‘আল্লাহর ওয়াস্তে’ লকডাউন শুরু
পোস্ট করেছেন: dinersheshey | প্রকাশিত হয়েছে: জুলাই ২, ২০২১ , ১:১৫ অপরাহ্ণ | বিভাগ: সম্পাদকীয়
শ্যামল দত্ত, সম্পাদক,
অবশেষে ‘আল্লাহর ওয়াস্তে’ লকডাউন শুরু হয়েছে। লকডাউনের প্রথম দিনটি ছিল বৃষ্টিমুখর। বৃষ্টিই অর্ধেক লকডাউন করে দিয়েছে। এর মধ্যেও অনেকে বেরিয়েছেন লকডাউন দেখতে। দেশের বিভিন্ন শহরে লকডাউন দেখতে বের হওয়া পাঁচশোর বেশি মানুষ গ্রেপ্তার হয়েছে, কেউ কেউ জরিমানা দিয়ে রেহাই পেয়েছে। বাঙালিকে ঘরে রাখা খুবই কঠিন। নানা অজুহাতে বের হতেই হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গত কয়েক দিন থেকেই হুঁশিয়ার করে দিচ্ছিল, বিনা কারণে বের হলেই গ্রেপ্তার, জরিমানা ও জেল। বাঙালি কি এইসব হুমকিতে ভয় পায়? অসম্ভব, প্রশ্নই আসে না। বাইরে লকডাউন চলছে, দেখতে হবে না? দেখতে গিয়ে এখন অনেকের জরিমানা এবং হাজতবাসও দেখা হয়ে গেল।
অনেকের মনে হয়তো প্রশ্ন, ‘আল্লাহর ওয়াস্তে’ লকডাউনটা আবার কী জিনিস? তাহলে গল্পটা বলি। বেশ কয়েক বছর আগে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে ক্লোজডোর বাস সার্ভিস শুরু হলো। কদিন পরে দেখা গেল রাস্তায় কিছুক্ষণ পরপরই লোক উঠছে বাসে। ক্লোজডোর আর থাকল না। কিছুক্ষণ পরপরই দরজা খুলে যায়। মানুষ আর বিশ্বাস করে না এই ক্লোজডোর সার্ভিসকে। এরপর বিশ্বাস করানোর জন্য শুরু হলো ‘সত্যি সত্যি ক্লোজডোর সার্ভিস’। বাসের আয়নায় কাগজ দিয়ে লিখে দেয়া হলো এই বিশেষ সার্ভিস। কয়েক দিন পরে দেখা গেল ‘সত্যি সত্যি ক্লোজডোর’ও আর ক্লোজডোর না। কিছু দূর যেতে না যেতেই বাসে লোক উঠছে। এরপর শুরু হলো ‘আল্লাহর ওয়াস্তে ক্লোজডোর সার্ভিস’। একের পর এক বিশ্বাস ভঙ্গের কারণে মানুষের আস্থা উঠে গেল এ সার্ভিসের ওপর থেকে। লকডাউনের ক্ষেত্রেও লকডাউন, সীমিত লকডাউন, সিরিয়াস লকডাউন, শাটডাউন- নানা উপাধি দিয়েও মানুষকে বিশ্বাস করানো যায়নি যে সরকার আসলেই একটা কঠোর লকডাউন চায়।
তাই এবার লকডাউন শুরুর আগে হাঁকডাকও ছিল অনেক। পুলিশ প্রশাসন দফায় দফায় প্রেস ব্রিফিং করে বলেছে, বের হলেই খবর আছে। কিন্তু মানুষ কতখানি সিরিয়াসলি নিয়েছে, সেটাই এখন দেখার বিষয়। এই সিরিয়াস লকডাউনের প্রথম দিনে মৃত্যু বাংলাদেশে সর্বোচ্চ। সংক্রমণ বাড়ছে আশঙ্কাজনক হারে। তারপরও মানুষ ঘর থেকে বের হচ্ছে লকডাউন দেখতে! বাঙালির মনটা এতটাই সন্দেহপ্রবণ যে লকডাউন আদৌ হচ্ছে কিনা, এটা তারা নিজের চোখে দেখে সন্দেহ দূর করতে চায়। কার্ল মার্কস বলেছিলেন, মানুষের মনটা হতে হবে সন্দেহপ্রবণ। সন্দেহ তৈরি না হলে মার্কসের যে তত্ত্ব, দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ, সেটাই বা কি করে হবে? বাঙালির মতো এ রকম কার্ল মার্কসের অনুসারী পৃথিবীতে বোধহয় খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে।
