ব্যাংকের লভ্যাংশ বিতরণে শর্ত বেঁধে দিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক
পোস্ট করেছেন: Dinersheshey | প্রকাশিত হয়েছে: মে ১৩, ২০২০ , ৭:০৩ পূর্বাহ্ণ | বিভাগ: অর্থ ও বাণিজ্য
দিনের শেষে প্রতিবেদক : নভেল করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট মন্দায় ব্যাংকগুলো যাতে টিকে থাকতে পারে, সেজন্য ব্যাংকের মূলধন ও তারল্যে জোর দিয়েছে বিশ্বের অনেক দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর অংশ হিসেবে অনেক দেশেই ব্যাংকের ডিভিডেন্ড ঘোষণার পথ বন্ধ করা হয়েছে। এবার সে পথে পা বাড়াল বাংলাদেশ ব্যাংকও। আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নগদ লভ্যাংশ বিতরণ স্থগিত করাসহ লভ্যাংশ বণ্টনে বেশকিছু শর্ত বেঁধে দিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের অফ-সাইট সুপারভিশন বিভাগ থেকে জারি করা এক প্রজ্ঞাপনে দেশের ব্যাংকগুলোর ২০১৯ সালের জন্য ঘোষিত নগদ লভ্যাংশ বণ্টনে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকবে বলে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। একই সঙ্গে মূলধন পর্যাপ্ততার ভিত্তিতে কোন শ্রেণীর ব্যাংক কত শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করতে পারবে, তাও নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। দেশে কার্যক্রম পরিচালনারত সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলোর ওপর এ নির্দেশনা কার্যকর হবে। করোনায় সৃষ্ট দুর্যোগে ব্যাংকগুলো যাতে বিপদে না পড়ে, সেজন্য ডিভিডেন্ড ঘোষণা বন্ধ করার দাবি জানিয়েছিলেন বিশেষজ্ঞরা। এর ভিত্তিতে গত ২৩ এপ্রিল ‘প্রণোদনায় অর্থায়নে তারল্য ঘাটতির শঙ্কা: লভ্যাংশ বিতরণ না করে ব্যাংকেই রাখার পরামর্শ’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে ডিভিডেন্ডের বিষয়ে ভারতসহ ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন ব্যাংকের উদ্যোগের বিষয়টি তুলে ধরা হয়। তার পরই এ সময়ে ২০১৯ সালের ডিভিডেন্ড বণ্টন বন্ধের উদ্যোগ নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা না পাওয়ায় এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারির বিষয়টি ঝুলে যায়। অবশেষে চলতি বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডিভিডেন্ড স্থগিত করে প্রজ্ঞাপন জারি করল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে প্রজ্ঞাপনে ভালো ব্যাংকগুলোকে লভ্যাংশ ঘোষণা ও বণ্টনের ক্ষেত্রে বড় ধরনের ছাড় দেয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, সঞ্চিতি সংরক্ষণসহ অন্যান্য ব্যয় মেটানোর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এর আগে গৃহীত ডেফেরাল সুবিধার অধীন নয় এরূপ বা ২০১৯ সালের জন্য কোনো ধরনের ডেফেরাল সুবিধা গ্রহণ ব্যতিরেকে যেসব ব্যাংক ২ দশমিক ৫০ শতাংশ ক্যাপিটাল কনজারভেশন বাফারসহ ন্যূনতম ১২ দশমিক ৫ শতাংশ বা তার বেশি মূলধন সংরক্ষণ করতে সক্ষম হবে, সেসব ব্যাংক তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ নগদসহ মোট ৩০ শতাংশ ডিভিডেন্ড ঘোষণা করতে পারবে। ন্যূনতম ১১ দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে অনূর্ধ্ব ১২ দশমিক ৫ শতাংশ মূলধন সংরক্ষণ করতে সক্ষম হলে ওই শ্রেণীর ব্যাংকগুলোকে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি নিয়ে ডিভিডেন্ড ঘোষণা করতে হবে। এক্ষেত্রে সামর্থ্য অনুযায়ী সর্বোচ্চ ৭ দশমিক ৫ শতাংশ নগদসহ মোট ১৫ শতাংশ ডিভিডেন্ড ঘোষণা করতে পারবে ব্যাংকগুলো। তবে এ দুই শ্রেণীর ব্যাংকের ঘোষিত নগদ ডিভিডেন্ডই ২০২০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বরের আগে বণ্টন করা যাবে না। প্রজ্ঞাপনে আরো বলা হয়, সঞ্চিতি সংরক্ষণসহ অন্যান্য ব্যয় মেটানোর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ২০১৯ সালের জন্য গৃহীত বা এর আগে গৃহীত ডেফেরাল সুবিধা সম্পূর্ণরূপে সমন্বয় করা হলে যেসব ব্যাংকের ন্যূনতম মূলধন ক্যাপিটাল