আজকের দিন তারিখ ২৩শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শনিবার, ৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সর্বশেষ সংবাদ
সম্পাদকীয় সাধারণ রোগীরা কোথায় যাবে?

সাধারণ রোগীরা কোথায় যাবে?


পোস্ট করেছেন: dinersheshey | প্রকাশিত হয়েছে: মে ১৭, ২০২০ , ৫:৪৮ পূর্বাহ্ণ | বিভাগ: সম্পাদকীয়


শ্যামল দত্ত, সম্পাদক : দেশের বরেণ্য শিক্ষাবিদ জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বার্ধক্যজনিত শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। গত শনিবার ৯ মে দেশের বিশিষ্ট এই ব্যক্তিত্বকে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। দেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতি জগতের এই বাতিঘরের আলো নিভে যায় গত ১৪ মে। মৃত্যুবরণ করলেন করোনা নিয়ে। লাখো মানুষের শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় করোনার নিয়ম মেনে সাদামাটা জানাজায় সমাহিত হলেন আজিমপুরে পিতার কবরের পাশে। দেশের আরেকজন প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন করোনা পজেটিভ হয়ে রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে তাকেও উন্নত চিকিৎসার জন্য রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে। তিনিও এখন প্রায় সুস্থ। দেশের দুজন বরেণ্য ব্যক্তিত্বের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এই উদ্যোগ ছিল প্রশংসনীয়। তাদের মতো মানুষ আমাদের দীর্ণ সমাজে বড় বেশি প্রয়োজন। তাই সুচিকিৎসার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগটি অত্যন্ত জরুরি ছিল। একই সঙ্গে এই কথাও অনস্বীকার্য যে, করোনাক্লিষ্ট এই দেশে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি তা হলো চিকিৎসা। চিকিৎসা নিয়ে হাজারো সাধারণ মানুষের অসহায়ত্বে হতবিহ্বল সবাই। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দুরবস্থার কারণে সাধারণ মানুষ মৃত্যুর কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ করছে এমন অভিযোগ অনেকের। প্রশ্ন উঠছে, সাধারণ মানুষ কি তাহলে চিকিৎসা পাবে না? সাধারণ রোগীরা যাবে কোথায়? তাদের চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল কোনটি? দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় তাদের জন্য কোনো জায়গা কি নেই? দেশের বেসরকারি ও সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার যে বেহাল অবস্থার কথা উঠে এসেছে- তার প্রশ্নের কোনো উত্তর পাওয়া যাচ্ছে না। এই দেশটা তো সবার। সাধারণ মানুষ কেন চিকিৎসা পাবে না- বা কারো কাছে এই প্রশ্নের কেন উত্তর পাওয়া যাবে না?
করোনা ভাইরাস মহামারির মধ্যে কিডনির জটিলতায় অসুস্থ খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব গৌতম আইচ সরকারকে ৭টি হাসপাতালে ঘুরে কোথাও ভর্তি করাতে পারেননি তার চিকিৎসক মেয়ে ডা. সুস্মিতা আইচ। শেষ পর্যন্ত করোনা রোগী না হয়েও তাকে ভর্তি হতে হলো করোনা চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে। ডা. সুস্মিতা আইচ জানিয়েছেন, তার বাবার আইসিইউ সাপোর্ট দরকার ছিল। চিকিৎসাধীন ছিলেন ল্যাবএইডে। সেই হাসপাতাল জানাল তারা আইসিইউ সাপোর্ট দিতে পারবে না। শুরু হলো বাবা গৌতম আইচকে নিয়ে কন্যা সুস্মিতার এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ঘোরাঘুরি। ধানমন্ডির