চট্টগ্রাম নিয়ে আরো কিছু উদ্বেগ ও প্রতিক্রিয়ার জবাব
পোস্ট করেছেন: dinersheshey | প্রকাশিত হয়েছে: জুলাই ৯, ২০২০ , ৭:৫৬ পূর্বাহ্ণ | বিভাগ: সম্পাদকীয়
শ্যামল দত্ত, সম্পাদক : চট্টগ্রামে করোনা চিকিৎসার বেহাল অবস্থা নিয়ে গত মাসের শুরুর দিকে একটা লেখা লিখেছিলাম। লেখাটির শিরোনাম ছিল “চট্টগ্রাম নিয়ে কি চিন্তা করার কেউ নেই?”। এই লেখাটি পাঠকের মধ্যে যে এতটা প্রতিক্রিয়া তৈরি করবে, তা আমার ধারণার বাইরে। এই লেখা এবং লেখা থেকে প্রাপ্ত প্রতিক্রিয়ার পর আমার বিশ্বাস জন্মালো, লেখার বিষয়ে যদি বৃহৎ জনগোষ্ঠীর কথা থাকে, সেই লেখা মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যাবেই। আপনি কোথায় লিখছেন এবং, কোন মাধ্যমে লিখছেন, সেটা বড় কথা নয়। আপনি কী লিখছেন এবং কার জন্য লিখছেন, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। এই লেখাটিতে করোনা চিকিৎসায় চট্টগ্রামের মানুষের দুঃখ-দুর্দশা আর অসহায়ত্বের কথা ছিল বলেই মানুষ লেখাটি পড়েছে এবং অনেকে উদ্যোগ নিয়ে অন্যকেও পড়িয়েছে। করোনার এই কঠিন সময়ে মানুষ নিজের অসহায়ত্ব ও দুঃখ এবং ক্ষোভ দেখেছে লেখাটির মধ্যে। লেখাটি তাই এককভাবে লেখকের থাকেনি। করোনা
ক্লিষ্ট চট্টগ্রামের অসহায় মানুষের লেখা হয়ে গেছে এটা। একজন লেখকের জন্য এটাই হয়তো সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।
তবে অসংখ্য পাঠক বিভিন্নভাবে করোনাকালে চট্টগ্রামের চিকিৎসা ব্যবস্থা দুরবস্থা নিয়ে এই লেখার প্রশংসা করলেও কেউ কেউ যে বিরোধিতা করেননি, তাও নয়। চট্টগ্রামে আমার অনেক ব্যবসায়ী বন্ধু মনোক্ষুন্ন হয়েছেন, রাজনীতিবিদরা ক্ষুব্ধ হয়েছেন, মৌলবাদী গোষ্ঠী ক্ষোভ ঝেড়েছেন উচ্চারণ অযোগ্য সাম্প্রদায়িক গালাগালি দিয়ে। এ ধরনের অভিজ্ঞতা আমাদের জন্যে নতুন কিছু নয়। অসাম্প্রদায়িকতা, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলি বলেই সাম্প্রদায়িক ও ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর আক্রমণের শিকার বহু আগে থেকেই। ২০১৩ সালে বিএনপি জামাতের আন্দোলনের সময় আমাদের ভোরের কাগজ অফিসে আক্রমণ হয়েছে, ককটেল মেরেছে ও গাড়ি ভাঙচুর করেছে। আক্রমণ ও ভাঙচুরের সিসিটিভির ফুটেজ স্থানীয় পুলিশকে দেয়া হলেও কোনো আসামিকে তারা গ্রেপ্তার করতে পারেনি। বেনামী চিঠি, কাফনের কাপড় পাঠানো, সামাজিক মাধ্যমে কুৎসিত গালাগাল, ওয়াজ মাহফিলে নানা ধরনের হুমকি এখনো সামাজিক মাধ্যমে খুঁজলে পাওয়া যায়। ফলে এই খারাপ অভিজ্ঞতা আমার জন্য নতুন বিষয় নয়। মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার অব্যবস্থাপনা নিয়ে রিপোর্ট করার কারণে আওয়ামী ওলামা লীগ আমার বিরুদ্ধে মানববন্ধন করেছে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে। ওয়ার্কাস পার্টির এক নেতার মামলায় ঢাকা এবং রাজশাহীতে একযোগে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে কিছুদিন আগে। পূর্তমন্ত্রী থাকাকালে বিএনপি নেতা মির্জা আব্বাসের দুর্নীতি নিয়ে রিপোর্ট করায় কিশোরগঞ্জ আদালতে করা একটি মামলা এখনো চলছে। বিএনপির আমলে নিয়োগপ্রাপ্ত হাইকোর্টের এক বিচারপতির ভুয়া এলএলবি সার্টিফিকেট নিয়ে রিপোর্ট করার কারণে দায়ের করা মানহানি মামলার শুনানি এখনো সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে বিচারাধীন আছে। তাই এ ধরনের হুমকিতে বিচলিত না হয়ে সত্যনিষ্ঠ থাকার নীতি গ্রহণ করেছি। সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলার নীতি অনুসরণ করলে হুমকি-ধামকি থাকবেই। সাংবাদিকতায় এমন কোনো পদ্ধতি নেই যা দিয়ে সকল পক্ষকে খুশি করা যায়। লেখা কারো অন্যায়ের বিরুদ্ধে গেলে তারা আপনার বিরুদ্ধে লাগবেই। তাই সত্যের প্রতি অবিচল থাকাই গুরুত্বপূর্ণ। সত্যের পক্ষে থাকার কাজটা সবসময় যে ঠিকমতো করতে পারি তাও কিন্তু নয়। বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থা এখনো সত্যকে পুরোপুরি গ্রহণ করার মতো তৈরি হয়নি, এই বাস্তবতাটুকু স্বীকার করতে দ্বিধা নেই।
আমার কয়েকজন ব্যবসায়ী বন্ধু বলেছেন, চট্টগ্রামের চিকিৎসা সংকটের সব দোষ ব্যবসায়ীদের ওপর চাপিয়ে দিয়ে রাজনীতিবিদদের বাঁচিয়ে দিয়েছি। অথচ রাষ্ট্রপরিচালনার মূল দায়িত্ব তো রাজনীতিবিদদের। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়নে চট্টগ্রামে যদি কিছু না হয়ে থাকে, তার দায় ব্যবসায়ীদের কেন হবে? আমার ব্যবসায়ী বন্ধুরা হয়তো খেয়াল করেননি, এই লেখাটি একটি বিশেষ প্রেক্ষাপটে লেখা। হাজার হাজার কোটি টাকার মালিকরা যখন করোনার কাছে অসহায়ভাবে আত্মসমর্পণ করে মৃত্যুবরণ করছে, হাসপাতাল নেই, আইসিইউ নেই, এমনকি একটি অক্সিজেন সিলিন্ডারের জন্য এই ধনাঢ্য ব্যক্তিদের অসহায়ত্ব ছিল এই লেখার মূল বিষয়। সেজন্যই ব্যবসায়ীদের দায়িত্বের কথাটা সামনে চলে এসেছে। যারা ইচ্ছে করলে করোনার এই দুর্যোগের এক সপ্তাহ বা ১০ দিনের মধ্যে আধুনিক সুবিধা সম্বলিত একটা হাসপাতাল নিজেরাই বানাতে পারেন, একটি আইসিইউ-এর জন্য তাদের মৃত্যু চট্টগ্রামের মানুষকে ক্ষুব্ধ করেছে। অর্থের যোগান দেয়া সম্ভব হলে ১০দিনের মধ্যে হাসপাতাল তৈরির রেকর্ড পৃথিবীর অনেক দেশে আছে। তারপরও চট্টগ্রামের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার এই দুরবস্থায় দলমত নির্বিশেষে সকল রাজনীতিবিদের দায় কম উল্লেখ করা হয়নি। বাংলাদেশের বিগত ৫০ বছরে বিভিন্ন সরকারের সময় রাজনীতিবিদরা চট্টগ্রামের উন্নয়নে মনোযোগী হননি একথা কয়েকবার উল্লেখ করা হয়েছে এই লেখায়। তবে লেখাটি প্রকাশিত হওয়ার পর সবচেয়ে বেশি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন একজন পীরের অনুসারীরা, যে পীরের নামও উল্লেখ করা হয়নি এই লেখায়। যেহেতু আমার লেখায় অন্য একটি দেশ থেকে আগত এই পীরের নাম উল্লেখ ছিল না, তাই এখানেও আর সেই নামটি উল্লেখ করছি না। এই পীরের অনুসারীরা ধরে নিয়েছেন আমি আমার লেখায় তাদের পীরের কথাই উল্লেখ করেছি। তাই তারা টেলিফোনে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন, লিগ্যাল নোটিশ পাঠিয়েছেন, মামলার হুমকিও দিয়েছেন- এমনকি ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে মামলা করবেন বলেও জানিয়েছেন। এই পীরের একজন মুরিদ ফোনে জানিয়েছে বাংলাদেশের দুশ’রও বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চলে এই পীরের অর্থায়নে। আমার স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে, এই তথ্যটি আমার অজানা ছিল।
