করোনার বড় ঢেউয়ের আশঙ্কা
পোস্ট করেছেন: dinersheshey | প্রকাশিত হয়েছে: জানুয়ারি ১১, ২০২২ , ৩:৫৪ অপরাহ্ণ | বিভাগ: /////হাইলাইটস/////
দিনের শেষে প্রতিবেদক : করোনার অতি সংক্রমক ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রনের ঝুঁকির মধ্যে ভারতে ডেল্টার প্রকোপ ফের ভয়াবহভাবে বেড়েছে। দেশটিতে এরই মধ্যে দৈনিক কোভিড শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ১ লাখ ৭৯ হাজার ছাড়িয়েছে। করোনার বড় ঢেউ সেখানে আছড়ে পড়তে পারে বলে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন। এ পরিস্থিতিতে গতবারের মতো এবারও সীমান্তের জেলাগুলো নতুন করে ভয় জাগাচ্ছে। বিশেষ করে সীমান্তবর্তী যেসব জেলার চোরাপথে সারা বছর দু’দেশের মানুষের অবৈধ যাতায়াত, চোরাচালান ও মাদক পাচার হয়-ওইসব এলাকা ফের করোনার হটস্পট হয়ে ওঠার শঙ্কা রয়েছে। অন্যদিকে ভারতে করোনা সংক্রমণ ভয়াবহ রূপ নেওয়ায় বাংলাদেশ থেকে সেখানে বেড়াতে ও চিকিৎসা সেবা নিতে যাওয়া বিপুলসংখ্যক মানুষের দেশে ফেরার হিড়িকে সংক্রমণ বাড়তে পারে বলে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন। তাদের ভাষ্য, স্থলবন্দরসহ বিভিন্ন পথে ভারত থেকে আসা মানুষের চাপ বাড়লে তাদের যথাযথভাবে স্ক্রিনিং ও স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা কঠিন হবে। এতে উপসর্গহীন করোনায় আক্রান্ত রোগী দেশে ঢুকে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া ভারত থেকে আসা পণ্যবাহী যানবাহনের চালকসহ অন্য শ্রমিকদের মাধ্যমে দেশে সংক্রমণ ছড়ানোর আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান মো. আলমগীরের দাবি, সংক্রমণ ঠেকাতে এরই মধ্যে সীমান্ত দিয়ে আসা-যাওয়া করা মানুষ এবং যানবাহনের ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন সতর্কতার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বেনাপোল বন্দর দিয়ে ভারতে যাওয়া এবং আসার ক্ষেত্রে যাত্রী সংখ্যা প্রতিদিন ৩০০ জনে সীমিত করা হয়েছে। সেই সঙ্গে ভারত থেকে আসা ট্রাকের সহযোগীর সংখ্যাও কমানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া স্থলবন্দরগুলোতে অ্যান্টিজেন টেস্টের মাধ্যমে দ্রম্নত কোভিড-১৯ শনাক্ত করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রসঙ্গত, যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে সবচেয়ে বেশি মানুষ ভারতে আসা-যাওয়া করে। স্বাভাবিক সময়ে কোনো কোনো দিন ১০ হাজারের মতো মানুষ আসা-যাওয়া করত। যাত্রী যাওয়া-আসার জন্য বর্তমানে বেনাপোল, বুড়িমারী এবং আখাউড়া-এই তিনটি স্থলবন্দর খোলা রয়েছে। স্বাস্থ্য-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্থলবন্দরে সতর্কতা বাড়ানো হলেও তা সংক্রমণ মোকাবিলার জন্য যথেষ্ট নয়। বিশেষ করে সীমান্তবর্তী জেলাগুলো এখনো ঝুঁকির মধ্যে রয়ে গেছে। কেননা বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ ঠেকাতে ভারতের সীমান্ত সংলগ্ন জেলাগুলোতে এখনো উল্লেখযোগ্য কোনো সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। উল্লেখ্য, কয়েক মাস আগে যখন বাংলাদেশে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল, সেটি