চট্টগ্রাম থেকে এক প্রবীণ রাজনৈতিক নেতা ফোন করে জানালেন, ভাই একটা ‘আল্লাহর ওয়াস্তে’ লকডাউন দিতে বলেন। সরকার লকডাউন ঘোষণা করে, কিন্তু এর মধ্যে সবই খোলা থাকে। মানুষ নির্বিকার জীবনযাপন করছে, মাস্ক ব্যবহারের কোনো বালাই নেই, সংক্রমণও বাড়ছে, মৃত্যুর হারও বাড়ছে। এ ধরনের লকডাউন ঘোষণা করে লাভ কী? এ যেন বিএনপির অবরোধ ঘোষণার মতো। একবার ঘোষণা করা হলে আর উঠানো হয় না, অবরোধ পালিত হোক বা না হোক। বিএনপির ২০১৮ সালে ঘোষিত অবরোধ এখনো চলছে, আনুষ্ঠানিকভাবে উঠানো হয়নি। সরকারের ঘোষিত লকডাউন কেন বিএনপির অবরোধের মতো হবে? ডাকবে অথচ পালিত হবে না। আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতার এ প্রশ্নের জবাব অবশ্য আমার কাছে ছিল না।
যা-ই হোক, যে নামেই ডাকি না কেন, একটা লকডাউন তো শুরু হলো এবং সেটা সাতদিনের। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ ছিল ১৪ দিনের একটা লকডাউন দেয়ার। সংক্রমণের এ ভয়ানক সাইকেল ভাঙতে হলে লম্বা লকডাউনের বিকল্প নেই। পৃথিবীর অনেক দেশ এর উপকার পেয়েছে। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে এই ডেল্টা ভাইরাস সবকিছু ওলট-পালট করে দিয়ে এখন কিছুটা স্তিমিত হয়েছে কড়া লকডাউন অনুশাসনের কারণে। কিন্তু বাংলাদেশে এই লকডাউনের উপকারিতা নিয়ে নানা মত আছে। দেশের পোশাকশিল্প কারখানা খোলা থাকবে, সীমিত পর্যায়ে ব্যাংক খোলা থাকবে, সরকারি-বেসরকারি অফিস খোলা থাকবে, কাঁচাবাজার খোলা থাকবে, হোটেল রেস্টুরেন্টে পার্সেল সার্ভিস চালু থাকবে, রিকশা চলবে, মোটরসাইকেলও চলবে। সরকারি-বেসরকারি অফিস যেহেতু সীমিত পর্যায়ে খোলা থাকবে, ফলে তাদের যানবাহনও চলবে। এর মধ্যে এ সিরিয়াস লকডাউনও চলবে, আবার লকডাউনের উপকারিতাও আমাদেরকে পেতে হবে।
টেলিভিশনের টকশোতে হয়তো তুমুল বিতর্ক চলবে, এভাবে লকডাউন চললে কোনো উপকারিতা পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। আবার পাল্টা যুক্তিও দেবেন কেউ কেউ। বাংলাদেশের মতো পৃথিবীর সবচেয়ে জনঘনত্বের দেশে আদৌ লকডাউন কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব কিনা। তর্ক চলতেই থাকুক। বাঙালি অত্যন্ত তর্কপ্রিয় জাতি। বাংলাদেশের একটি চায়ের দোকানে যে পরিমাণ বিতর্ক হয়, পশ্চিমা উন্নত গণতন্ত্রের দেশে সংসদেও এ রকম বিতর্ক হয় কিনা সন্দেহ। এ রকম তর্কবিতর্কের মধ্যে দুটি সুসংবাদ আছে। এর মধ্যে একটি অন্তত আপনারা ইতিমধ্যে জেনে গেছেন। প্রথমটি হচ্ছে, আগামীকালের মধ্যেই ৪৫ লাখ নতুন ভ্যাকসিন আসছে বাংলাদেশে। ফলে ভ্যাকসিনের সংকট কিছুটা কেটে যাবে বলেই ধারণা করা যাচ্ছে। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, লকডাউনের প্রথম দিনটি ছিল সরকারের অর্থবছরের প্রথম দিন। এই দিনে লকডাউন দেখতে যাওয়া মানুষজনকে জরিমানা করে সরকারের বিপুল পরিমাণ অর্থ আদায় হয়েছে, যদিও লকডাউনের কারণে সরকারের অন্যান্য কার্যক্রম এদিন বন্ধ ছিল। এ রকম জরিমানা যদি আরো কিছু দিন চলতে থাকে, তাহলে সরকারের রাজস্ব আদায়ে একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়তে বাধ্য!