বাংলাদেশের দুশ’র বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যদি ভিন্ন একটি দেশ থেকে আগত পীরকে চালাতে হয়, তাহলে বুঝতে হবে যে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় গলদ আছে। এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে কী ধরনের শিক্ষা দেওয়া হয় বা এই প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে কী ধরনের শিক্ষিত জনগোষ্ঠী বেরিয়ে আসে, তারও একটি যথার্থ মূল্যায়ন হওয়া দরকার। যাইহোক, এই ধরনের জনগোষ্ঠীর ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হয়, লেখাটি বিদ্যমান প্রকৃত সংকটকে তুলে ধরতে সমর্থ হয়েছে। অন্যথায় তাদের এত তীব্র প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করার কথা নয়। একটা কথা মনে রাখা দরকার, এই লেখাটি একটি প্রতিষ্ঠিত এবং প্রচলিত গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এটি কোনো সামাজিক মাধ্যমের লেখা নয়। সামাজিক মাধ্যম বা সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশিত লেখার কোনো দায়বদ্ধতা থাকে না। কিন্তু প্রচলিত এবং প্রতিষ্ঠিত গণমাধ্যমে একটি সম্পাদকীয় নীতি থাকে, যা অনুসরণ করেই লেখক তার মত প্রকাশ করেন এবং সেই নীতির আলোকেই লেখা প্রকাশিত হয়। আমাদের দেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতা সংবিধান স্বীকৃত। সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে মত প্রকাশের এই স্বাধীনতা সুনির্দিষ্টভাবে নিশ্চিত করা আছে। সংবিধানে একই সঙ্গে দায়বদ্ধতার কথাও উল্লেখ করা আছে।
এই লেখায় আর একটি মৌলিক প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়েছিল চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক সংকট নিয়ে। সংস্কৃতির ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ ও বৈচিত্রের সমাহারে উজ্জ্বল চট্টগ্রামের বর্তমান সাংস্কৃতিক সংকট যে কত গভীর, তা এই লেখার প্রতিক্রিয়াতেও সে বিষয়টা প্রকট। মানুষ এখনও ধর্মীয় পরিচয়ে গালাগাল দেয়, লেখকের ধর্মীয় পরিচয়ও একটা বিষয়- সেটা এই লেখার প্রতিক্রিয়াতে তা আবার দেখা গেল। কিন্তু চট্টগ্রামের চরিত্রগত পরিবর্তনের বিষয়টি অনেকে আবার স্বীকারও করেছেন। চট্টগ্রামের একটি থানা সাতকানিয়ায়কে যখন সাতক্ষীরার সাথে তুলনা করা হয়, তখন সীমান্তবর্তী সাতক্ষীরার মৌলবাদী চরিত্র কী করে সাতকানিয়া পেল- তার একটা সামাজিক-রাজনৈতিক গবেষণা হওয়া দরকার। ২০১৩ সালে বিএনপি জামাতের অবরোধ আন্দোলনে সাতক্ষীরা যেমন অবরুদ্ধ ছিল, সাতকানিয়াও তাই। মৌলবাদী তাণ্ডবে উভয় শহর ছিল বিপর্যস্ত। সাতকানিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আমাকে জানিয়েছেন, এই উপজেলায় মাধ্যমিক স্কুল ৪২টি। অথচ দাখিল ও কওমি মিলে মাদ্রাসার সংখ্যা ৭৬টি। সামগ্রিকভাবে মাদ্রাসা শিক্ষার এই ব্যাপক বিস্তারের কারণ কী-তা আমার আগের লেখাতে উল্লেখ করেছি, তাই এখানে আর সেটা আনতে চাই না। উচ্চশিক্ষা ও মর্যাদার পেশাতে চট্টগ্রামের অংশগ্রহণ দিন দিন কমছে, এটাই বাস্তবতা। সামগ্রিকভাবে বৃহত্তর চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র হারিয়ে যাওয়ার পেছনে কী গভীর চক্রান্ত কাজ করছে, তাও আমাদের ভেবে দেখা দরকার। ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর জামাতে ইসলামীর রাজনীতি উন্মুক্ত হওয়া ও ইসলামী ছাত্র শিবিরের কর্মকাণ্ডের প্রধান কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল চট্টগ্রাম। যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেম আলীর নেতৃত্বে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে জামাতের নানা কর্মকাণ্ড শুরু হয় চট্টগ্রাম থেকেই। সৌদি আরবের অর্থায়নে বৃহত্তর চট্টগ্রামের উখিয়ায় রাবেতা আলম আল ইসলামীর যাত্রা শুরু হয়।
