৎসক ঝুঁকি নিয়ে চালিয়ে যাচ্ছেন চিকিৎসা। বেশ কয়েকজন অসুস্থ হয়ে কোয়ারেন্টাইনে গেছেন। হাসপাতালে পিপিই নেই, অথচ ব্যাংকের কর্মকর্তা, সরকারের ঊর্ধ্বতন কেউ কেউ পিপিই পরে ফেসবুকে পোস্ট দিচ্ছেন।
আলবেয়ার কামু লিখেছেন, আলজেরিয়ার ওরান শহরে প্লেগের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে এক চরম ট্র্যাজেডির শিকার হচ্ছেন ডা. রিও। নিজের স্ত্রীকে চিকিৎসা করানোর সুযোগ পাননি তিনি। প্লেগের আক্রমণ থেকে তার শহর যখন মুক্ত হয়ে ঘরে ফিরে ক্লান্ত ডা. রিও দেখেন তার স্ত্রী ইতোমধ্যে মারা গেছেন। হাজারো মানুষকে চিকিৎসা করে বাঁচালেও তিনি তার স্ত্রীকে বাঁচাতে পারেননি। আমরা সেই মানবিক ডাক্তারদের দেখতে চাই এই মহামারির সংকট মোকাবিলায়।
সম্প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ডাক্তারদের সম্পর্কে বলেছেন, সাদা পোশাকধারী ওই মানুষগুলোকে দেখলে মনে হয় ঈশ্বরের মতো। রোগাক্রান্ত মানুষ ঈশ্বরের পরে স্থান দেন চিকিৎসকদের। এই সংকটে যারা ফ্রন্টলাইনে থেকে যুদ্ধ করছেন, তাদের যেন আমরা সেভাবেই দেখি। এই সংকটে সাধারণ মানুষের এই আস্থা তৈরি করতে ডাক্তারদেরও দায়িত্ব কম নয়।