কেমন বিনয়ী ছিলেন হজরত মুহাম্মাদ (সা.) ?
পোস্ট করেছেন: delwer master | প্রকাশিত হয়েছে: মে ২০, ২০২২ , ১১:৩৫ পূর্বাহ্ণ | বিভাগ: ধর্ম ও জীবন
দেলোয়ার হোসাইন : তিনি ছিলেন প্রশস্ত হৃদয়-মহানুভব। সত্যবাদিতায় সবার আগে; নম্রতা আর কোমলতায় অনন্য, আচার-আচরণে অভিজাত। প্রথম যে তাঁকে দেখতো ভয় করতো কিন্তু যখনই কেউ তাঁর সঙ্গে মিশতো তাঁকে ভালোবাসতো। (তিরমিজি)
বিনয় ও মহানুভবতার এক অনন্য দৃষ্টান্ত মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। চরম বিপদেও তিনি ছিলেন বিনয় ও মহানুভবতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। কঠিন সব পরিস্থিতিতেও তিনি সাহাবিদের বিনয়ী হওয়ার দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন। তাঁর বিনয় ও মহানুভবতায় আকৃষ্ট হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছেন অসংখ্য মানুষ। আসুন! তাঁর সেসব বিনয় মহানুভবতার অনুকরণীয় অনন্য দৃষ্টান্তগুলো জেনে নিই… নবিজী কারো প্রতি কঠিন হৃদয় ছিলেন না। তিনি ছিলেন আচার-আচরণ ও বিনয়-নম্রতার তুলনাহীন সম্রাট। অন্ধকার যুগের চরম কঠিন মুহূর্তেও তিনি ছিলেন সবার জন্য বিনয়ী। কোরআনুল কারিমে তার বিনয় ও নম্রতার আচরণ ফুটে ওঠেছে এভাবে-
فَبِمَا رَحْمَةٍ مِّنَ اللهِ لِنْتَ لَهُمْ وَ لَوْ كُنْتَ فَظًّا غَلِیْظَ الْقَلْبِ لَا نْفَضُّوْا مِنْ حَوْلِكَ ۪.
‘আল্লাহর দয়ায় আপনি তাদের প্রতি কোমলহৃদয় হয়েছিলেন। যদি আপনি রূঢ় ও কঠোরচিত্ত হতেন, তবে তারা আপনার আশপাশ থেকে (সঙ্গ ত্যাগ করে) সরে পড়তো।’ (সুরা আল-ইমরান : আয়াত ১৫৯)
নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পরিচিত-অপরিচিত সব মানুষের সঙ্গে মিশতেন। সমাজের অসহায় ও নিম্ন শ্রেণির সবার কাছে তিনি ছিলেন একান্ত আপন। যে কেউ যে কোনো সময় তার সঙ্গে কথা বলতে পারতেন। তিনি কেমন মহানুভব ও বিনয়ী ছিলেন হাদিসে পাকে তার বৈশিষ্ট্য এভাবে বর্ণিত হয়েছে-
أَجْوَدُ النَّاسِ صَدْرًا، وَأَصْدَقُ النَّاسِ لَهْجَةً، وَأَلْيَنُهُمْ عَرِيكَةً، وَأَكْرَمُهُمْ عِشْرَةً، مَنْ رَآهُ بَدِيهَةً هَابَهُ، وَمَنْ خَالَطَهُ مَعْرِفَةً أَحَبَّهُ
’তিনি ছিলেন প্রশস্ত হৃদয়-মহানুভব। সত্যবাদিতায় সবার আগে; নম্রতা আর কোমলতায় অনন্য, আচার-আচরণে অভিজাত। প্রথম যে তাঁকে দেখতো ভয় করতো কিন্তু যখনই কেউ তাঁর সঙ্গে মিশতো তাঁকে ভালোবাসতো।’ (তিরমিজি)
এ কারণেই বিশ্বনবি ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ চারিত্রিক পবিত্রতার অধিকারী। যার ব্যাপারে আল্লাহর ঘোষণা ছিল এমন-
وَ اِنَّکَ لَعَلٰی خُلُقٍ عَظِیۡمٍ
‘আর নিশ্চয়ই আপনি মহান চরিত্রের উপর অধিষ্ঠিত।’ (সুরা কলাম : আয়াত ৪)
বিশ্বনবির বিনয়ের দৃষ্টান্ত