রোহিঙ্গা শরণার্থী সহায়তা কর্মসূচির নামে এই সংগঠন চট্টগ্রামের জঙ্গি কার্যক্রমের সূচনা করে বলে অভিযোগ রয়েছে। এইভাবে পুরো আশির দশক জুড়ে চট্টগ্রামের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দখল ও নানা কর্মকাণ্ড বিস্তৃত করেছে এই মৌলবাদী সংগঠন গুলো। ৭৫ পরবর্তী সেই সাম্প্রদায়িক রাজনীতির কালো ছায়া এখনো চট্রগ্রামে ঢেকে আছে, এই অভিযোগ অনেকের। এর জন্য চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ-বিএনপি রাজনীতিবিদদের অন্তর্কোন্দলও কম দায়ী না। চট্টগ্রামের রাজনৈতিক বিভাজন শুধু প্রধান দল নয়, দলের অঙ্গ সংগঠন পর্যন্ত ছড়িয়েছে আছে। এই বিভক্তি শুধু চট্টগ্রাম শহর নয়, গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত বিস্তৃত। এমনকি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়গামী একটি শাটল ট্রেনের বগিতে বগিতে বিভক্তি আছে। এক বগির গ্রুপের সঙ্গে অন্য বগির গ্রুপের মারামারি, খুনোখুনি ও হানাহানির ঘটনা, বাংলাদেশ কেন- পৃথিবীর আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না চট্টগ্রামের স্বাস্থ্য খাতেও এই দলাদলির বিভাজন প্রকাশ্য। চিকিৎসা ব্যবস্থার বর্তমান দুরবস্থার জন্য এটাও একটা অন্যতম কারণ বলে অনেকে মনে করেন। বিএমএ ও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের নেতাদের কোন্দলের ভিকটিম হয়ে মারা যাচ্ছে অসহায় সাধারণ মানুষ।
এত আলোচনা সমালোচনার মধ্যে বিগত এক মাসে চট্টগ্রামের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে এমন বলা যাবে না। তবে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী- রাজনীতিবিদরা আগের চাইতে কৌশলী হয়েছেন। করোনা আঘাতে হানলেই তারা ঢাকা চলে আসেন। যেহেতু ঢাকার তারকা হাসপাতালগুলো করোনা চিকিৎসা শুরু করেছে, তাই চট্টগ্রামের ধনাঢ্য ব্যক্তিদের ঢাকার এমন হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। তবে এর মাঝে চট্টগ্রামে করোনা চিকিৎসার উন্নয়নে বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে যা অবশ্যই প্রশংসনীয়। বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় রোগীদের চিকিৎসায় একশো বেডের হাসপাতাল তৈরি করেছে। একটি কমিউনিটি সেন্টারকে হাসপাতাল রূপান্তরিত করা এই হাসপাতালে আইসিইউ সুবিধা না থাকলেও অক্সিজেন সরবরাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে। বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের চট্টগ্রামের সমন্বয়কারী জামাল উদ্দিন জানিয়েছেন, সাধারণ মানুষের আর্থিক সহযোগিতায় এই হাসপাতাল গড়ে তোলা হয়েছে। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার মাহবুবুর রহমান রিপন ভাইয়ের উৎসাহ আর সহযোগিতা ছিল অপরিসীম। তিনি নিজেও করোনা আক্রান্ত ছিলেন। কিন্তু সাধারণ মানুষের করোনা চিকিৎসার জন্য এই হাসপাতাল নির্মাণে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের ভূমিকা প্রশংসনীয় হয়ে থাকবে।