প্রথমে সীমান্ত সংলগ্ন জেলাগুলোতেই দেখা গিয়েছিল। এদিকে ভারতে করোনার ভয়াবহ সংক্রমণের প্রভাব যে গতবারের মতো এবারও দেশের সীমান্ত জেলাগুলোতে পড়তে পারে তার আলামত এরই মধ্যে দৃশ্য হয়ে উঠছে। ঢাকা মহানগরীর বাইরে দেশের অন্যান্য এলাকায় রোগী শনাক্তের হার দুই থেকে আড়াই শতাংশের মধ্যে থাকলেও কয়েকটি সীমান্তবর্তী কয়েকটি জেলায় সংক্রমণের হার এর ব্যতিক্রম। গত ৭ জানুয়ারি রাজশাহী জেলায় ১৫৩ জনের নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে করোনা শনাক্ত হয় ২১ জনের। নমুনা পরীক্ষার অনুপাতে শনাক্তের হার ১৩ দশমিক ৭২। অথচ এদিন সারাদেশে করোনা শনাক্তের হার ছিল ৪ দশমিক ৮৬ শতাংশ। জেলা সিভিল সার্জন অফিস সূত্রে জানা যায়, গত বছরের শেষ সপ্তাহে (২৬-৩১ ডিসেম্বর) জেলায় নমুনা পরীক্ষা করা হয় ৯২৪ জনের। নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে ২৭ জনের শরীরে করোনা শনাক্ত হয়। এক সপ্তাহে গড় শনাক্তের হার ছিল ২ দশমিক ৯২।
চলতি বছর জানুয়ারির প্রথম ৬ দিনে নমুনা পরীক্ষা হয়েছে ৭৮৯ জনের, এতে করোনা শনাক্ত হয় ৫৩ জনের। গড় শনাক্তের হার ৬ দশমিক ৭২। এক সপ্তাহের ব্যবধানে জেলায় করোনা রোগী শনাক্তের হার বেড়েছে প্রায় আড়াই গুণ। রাজশাহীর ডেপুটি সিভিল সার্জন মো. রাজিউল হক বিষয়টি স্বীকার করেছেন। রাজশাহী বিভাগের নাটোর জেলায় উদ্বেগজনক পর্যায়ে করোনা শনাক্তের কথা স্বীকার করে স্থানীয় একজন স্বাস্থ্য কর্মকর্তা জানান, সেখানে গত এক সপ্তাহ করোনাভাইরাস পরীক্ষা করতে আসা মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। প্রতিদিন ২০-৩০ জন টেস্টের জন্য আসছে। এদের মধ্যে ৬-৭ শনাক্ত হচ্ছে। এ সময়ে এক দিনে ১১ জন শনাক্ত হওয়ারও রেকর্ড রয়েছে। শনাক্ত রোগীদের কোনো বিশেষ উপসর্গ নেই। তবে শারীরিক সমস্যার মধ্যে মাথাব্যথা ও কাশি আছে। নতুন করে সেখানে করোনায় আক্রান্ত রোগীদের একটি অংশ ভারত থেকে আসা আত্মীয়স্বজনের সংস্পর্শে এসেছেন বলে জানান ওই কর্মকর্তা। উল্লেখ্য, উত্তরাঞ্চলীয় নাটোর জেলার সঙ্গে ভারতের সরাসরি সীমান্ত নেই, কিন্তু অপর দুই সীমান্ত সংলগ্ন জেলা রাজশাহী এবং কুষ্টিয়ার মাঝখানে এই জেলার অবস্থান। দিল্লি-মহারাষ্ট্র-পশ্চিমবঙ্গসহ যেসব রাজ্যে সংক্রমণ বেশি সেখানে কারফিউ জারি, নানারকম বিধিনিষেধসহ বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। তবে ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা না থাকায় ভারতের সঙ্গে এখনো বাংলাদেশের নৌ, আকাশ এবং স্থলপথে যাত্রী আসা-যাওয়া চলছে। সীমান্তবর্তী কয়েকটি জেলার হাসপাতালকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বেনাপোল এবং বুড়িমারীসহ যেসব বন্দর দিয়ে পণ্যবাহী পরিবহণ যাতায়াত করে ওইসব এলাকায় সংক্রমণ একটু একটু করে বাড়ছে, কিন্তু স্থানীয় মানুষ আগের মতোই উদাসীন রয়ে গেছে।