ল্যাবএইড থেকে গুলশানের ইউনাইটেড, ইউনাইটেড থেকে মহাখালীর ইউনিভার্সেল, ইউনিভার্সেল থেকে স্কয়ার, স্কয়ার থেকে আবার ধানমন্ডির আনোয়ার খান মর্ডান মেডিকেল, সেখান থেকে সোহরাওয়ার্দী, তারপর ঢাকা মেডিকেল, বঙ্গবন্ধু মেডিকেল, সবশেষে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। ঢাকা শহরের কোনো হাসপাতাল বাদ নেই। কিন্তু কোনো হাসপাতালই রাখতে রাজি হলো না সরকারের একজন অতিরিক্ত সচিবকে। চরম হতাশায় এক পর্যায়ে বাসায় নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। এরই মধ্যে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতলে একটি ‘সিট ম্যানেজ’ হয় সরকারের এই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার জন্য। কিন্তু তার মেয়ের অভিযোগ, সেখানে কোনো চিকিৎসাই হয়নি তার বাবার। শেষ পর্যন্ত গত ৯ মে কুর্মিটোলায় যখন গৌতম আইচ সরকার মারা যান, তখন তার মেয়ে ওষুধ খাওয়াচ্ছিলেন আর অক্সিজেন লাগাচ্ছিলেন তার ছেলে। কোনো চিকিৎসক যাননি একবারও রোগীকে দেখতে।
রাজধানীর শেওড়াপাড়ার রেবেকা সুলতানার বুকে ব্যথা শুরু হওয়ায় একে একে ৬টি হাসপাতালে নেয়া হয়। করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত নন- এমন সনদ দেখাতে না পারায় কোনো হাসপাতাল ভর্তি নিতে রাজি হয়নি। তিনটি সরকারি হাসপাতাল আর ৩৩৩ নম্বরে কল দিয়েও কোনো সহযোগিতা পাওয়া যায়নি। শেষ পর্যন্ত ৯ ঘণ্টা ধরে এ হাসপাতাল থেকে ওই হাসপাতালে ঘুরে গত ৭ মে বৃহস্পতিবার অ্যাম্বুলেন্সেই মারা গেলেন রেবেকা সুলতানা।
দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান ড. সাদ’ত হুসেইনের অসুস্থ স্ত্রী শাহানা চৌধুরীকে ভর্তি করানো যায়নি কোনো নামিদামি হাসপাতালে। গত ২২ এপ্রিল রাজধানীর একটি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন ড. সাদ’ত। তার স্ত্রীও শেষ পর্যন্ত মৃত্যুবরণ করছেন গত ১৩ মে। ইউনির্ভাসেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।
এ রকম বহু মানুষ চিকিৎসা না পেয়ে মারা যাচ্ছেন অকালেই। মনে হচ্ছে কারো কোনো দায়িত্বই নেই। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা স্বাক্ষরিত এক নির্দেশনায় বলা হয়েছে, সরকারি বা বেসরকারি হাসপাতালের কোনো মুমূর্ষু রোগীকে যদি করোনা আক্রান্ত বলে সন্দেহ হয় বা ওই হাসপাতালে যদি ভর্তি করানো সম্ভব না হয়, তাহলে সেক্ষেত্রে রোগীকে অপেক্ষমাণ রেখে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণ কক্ষে ফোন করে এই রোগীর চিকিৎসার ব্যাপারে পরামর্শ দিতে হবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এই অবাস্তব নির্দেশনায় সরাসরি বিরোধিতা করেছে বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। বারডেম হাসপাতালের মহাপরিচালক ডা. জাফর আহমেদ লতিফ এই নির্দেশনা বাস্তবসম্মত নয় উল্লেখ করে বলেন, হাসপাতাল থেকে রোগী ফিরিয়ে দেয়া যাবে না- এই নির্দেশনা দেয়ার আগে সব হাসপাতালে মানসম্মত পিপিই ও মাস্ক সরবরাহ করা প্রয়োজন ছিল। বোঝাই যাচ্ছে, সরকারি নির্দেশনার প্রতি বেসরকারি হাসপাতালগুলো কোনো তোয়াক্কাই করছে না। এই অবস্থায় হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ঘুরে বিনা চিকিৎসায় মরতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।