কনজারভেশন বাফারসহ ১১ দশমিক ২৫ শতাংশ বা তার বেশি থাকে, সেসব ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদনক্রমে সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ নগদসহ মোট ১০ শতাংশ ডিভিডেন্ড ঘোষণা করতে পারবে। নগদ লভ্যাংশ বণ্টন বন্ধ থাকবে চলতি বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। আর যেসব ব্যাংকের মূলধন ১১ দশমিক ২৫ শতাংশের কম কিন্তু ন্যূনতম সংরক্ষিত মূলধন ১০ শতাংশ হবে, সেসব ব্যাংক ২০১৯ সালের জন্য ঘোষণা করতে পারবে সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ স্টক ডিভিডেন্ড। এক্ষেত্রেও প্রয়োজন হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমতির। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, যেসব ব্যাংক ২০১৯ সালের নিরীক্ষিত আর্থিক বিবরণীর ভিত্তিতে এরই মধ্যে ডিভিডেন্ড ঘোষণা করেছে, সেসব ব্যাংকের ঘোষিত ডিভিডেন্ডের পরিমাণ জারীকৃত প্রজ্ঞাপনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হলে তা স্থগিত করতে হবে। একই সঙ্গে ঘোষিত ডিভিডেন্ড সংশোধন করার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে স্থবির অর্থনীতিকে টেনে তোলার মূল দায়িত্ব পড়েছে ব্যাংকের ঘাড়ে। আর অস্তিত্ব রক্ষায় ব্যাংকগুলো জোর দিচ্ছে বাড়তি মূলধন, রিজার্ভ ও তারল্য সংস্থানের ওপর। যদিও প্রায় সব ক্ষেত্রেই নাজুক অবস্থানে আছে বাংলাদেশের সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলো। কাগজে-কলমে দেশে বাণিজ্যিক ব্যাংকের সংখ্যা ৫৯টি। যদিও মন্দার অভিঘাত মোকাবেলার সামর্থ্য ঠিক কয়টি ব্যাংকের আছে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। দেশের প্রায় সবক’টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকই মূলধন ঘাটতির চোরাবালিতে হাবুডুবু খাচ্ছে। এক প্রান্তিকে ঘাটতি থেকে বের হতে পারলেও পরের প্রান্তিকেই আবার ঢুকে পড়ছে মূলধন ঘাটতির তালিকায়। বেসরকারি খাতের অন্তত এক ডজন ব্যাংকের মূলধন পরিস্থিতিও নাজুক। বিনিয়োগযোগ্য তারল্য নেই অনেক ব্যাংকের হাতেই। খেলাপি ঋণের লাগাম টানতে ব্যর্থ বেশির ভাগ ব্যাংকই সঞ্চিতি সংরক্ষণে হিমশিম খাচ্ছে। এ অবস্থায়ও ২০১৯ সালের জন্য বড় অংকের নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করে আসছিল ব্যাংকগুলো। এরই মধ্যে বিদেশী ও বেসরকারি খাতের একাধিক ব্যাংক বিনিয়োগকারীদের জন্য ডিভিডেন্ড হিসেবে নগদ ও স্টকের ঘোষণা দিয়েছে। বাকি ব্যাংকগুলোও বার্ষিক প্রতিবেদন চূড়ান্ত করে লভ্যাংশ ঘোষণার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এর মাধ্যমে দেশের ব্যাংকিং খাত থেকে অন্তত ৩ হাজার কোটি টাকা বের হয়ে বিনিয়োগকারীদের পকেটে ঢোকার সম্ভাবনার কথা জানিয়েছিলেন আর্থিক খাত বিশেষজ্ঞরা। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ভারতসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও ব্যাংকের লভ্যাংশ বিতরণ না করার পরামর্শ দিয়েছিলেন তারা। উল্লেখ্য, করোনাভাইরাসে বিধ্বস্ত অর্থনীতিকে টেনে তুলতে ব্যাংকগুলোর হাতে পর্যাপ্ত তারল্য সংস্থানে জোর দিয়েছে রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (আরবিআই)। এজন্য অনির্দিষ্টকালের জন্য ভারতের ব্যাংকগুলোর সব ধরনের ডিভিডেন্ড ঘোষণা বন্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। আরবিআই চাচ্ছে, ব্যাংকগুলো ডিভিডেন্ড ঘোষণা না করে মুনাফার অর্থ হাতে রাখুক। এতে বিধ্বস্ত অর্থনীতিকে টেনে তুলতে মুনাফার অর্থও বিনিয়োগ করা যাবে। আবার রিজার্ভ বৃদ্ধি পাওয়ায় খেলাপি ঋণের অভিঘাত মোকাবেলা করে ব্যাংকের টিকে থাকার সক্ষমতাও বাড়বে। রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার মতোই এর আগে ব্যাংকগুলোর ডিভিডেন্ড ঘোষণার পথ বন্ধ করেছে ব্যাংক অব ইংল্যান্ডও। ইউরোপ ও আমেরিকার অনেক দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকও একই পথে হাঁটছে। যদিও ইউরোপ ও আমেরিকার ব্যাংকগুলো বরাবরই নগদ লভ্যাংশবিরোধী।