বিনয় ও মহানুভবতায় নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কত উঁচু মানের ছিলেন, তা একটি ঘটনা থেকেই প্রমাণিত। যেখানে তিনি ছিলেন বিনয়ী আবার সাহাবিদেরও বিনয়ী হওয়ার কথা বললেন। দৃষ্টান্ত হয়ে থাকা সেই ঘটনা কী? ‘যায়েদ ইবনে সানাহ।’ শুরুতে একজন ইয়াহুদি ধর্মজাযক ছিলেন। একবার নবিজী তার থেকে নির্ধারিত সময়ের জন্য কিছু ধার নিয়েছিলেন। ধার পরিশোধের সময় বাকি থাকতেই সেই ইয়াহুদি নবিজীর সঙ্গে চরম অবমাননাকর কাণ্ড ঘটিয়ে বসে। নবিজীর কাপড় গুটিয়ে ধরে। সে সময় হজরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুসহ সাহাবিদের সঙ্গে নিয়ে এক জানাজা থেকে ফিরছিলেন।
’যায়েদ ইবনে সানাহ’ কর্কশ কণ্ঠে উচ্চ ধ্বনিতে বলে ওঠে- ‘তোমরা বনি আবদুল মুত্তালিবের বংশধর; ঋণ পরিশোধে বড়ই টালবাহানা করছো! ঘটনাটি হজরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু মেনে নিতে পারেননি। ইয়াহুদির এমন আচরণ তিনি রাগে গর্জে উঠেন। হজরত ওমরের রাগ দেখে নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাসলেন, পরক্ষণেই তিনি কোমলকন্ঠে বললেন-
হে ওমর! এ মানুষটি (ইয়াহুদি) তোমার কাছে উত্তম আচরণ পাওয়ার যোগ্য ছিল। কেননা আমি এবং সে দুজনই তোমার কাছে অন্য কিছুর মুখাপেক্ষী ছিলাম। তাহলো এই যে- ‘তুমি আমাকে সুন্দরভাবে ঋণ পরিশোধ করতে বলবে। আর তাকে (ইয়াহুদিকে) সুন্দরভাবে তার পাওনা তলব করতে বলবে।’ যদিও সে সময় ইয়াহুদির এ আচরণ করার সময় হয়নি। তখনও ঋণ পরিশোধের নির্ধারিত সময় তিনদিন বাকি ছিলো। তারপরও নবিজী বিনয় ও মহানুভবতার পরিচয় দিলেন। সাহাবিদের বিনয়ী হতে পরামর্শ দিলেন।
তারপরের ঘটনা আরও আশ্চর্যের!
এরপর নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুকে নির্দেশ দিলেন, ‘হে ওমর! তার সঙ্গে যাও এবং তাকে তার ঋণ পরিশোধের পর আরো ২০ সা’ খেজুর দিয়ে দাও। কারণ, তুমি তাকে ভয় দেখিয়েছো।’ হজরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু ইহুদিকে সঙ্গে নিয়ে গেলেন। তাকে তার প্রাপ্য ঋণ প্রদান করলেন এবং সঙ্গে আরো ৩২ কেজির মতো অতিরিক্ত খেজুর দিলেন। ঋণ পরিশোধ করার পরও অতিরিক্ত খেজুর দেখে ইহুদি অবাক! কারণ প্রথমত ইহুদি সময়ের আগেই পাওনা দাবি করেছে, তার ওপর সবার সামনে নবিজীকে অপমান করেছে; তবুও নবিজী তাকে পাওনা দিয়ে দিলেন, সঙ্গে দিচ্ছেন অতিরিক্ত আরো ৩২ কেজি খেজুর!
সে (ইহুদি) জিজ্ঞাসা করলো, ‘অতিরিক্ত খেজুর কেন?’
হজরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, ‘কারণ, আমি তোমাকে হুমকি দিয়েছি। সেটার কাফফারা হিসেবে নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এগুলো দিতে বললেন।’
কে এই ইহুদি?
হজরত ওমরের কথা শুনে ইহুদি বললো, হে ওমর!, তুমি কি জানো- ’আমি কে?’
ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, ‘না, তুমি কে, আমি জানি না। ‘
এবার ইহুদি বললো, ‘আমি যায়িদ ইবনে সুনাহ।’
নাম শুনেই হজরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর চোখ চড়কগাছ! তিনি অবাক!; যায়িদ ইবনে সুনাহ? মদিনার সেই বিখ্যাত ইহুদি (আলেম) রাবাই? হজরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু তার নাম জানতেন, কিন্তু তিনিই যে ঐ ব্যক্তি, সেটা তিনি জানতেন না। যায়িদ ইবনে সুনাহ বললেন, ‘হ্যাঁ, আমিই সেই ইহুদি রাবাই।
নবিজীর বিনয় ও মহানুভবতার পরীক্ষা মূলত নবিজীর বিনয় ও মহানুভবতার পরীক্ষা নিতেই ইহুদি এ কাণ্ড ঘটিয়েছিলো। ইহুদি পন্ডিত রাবাই বললো- ‘আমাদের ধর্মগ্রন্থ অনুযায়ী মুহাম্মদের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নবি হওয়ার প্রমাণের যতো ভবিষ্যৎবাণী পাওয়া যায়, সবগুলোই আমি তাঁর মধ্যে পেয়েছি। শুধু দুটো বিষয় (গুণ) পরীক্ষা করা বাকি ছিলো। সেই দুটি গুণ ছিলো-
১. তাঁকে কেউ রাগালে তিনি বিনয়ী হবেন; সহনশীলতা দেখাবেন।
২. কোনো মূর্খ তাঁর কাছে এসে মূর্খের মতো আচরণ করলে তিনি বরং সেই মূর্খের সঙ্গে ভালো আচরণ করবেন। অর্থাৎ তিনি মন্দের জবাব ভালোর মাধ্যমে দেবেন, অনুত্তমের জবাব উত্তমের মাধ্যমে দেবেন। এ ঘটনায় যায়িদ ইবনে সুনাহ নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মধ্যে সেই দুটো গুণেরও প্রমাণ পেয়ে যান। তিনি নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে রাগানো সত্ত্বেও তিনি তার সঙ্গে রাগ করেননি; উল্টো তার পাওনা অর্থের বেশি তাকে দিয়েছেন। তার সঙ্গে বিনয়ের প্রমাণ দিয়েছেন। ভালো আচরণ করেছেন। যা তাকে ইসলাম গ্রহণের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করেছিল।
ইহুদির ইসলাম গ্রহণ
এবার যায়িদ ইবনে সুনাহ বললেন, ‘হে ওমর! তুমি সাক্ষী থাকো- আমি আল্লাহকে আমার রব হিসেবে, ইসলামকে আমার ধর্ম (জীবন ব্যবস্থা) হিসেবে এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আমার নবি হিসেবে মেনে নিলাম। আমার অনেক সম্পদ আছে। আমি আমার অর্ধেক সম্পদ ইসলামের জন্য দান করে দিলাম।’ (ইবনে হিব্বান, বায়হাকি, মুসতাদরাকে হাকেম)
হজরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুকে দেওয়া এমন উপদেশই প্রমাণ করে যে, নবিজী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম কত বিনয়ী ও মহানুভবতার অধিকারী ছিলেন। আবার তাকে বিনয় ও মহানুভবতার পরিচয় কত সুন্দরভাবেই না দেখিয়ে দিলেন! সুবহানাল্লাহ! কত সুন্দর শিক্ষা! একজন সাহাবির কাছে নিজের জন্য সদুপদেশ চাওয়ার যেমন আকাঙ্ক্ষা করলেন আবার পাওনাদারকে ঋণ তলবের দীক্ষা দেওয়ার বিষয়টি তুলে ধরলেন। কত বড় বিনয়ী ছিলেন বিশ্বনবি! অনাকাঙ্ক্ষিত এ ঘটনায় নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোনো আত্ম-রক্ষামূলক মনোভাব দেখাননি। এমনকি বিষয়টিকে তিনি ব্যক্তিগত ইস্যুতেও পরিণত করেননি। এখানেও তিনি তুলে ধরেছেন ইসলামের সুমহান আদর্শ ও সৌন্দর্য। যে আদর্শ ও সৌন্দর্য দেখে ইয়াহুদি জায়েদ ইবনে সানাহ ইসলাম গ্রহণে অনুপ্রাণিত হয়েছিলো। এটি ছিল বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মহানুভবতা ও পবিত্র চারিত্রের মহান বৈশিষ্ট্য। যে বিনয় ও চারিত্রিক গুণে মুহূর্তেই ইয়াহুদি ‘যায়েদ ইবনে সানাহ’ হলেন- হজরত যায়েদ ইবনে সানাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে বিশ্বনবির এ ঘটনা থেকে শিক্ষা নেওয়ার এবং বিনয়ী হওয়ার তাওফিক দান করুন। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বিনয় ও মহানুভবতার পরিচয় দেওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।