সীমান্ত এলাকার জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সম্প্রতি ভারতে করোনা সংক্রমণ ভয়াবহ রূপ নেওয়ার পর সীমান্তে নজরদারি ও টহল বাড়ানো হয়েছে। স্থল ও নদীবেষ্টিত বিস্তীর্ণ সীমান্ত পথে কঠোর অবস্থান নিয়েছে বিজিবি। তবে এসবের পরও রাতের আঁধারে বিভিন্ন ভারতীয় পণ্য চোরাচালান ও ‘ধুর পাচার’ (মানুষকে অবৈধভাবে এপার-ওপার করাকে স্থানীয়ভাবে ধুর পাচার বলা হয়) পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। বরং আকস্মিকভাবে দেশের স্থলবন্দরে আসা-যাওয়া লোকের সংখ্যা সীমিত করায় ভারতে যাওয়া বিপুলসংখ্যক মানুষ অবৈধভাবে সীমান্ত পার হচ্ছে। বিশেষ করে সীমান্ত জেলাগুলোর যেসব মানুষ চিকিৎসা সেবা বা অন্য কোনো প্রয়োজনে বিনা পাসপোর্টে চোরাপথে ভারতে গেছেন, তারা তড়িঘড়ি করে ফিরে আসার চেষ্টা করছেন। অন্যদিকে ভারতীয় সীমান্তের জেলাগুলোতে স্থানীয় চোরাকারবারিরা আগের মতো ততটা সক্রিয় না থাকলেও সীমান্ত রক্ষাকারী বিজিবি-বিএসএফের চোখ ফাঁকি দিয়ে মাদকদ্রব্যসহ বিভিন্ন পণ্যের ছোটখাটো চালান নিয়মিত পাচার করছে। ফলে দুই দেশেই চোরাই মাল বহনকারীদের গোপন যাতায়াত অব্যাহত রয়েছে। এ প্রসঙ্গে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগের সাবেক প্রধান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, কয়েক মাস আগে ভারতীয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট সীমান্ত জেলাগুলো দিয়ে ঢুকে কেন্দ্র পর্যন্ত পৌঁছেছে। এবারও একই অঘটন ঘটতে পারে। তাই সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে সতর্কতা বাড়ানো জরুরি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক বলেন, ভাইরাস মিউটেশন হলে ভ্যারিয়েন্ট হতেই পারে। তাই নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রণকে এত গুরুত্ব না দিয়ে সামগ্রিকভাবে আমাদের চেষ্টা করতে হবে সংক্রমণ যেন না ছড়ায় সেই দিকে। সংক্রমণ ছড়ানো যদি প্রতিরোধ করা যায়, তাহলে নতুন ভ্যারিয়েন্টেও সংক্রমণ ছড়াবে না। এ জন্য সীমান্ত নজরদারি বাড়ানো জরুরি। আর যেখানে রোগী পাওয়া যাবে, সেই এলাকায় পরীক্ষা জোরদার করা, রোগীর সংস্পর্শে কারা এসেছেন তাদের খুঁজে বের করতে হবে।’ প্রশাসনিক সূত্রগুলো জানায়, ভারতের সঙ্গে যে ৩০টি সীমান্তবর্তী জেলা রয়েছে। এগুলো হলো-চট্টগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিলস্না, ফেনী, খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি, সাতক্ষীরা, যশোর, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ ও জয়পুরহাট। এছাড়া রংপুর বিভাগের পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, নীলফামারী, লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রাম এবং ময়মনসিংহ বিভাগের জামালপুর, শেরপুর, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা ও সিলেট বিভাগের সুনামগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ সীমান্তবর্তী জেলা। এ ৩০টি জেলার মধ্যে অন্তত ২০টি জেলার সীমান্ত পথে ভারতীয় পণ্য পাচার হয়। তবে এর মধ্যে মানব পাচার চলে গুটি কয়েক জেলার সীমান্ত পথে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দাবি, যেসব পথে চোরাচালান ও মানব পাচার হওয়ার অভিযোগ রয়েছে এ ধরনের সীমান্ত জেলাগুলোতে বিজিবি টহল আগের চেয়ে জোরদার এবং গোয়েন্দা নজরদারিও কয়েকগুণ বাড়ানো হয়েছে। ফলে সীমান্তের চোরাপথে আসা-যাওয়া কিছুটা কমেছে।