যে রুটে পাচার
খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘ভুক্তভোগীদের অবৈধভাবে নৌ-পথে ও স্থলপথে সীমান্ত পারাপার করানো হতো। কয়েকটি ধাপে পাচার করতো চক্রটি। প্রথমত, সোহাগ ও চক্রের অন্য সদস্যরা অল্পবয়সী তরুণীদের ভারতে ভালো বেতনের চাকরির প্রলোভন দেখাতো। প্রলুব্ধ ভিকটিমকে পরে কাল্লুর কাছে বুঝিয়ে দেওয়া হতো। কাল্লু নিজে বা সোহাগসহ অন্যদের মাধ্যমে সাতক্ষীরার সীমান্তবর্তী এলাকার বিল্লালের ‘সেফ হাউজে’ রাখতো ভিকটিমকে। সাতক্ষীরার সীমান্ত এলাকায় এমন চারটি সেফ হাউজ আছে বিল্লালের। সময়মতো ‘লাইনম্যান’-এর মাধ্যমে ভিকটিমদের নৌকায় করে সীমান্ত পার করানো হতো। স্থলপথেও করতো পাচার। সেক্ষেত্রে বেছে নিতো তুলনামূলক অরক্ষিত সীমানা।
গ্রেফতারকৃতরা জানায়, পাচার হওয়ার পর সীমান্তবর্তী এলাকায় কয়েকদিন ভিকটিমদের রাখা হতো। পরে বিভিন্ন স্থানে তাদের বিক্রি করা হতো। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, চক্রটির টার্গেটে থাকতো দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত পরিবারের তরুণীরা। কালুর অন্যতম সহযোগী সোহাগের কাজ ছিল তাদের প্রলোভন দেখিয়ে ফাঁদে ফেলা। এ কাজে দেশের মোট ২০-২৫ জন জড়িত বলে জানা গেছে। সীমান্তে সমন্বয়কের কাজ করতো বিল্লাল। তাদের এ চক্রে নারী সদস্যও আছে।
মূলত ভিকটমিদের যৌন পেশায় বাধ্য করতে পাচার করা হতো বলে গ্রেফতারকৃতরা জানায়। চক্রটির বাকি সদস্যরা ঢাকার মিরপুর, তেজগাঁও, গাজীপুরসহ বেশকয়েকটি এলাকায় সক্রিয়। জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, রাজধানীর পল্লবী এলাকার চিহ্নিত মানবপাচারকারী কাল্লু। আট-দশ বছর ধরে মানবপাচারে যুক্ত সে। এ পর্যন্ত তার সিন্ডিকেট প্রায় দুই শতাধিক নারীকে পাচার করেছে বলে জানা গেছে জিজ্ঞাসাবাদে।
বিক্রি হয় দেড় লাখ টাকায়
কাল্লু জানায়, পাচার হওয়া একজন নারীকে বিক্রি করা হতো এক থেকে দেড় লাখ টাকায়। বিল্লাল প্রায় ৫-৭ বছর ধরে এ সিন্ডিকেটে যুক্ত। বিল্লালকে সহযোগিতা করে আসছিল তারই স্ত্রী রাজিয়া খাতুন। ২০১৮ সালে পল্লবী থানার মানবপাচার মামলায় একবছর কারাভোগ করেছে সে। এ ছাড়া ৪-৫ বছর আগে কাল্লুও কারাভোগ করেছে।
কাল্লু ও সোহাগ সম্পর্কে মামা-ভাগ্নে। সে-ও প্রায় ৫-৬ বছর ধরে নারীপাচারে যুক্ত। জিজ্ঞাসাবাদে সোহাগ দাবি করে মামার হাত ধরেই এ পথে এসেছে সে। এ ছাড়া সোহাগ মাদক ব্যবসাতেও জড়িত। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা আছে। দুই বছর কারাভোগও করেছে সে।
মেয়েকে উদ্ধারে ইচ্ছে করে পাচার মা
ভালো বেতনের প্রলোভন দেখিয়ে সতেরো বছরের এক কিশোরীকে ভারতে পাচার করে কাল্লু-বিল্লাল চক্র। মেয়ের খোঁজ না পেয়ে পাচারকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে নিজেও ভারতে পাচার হন মা। ভারতে গিয়ে কৌশলে পালিয়ে যান তিনি। খুঁজতে শুরু করেন মেয়েকে। কিছুদিন পর পশ্চিমবঙ্গের উত্তর দিনাজপুরের পানজিপাড়া যৌনপল্লীতে মেয়ের সন্ধান পান। এরপর সেখানকার জনপ্রতিনিধি ও অন্যদের সহযোগিতায় মেয়েকে মুক্ত করে নিয়ে আসেন। অবৈধভাবে সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশে আসার সময় বিএসএফ’র হাতে ধরা পড়েন তারা। দুজনের পুরো কাহিনি শুনে ও ঘটনার সত্যতা পেয়ে বিএসএফ তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থায় যায়নি। বিজিবির সঙ্গে পতাকা বৈঠক করে তারা মা ও মেয়েকে বাংলাদেশে ফেরত দেয়।
র্যাব জানায়, এ বছরের জানুয়ারিতে রাজধানীর পল্লবী এলাকায় মাকে না জানিয়ে তার ১৭ বছর বয়সী মেয়ে দালাল ধরে ভারতে চলে যায় চাকরির আশায়। স্বাবলম্বী হতে চাওয়া ওই কিশোরীকে পাচারকারীরা বিউটি পার্লারে চাকরির লোভ দেখায়। সাতক্ষীরা সীমান্ত পার হওয়ার সময় মেয়ে বুঝতে পারে তার ভুল। ওই সময় সে কোনোমতে মাকে পাচারের বিষয়টি জানায়। আর এতেই শেষরক্ষা হয় তার।