যা-ই হোক, মানুষের জীবন তো সুসংবাদ আর দুঃসংবাদে মিশ্রিত এক সময়। মানুষ প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে দিন শুরু করে একটা ভালো সময়ের প্রত্যাশায়। কিন্তু সেটা তো আর সব সময় হয়ে ওঠে না। এই করোনা ভাইরাস মানুষের জীবনকে যেভাবে উল্টেপাল্টে দিয়েছে, যেভাবে জীবনকে শঙ্কার মধ্যে ফেলেছে, এটা কবে শেষ হবে তা তো বলা কঠিন। পৃথিবীতে হয়তো এমন কোনো পরিবার খুঁজে পাওয়া যাবে না, যাদের আঘাত করেনি এ করোনা ভাইরাস। কিন্তু এর মধ্যেও কিছু মৃত্যু মেনে নেয়া এত কঠিন মনে হয়, যেন একটু সচেতন হলেই ঠেকানো যেত এই অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যু।
সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে হঠাৎ অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ হয়ে বেশ কয়েকজন রোগী মৃত্যুবরণ করেছেন। এই মৃত্যুর জন্য আপনি কাকে দায়ী করবেন। একটা জেলা শহরের আইসিইউতে আমরা নিরবচ্ছিন্ন অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারছি না। চিকিৎসাধীন মানুষ অসহায়ের মতো মারা যাচ্ছে। অন্যদিকে গতকাল রাজশাহী নগরীতে শিল্পা খাতুন নামে এক ভদ্রমহিলা ১৪ বছর পর একটি কন্যাসন্তানের জন্ম দেয়ার ১১ দিনের মাথায় করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। ১১ দিন বয়সি এই শিশুটি কোন পৃথিবীর মুখোমুখি হবে? স্রষ্টা এই মাতৃহারা মেয়েটির জন্য কোন বাস্তবতা তৈরি করলেন? এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর পাওয়া খুবই কঠিন। আমরা এমন এক সময়ে বসবাস করছি, যা আমাদের জীবনকে প্রশ্নময় ও উত্তরহীন করে তুলেছে।
শেষ করব আমাদের গৌরব, অহংকার আর হতাশার কথা বলে। গতকাল ১ জুলাই ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০০ বছর পূর্তির দিন। সঙ্গত কারণেই কোনো অনুষ্ঠান নেই এ দিনে। বাংলাদেশের রাজনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতিতে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা অপরিসীম। অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী লিখেছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে মায়ের সঙ্গে তুলনা করার রেওয়াজ আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের কাছে মাতৃসম। অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান আমাদের এমন স্নেহে এবং এতটা সময় ধরে শেখায়নি। ১০০ বছর বয়সী সেই মায়ের আজ কি অবস্থা, সেটা বোধহয় বলার প্রয়োজন নেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক রমেশচন্দ্র মজুমদারের স্মৃতিকথামূলক গ্রন্থ ‘জীবনের স্মৃতিদ্বীপে’ থেকে ছোট্ট একটি উদ্ধৃতি উল্লেখ করতে চাই। তিনি লিখেছেন, শুরুর দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরির জন্য বরাদ্দকৃত ৩০ হাজার টাকার অর্ধেক চলে যেত চুরি ঠেকানোর জন্য নিয়োগকৃত দারোয়ান, বেয়ারা ও কর্মচারীদের বেতনে। অথচ লন্ডনের লাইব্রেরিতে গিয়ে তিনি দেখেছেন সবাই নিজ দায়িত্বে এন্ট্রি করে বই নিয়ে নেয়, কোনো কর্মচারী নেই। তিনি আফসোস করেছেন, পুরো টাকাটা লাইব্রেরির পেছনে ব্যয় করা গেলে অনেক সমৃদ্ধ লাইব্রেরি বানানো সম্ভব হতো। তিনি হতাশ হয়ে লিখেছেন, আমাদের দেশে শিক্ষিত মানুষের মধ্যে এ ধরনের নীতি জ্ঞানের বড়ই অভাব।’ বর্তমানে আমাদের দেশের শিক্ষিত মানুষের নীতি জ্ঞান ও প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরির বর্তমান অবস্থা আর এখানে উল্লেখ করলাম না।