বাউফলে তরমুজের বাম্পার ফলন হলেও পরিবহন-বিপনন সমস্যার কারণে চাষীদের মুখে হাসি নেই
পোস্ট করেছেন: Dinersheshey | প্রকাশিত হয়েছে: এপ্রিল ১৫, ২০২০ , ৮:০৬ পূর্বাহ্ণ | বিভাগ: সারাদেশ
বাউফল প্রতিনিধি : ‘সব খুয়াইছি তরমুজের পিছে। কেডা খাইবে এ্যাহন। কোম্মে, ক্যামন কইরগ্যা পাডামু এই তরমুজ!’ –মলিন মুখে ঠোট ফেটে কথাগুলো কোনমতে বেড় হচ্ছিল কচ্ছবিয়ার চরের তরমুজ চাষি বাবুল খানের। কপালে হতাশার ভাজ তার স্পস্ট। ছলছল চোখে দৃষ্টি কেবলই ক্ষেতে পড়ে থাকা তরমুজের দিকে তার। কিভাবে উঠবেন তিনি ঋণের ধকল কাটিয়ে। ছেলে–মেয়ে নিয়ে সারাবছর কেমন করে চলবে তার সংসার। বাম্পার ফলনেও করোনার হানায় বাজারজাত করতে না পাড়ায় বিপাকে পটুয়াখালীর বাউফলের কচ্ছবিয়ার চরের এই তরমুজ চাষি বাবুল খান। করোনার বিভিন্ন এলাকা হয়েছে লকডাউন। পরিবহন আর মোকামে আড়ৎসহ স্থানীয় হাট–বাজার রয়েছে বন্ধ। এতে সিনজেনটার ড্রাগন ও সুপ্রিম সীডসের হীরা জাতের চোখ জুড়ানো ফলনের তরমুজ তার ক্ষেতে পড়ে আছে বেকলই অবহেলায়। অবহেলা আর অনাদরে পড়ে আছে তারই ক্ষেতের মতো পাশের তাঁতেকাঠি গ্রামের শহীদ ফরাজি, বাকলা তাঁতেরকাঠির ফিরোজ চৌধুরির ক্ষেতসহ, ভোলা থেকে আসা চর রায়সাহেবের তরমুজ চাষি নুরুদ্দিন, হেলাল, মহসীন ও তেঁতুলিয়া নদীর চরকচ্ছবিয়া, চরওয়াডেল, রায়সাহেবের চর, চরঈশান, বাসুদেবপাশা, চরশৌলাসহ বিভিন্ন চরে চাষির ক্ষেতের গরমে সু–স্বাদ রসালো আর মুখরোচক মৌসুমি ফল তরমুজ। করোনায় হাট–বাজার আর পরিবহন বন্ধ থাকায় এসব চরের চরমুজ চাষিরা এখনই কেবল বিপাকেই নয় চাষের কাজে এনজিও আর মহাজনের কাছ থেকে নেওয়া ঋণ পরিশোধ করে সারা বছর কিভাবে সংসার চলবে সেই চিন্তায়ও বুদ্ধ। অতিজোয়ার, লবন পানির হানা আর একই জমিতে বারবার কীটনাশক ও সার–ওষুধ ব্যাবহারের কারণে নিজ এলাকায় আগেরমতো তরমুজের ভাল ফলন না মেলায় চরকচ্ছবিয়ার এসে তরমুজ চাষে দীর্ঘ ১৫–১৬ বছরের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানো পাশের গলাচিপা উপজেলার চরকাজলের চাষি বাবুল খান। পোকামাকড়, রোগবালাই আর আবহাওয়া অনুকুলে থাকায় তার লীজ নিয়ে চাষ করা প্রায় ২৫ একর জমিতে সিনজেনটার ড্রাগন ও সুপ্রিম সীডসের হীরা জাতের তরমুজের ফলনও হয়েছে বাম্পার। কিন্তু করোনার কারণে পরিবহন, মোকামে আড়ৎসহ স্থানীয় হাট–বাজার বন্ধ থাকায় তার ক্ষেতেই পড়ে আছে ওই তরমুজ। নিশ্চিত লোকসান গুনতে হবে। লাভের আশায় তরমুজ চাষে পথে বসার উপক্রম হয়েছে তার। আগামিতে হাত চাষে গুটিয়ে নেওয়ার কথা উল্লেখ করে বাবুল খান জানান, ক্ষেতের তরমুজ ছিড়ে প্রথমে টমটমভ্যানে নদীর পাড়ে ট্রলারে তুলতে হয়। সেখান থেকে পাশের জেলা ররিশালের লাহারহাট পৌঁছে ট্রাকে বোঝাই করে তরমুজ নিয়ে ছুটতে হয় সিরাজগঞ্জের এসএস রোর্ডের চানমিয়ার মেসার্স বিসমিল্লাহ আমের আড়ৎ, ভৈরবের নুরুদ্দিন ট্রেডার্স, বরিশাল সদরের রুহুল ও সোহেলের আড়ৎ, ঢাকার যাত্রাবড়িসহ দেশের বিভিন্ন মোকামে। করোনা মহামারির এ সময়ে পুলিশসহ প্রশাসনের লোকজনের পথে তরমুজের ট্রাকে তেমন কোন বাধাবিঘœ না থাকলেও দিনের পর দিন অপেক্ষা করেও পরিবহন ট্রাক পাওয়া যায় না। লোকজন ঘরে বন্ধি আর আড়ৎ কিংবা বাজারঘাট বন্ধ থাকায় দাম পাওয়া যায় না তরমুজের। লাহারহাট থেকে সিরাজগঞ্জে ১৫–১৬ হাজার টাকা গাড়িভাড়া হলেও এখন ৩০–৩৫ হাজার টাকায়ও গাড়ি মেলে না। পথের ঝক্কি–ঝামেলা কাটিয়ে ৬–১৫ কেজি গ্রেটের প্রতিমন (৪২ কেজি) তরমুজের দাম কাটা হয় মাত্র ৪–৫ হাজার টাকা। যাত্রাবাড়ি আড়তের অবস্থা আরো খারাপ। মোকামের দাম আর সব কিছু সামলে নিয়ে কেবল সিরাজগঞ্জে ৩ গাড়ি, ঢাকার যাত্রাবড়ি ১ গাড়ি ও বরিশালে ২ গাড়ি মাল (তরমুজ) পাঠিয়েছেন তিনি। পরিস্থিতি স্বাভাবিকের আশা করে অপেক্ষায় থাকলেও তার কোন লক্ষ্মই নেই। স্থানীয় হাট–বাজারও রয়েছে বন্ধ। যেসব সাইজের তরমুজ আগে অনেক দামে বিক্রি হতো তা এখন গরুতেও খাচ্ছে না। অর্ধেকের চেয়েও বেশি পরিমান তরমুজ নস্ট হতে চলছে তার ক্ষেতের মাটিতেই। স্থানীয় নুরাইনপুর ও কালাইয়া বন্দর থেকে বীজ সংগ্রহ করে একই চরে ৫ একর জমির তরমুজ চাষি তাঁতেরকাঠি গ্রামের শহীদ ফরাজি। আমন ধান উঠতে দেঁড়ি হলে চাষে কিছুটা পিছিয়ে পড়েও বাম্পার ফলন হয়েছে তার ক্ষেতেও। ড্রাগন জাতের ১০০ গ্রামের প্যাকেট বীজ ২ হাজার ২শ’ ৩০ টাকা নির্ধারিত মুল্যের বীজ সংগ্রহে ২ হাজার ৮শ’ টাকা খরচ হয় তার। হীরা জাতের তরমুজের ১০০ গ্রাম ওজনের বীজ কিনেন আড়াই হাজার টাকায়। বীজ সংগ্রহে এবছর সিন্ডিকেটের কারসাজিতে না পড়লেও বস্তা প্রতি (৫০ কেজি) ৮শ’ ৫০ টাকা মুল্যে ইউরিয়া সার ও ড্যাব সার কিনতে হয়েছিল ১ হাজার ১শ’ টাকা মুল্যে। বিভিন্ন চরে এবার তরমুজের চাষ বেড়েছে এবং বাম্পার ফলন হয়েছে উল্লেখ করে তিনি জানান, ধান চাষে লাভের মুখ দেখা যায় না আর অতিজোয়ার, ঘনকুয়াশা, শীলাবৃষ্টির মতো জলবায়ু পরিবর্তণ জনিত কারণে দিন দিন কামাকড়সহ কৃষিতে বিপদ–আপদ বেড়ে যাওয়ায় স্বলমেয়াদি ফুল–ফসলের মাঝে তরমুজ চাষে ঝুঁকছিল এ অঞ্চলের কৃষক। অনুকুল আবহাওয়া আর উল্লেখযোগ্য রোগবালাই না থাকায় ক্ষেতে বাম্পার ফলনও আসে। কিন্তু করোনার হানায় পরিবহন আর বাজারজাত করতে না পারায় পথে বসবেন চাষিরা। তরমুজ চাষে আগামিতে হাত গুটিয়ে নিবেন অনেকে। পাশের ভোলা থেকে আসা চর রায়সাহেবের তরমুজ চাষি নুরুদ্দিন, হেলাল ও মহসীন জানান, তরমুজের প্রতি মাদায় ১২ গ্রাম এমওপি, ৫–৭ গ্রাম ইউরিয়া, ১শ’ ৭০ গ্রাম টিএসপি, ১৫ গ্রাম ড্যাবসহ গ্রোজিন, সিনজেনটার ক্যারাটে, ম্যাগমা, থিউবিট, ভর্টিমেঘ ও স্কোরের মতো কীটনাশক ব্যাবহার আর চাষের খরচসহ মাদা প্রতি প্রায় ৫০–৬০ টাকার মতো খরচ হলেও তরমুজের বাম্পার ফলন এসেছে। কিন্তু করোনার প্রভাবে লন্ডভন্ড হয়ে যাচ্ছে সব। মোকামে পাঠিয়ে বিক্রি করতে না পাড়ায় এসব চাষিদের প্রত্যেকেরই মাথায় হাত তোলা ছাড়া কিছুই যেন করার নেই। কোন কোন চাষি ক্ষেতের ভাল গ্রেটের কিছু তরমুজ ছিড়ে নেওয়ার পরে ডেকে স্থানীয়দের হাতে হাতে তুলে দিচ্ছেন তরমুজ। আবার কারো ক্ষেতের তরমুজ খাচ্ছে গরুতেও। প্রতিবেদকের কাছে পরিস্থিতি জানাতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন চাষি নুরুদ্দিন এবং কোনমতে কান্না থামিয়ে বলেন, ‘করোনায় সর্বনাশ অইয়া গ্যাছে আমার। গতবারে আবহাওয়া লইগ্যা লাভের মুখ দেহি নাই। লোকসান কাডানের লইগ্যা এবার চাষ কইগ্যা করোনার ফাঁদে পড়ছি। চালান লইয়া ঘরে যাওন যাইবে না।’ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘এ বছর ৭৫০ হেক্টরে তরমুজ চাষ হয়েছে যা আগের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক বেশি। বাম্পার ফলনও হয়েছে। পরিবহন ও বিপনন সঙ্কটের কারণে চাষিদের লাভের পরিমান কিছুটা কম হতে পারে। এতে কিছু সংখ্যক ছোট ছোট চাষি ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারেন। তবে বাজারদর একটু কম হলেও গড়ে তা প্রায় আগের বছরের মতোই আছে। এ সময়ে পথে পরিবহনে কোন ধরণের সমস্যা তৈরী হলে চাষিদেরকে সঙ্গে সঙ্গে আমার মোবাইলফোনে যোগাযোগের করতে বলা হয়েছে।