সম্প্রতি আমরা আমাদের দুজন ভোরের কাগজের সহকর্মীকে হারিয়েছি। আমাদের বিজ্ঞাপন বিভাগের নির্বাহী দেবদাস বাড়ৈ টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন ছিল। উচ্চ রক্তচাপের রোগী দেবদাসের স্ত্রী ল্যাবএইডের সিনিয়র নার্স। অসুস্থ দেবদাসের আইসিইউর চিকিৎসার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু ঢাকা মেডিকেলে আইসিইউ চিকিৎসা পাওয়া সাধারণ রোগীর জন্য প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। বহু চেষ্টা তদবির করে তার জন্য আইসিইউ বরাদ্দ করা হলেও সাধারণ ওয়ার্ড থেকে আইসিইউ পর্যন্ত নেয়ায় কোনো ওয়ার্ডবয় পাওয়া যায়নি। এক পর্যায়ে বুকের ব্যথা নিয়ে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে দেবদাস। আরেক সহকর্মী আমাদের রিপোর্টার আসলাম রহমানের উচ্চ রক্ত চাপের রোগ ছিল। তারপর ডায়রিয়া ও অন্যান্য উপসর্গের কারণে তার করোনা টেস্ট করানো হয়। করোনা পরীক্ষায় ফলাফল নেগেটিভ আসার পরও বুকে ব্যথা অনুভব করায় তাকে প্রথমে ইসলামিয়া হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তারা পাঠিয়ে দেয় ঢাকা মেডিকেলে। পথের মধ্যেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে আমাদের প্রিয় সহকর্মী আসলাম।
এ রকম হাজারো ঘটনা মানুষের অসহায়ত্ব আর স্বাস্থ্য ব্যবস্থার এক বিশৃঙ্খল চেহারাই তুলে ধরছে। করোনায় এই জটিল ও ভয়াবহ পরিস্থিতিতে আমরা এখনো সুশৃঙ্খল একটি চিকিৎসা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারছি না। অন্যদিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ‘সবকিছু ঠিক আছে, ইউরোপ-আমেরিকার চাইতে আমাদের অবস্থা অনেক ভালো’- এসব বক্তব্য মানুষকে আরো বেশি ক্ষুব্ধ করে তুলছে। সাত দিন ঘুরে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে করোনা পরীক্ষার নমুনা দিতে পারছে না সাধারণ মানুষ। বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয়ের ফিভার ক্লিনিকের সামনে রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে ওখানেই মৃত্যুবরণ করেছেন আবদুর রাজ্জাক নামের এক ব্যক্তি। নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে করোনা ভাইরাসের উপসর্গ নিয়ে মৃত্যুবরণ করে ২৪ বছরের যুবক রিমন সাউদ। করোনা পরীক্ষার জন্য নমুনা পাঠিয়ে রিপোর্ট না পাওয়ায় চিকিৎসা পায়নি রিমন। রিমনের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে হার্ট অ্যাটাক করেন বাবা ইয়ার হোসেন। ছেলের মৃত্যুর এক ঘণ্টা পর বাবাকেও মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক। দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার যখন এমন হৃদয়বিদারক চেহারা- নেবে, তা সম্ভবত আমরা কেউ কল্পনা করিনি। এর মধ্যেও যারা ‘সবকিছু ঠিক আছে বলেন’- তাদের ধিক্কার জানানো ছাড়া আর কী করার আছে অসহায় মানুষের। মানুষ যেন মনে মনে প্রস্তুত হয়ে আছে, মৃত্যুর কাছে অসহায় আত্মসমর্পণের।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রখ্যাত কবি সিলভিয়া প্লাথ ষাটের দশকের লিখেছিলেন, ‘মৃত্যু একটি নিপুণ শিল্প- আর অন্যসব কিছুর মতোই’। মাত্র ৩১ বছর বয়সে আত্মহত্যা করে মারা যাওয়ার আগে ‘লেডি লাজারাস’ কবিতায় তিনি লিখলেন, প্রত্যেকের জন্য মৃত্যু নির্ধারিত, তাই আমাদের উচিত মৃত্যুর কাছে আত্মসমর্পণ করা। করোনার দুর্যোগে বাংলাদেশের এই বেহাল চিকিৎসা ব্যবস্থায় আমরা মনে হয় মৃত্যুর কাছে নিজেদের আত্মসমর্পণ করে বসে আছি। অপেক্ষাটা শুধুমাত্র সময়ের।