এরমধ্যে চট্টগ্রামের বেশ কিছু শিল্প গ্রুপ ও ব্যবসায়ী সমাজ এগিয়ে এসেছেন করোনা রোগীদের চিকিৎসা সহায়তায়। এস আলম গ্রুপ তাদের পরিবারের অভিভাবক তুল্য বড় ভাইকে হারিয়ে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা চালুসহ অন্যান্য যন্ত্রপাতি দিয়ে সহযোগিতা করেছে। বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করতে টি কে গ্রুপ হাই ফ্লো অক্সিজেন সরবরাহের যন্ত্রপাতি দিয়েছেন। প্রিমিয়ার সিমেন্টের স্বত্বাধিকারী ও সিকম গ্রুপের কর্ণধার বন্ধুবর আমিরুল হক মা ও শিশু হাসপাতালসহ অন্যান্য হাসপাতালের করোনা চিকিৎসা বিভিন্ন যন্ত্রপাতি দিয়েছেন। আরো অনেক ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ ও সাধারণ মানুষ ব্যক্তিগত উদ্যোগে সহায়তার হাত বাড়িয়েছেন বলে জানতে পেরেছি। আমি মনে করি না আমার এলাকার কারণেই এই উদ্যোগগুলো তারা নিয়েছেন। তারা নিজের তাগিদে, চট্টগ্রামকে ভালোবেসে, চট্টগ্রামের মানুষের জন্য এই কাজগুলো করেছেন। সামগ্রিক উদ্যোগে সরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা ব্যবস্থায় কিছুটা শৃঙ্খলা ফিরে আসলেও প্রাইভেট হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে নানা অভিযোগ অব্যাহত আছে। ম্যাক্স হাসপাতাল ও পার্কভিউ হাসপাতালসহ বেশ কয়েকটি হাসপাতালের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ গণমাধ্যমে এসেছে। ঢাকার অবস্থাও একই রকম। বেসরকারি হাসপাতালে স্বাস্থ্য কার্যক্রম মনিটরিংএ সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের চরম গাফিলতিতে অসহায় সাধারণ রোগীরা। ৩০ মিনিট অক্সিজেন দিয়ে লাখ লাখ টাকা বিল করার পর গণমাধ্যমে তুমুল সমালোচনায় প্রাইভেট হাসপাতালগুলো টাকা ফেরত দিতে বাধ্য হয়েছে। ঢাকা এবং চট্টগ্রাম উভয় শহরে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগকে এর জন্য দায়ী মনে করছেন অনেকে। গত একমাসে চট্টগ্রামে বেশ কয়েকজন সিনিয়র ডাক্তার ও আইনজীবীসহ অন্যান্য পেশার মানুষকে আমরা হারিয়েছি, যাদের মৃত্যু এই সময়ে কাম্য ছিলনা।
হাসপাতালে সঠিক চিকিৎসা পেলে হয়তো তাদের মৃত্যু ঠেকানো যেত। কিন্তু বাংলাদেশের সামগ্রিক চিকিৎসা ব্যবস্থার অব্যবস্থাপনার বলি হয়ে গেলেন তারা। তাদের পরিবারের প্রতি গভীর সহানুভূতি ও সমবেদনা জানাই। এছাড়া আমার এই লেখার কারণে যারা ব্যথিত হয়েছেন, ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন, তাদেরকেও ধন্যবাদ। কারণ তারা আমার লেখাটি পড়ে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন। সবাইকে একই বিষয়ে একমত হতে হবে, এমনটা হয় না। আমরা এমন একটি সমাজ চাই, যে সমাজের সবাই সবার মতামত প্রকাশ করতে পারে। সেজন্যই সমাজবিজ্ঞানী ভলতেয়ার বলেছিলেন, “আমি আপনার মতের সাথে একমত না হতে পারি, তবে আপনি যাতে আপনার মত প্রকাশ করতে পারেন, তার জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত আছি”। অন্যের মতটি যদি ভিন্ন মতও হয়, তার প্রতি শ্রদ্ধা দেখানোর শালীনতা যেন আমরা ভুলে না যাই। ভিন্ন মতকে দমন নয়, ভিন্নমতকে সাথে নিয়ে থাকাটাই আধুনিক সমাজের সৌন্দর্য। আমরা তো সবাই জানি, সমাজে সহনশীলতা ও পরমত সহিষ্ণুতা না থাকলে উগ্রবাদের বিকাশ ঘটে। শ্রীচৈতন্যের অমিয় বাণী হচ্ছে, ঘাসের মতো বিনম্র হও, আর গাছের মতো সহনশীল হও। পায়ের নিচে পড়ে থাকা ঘাস আর মাথার উপরে নুইয়ে পড়া গাছকে দেখলে কী আমরা বুঝি তাদের কাছ থেকে আমাদের কত কিছু শিক্ষণীয় আছে?