রাঙামাটির ১০ উপজেলায় ৩৭১ পাহাড় ধস
পোস্ট করেছেন: dinersheshey | প্রকাশিত হয়েছে: আগস্ট ৯, ২০২৩ , ৫:০৩ অপরাহ্ণ | বিভাগ: /////হাইলাইটস/////
# বন্যাদুর্গত মানুষের পাশে সেনাবাহিনী
# কক্সবাজারে নামছে বন্যার পানি
সানি আজাদ : টানা ৬ দিনের ভারী বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে রাঙামাটি জেলার বাঘাইছড়ি, বিলাইছড়ি, বরকল ও জুরাছড়ির নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এছাড়া, বিভিন্ন স্থানে পাহাড় ধসের খবর পাওয়া গেছে। রাঙামাটি জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, মঙ্গলবার বিকেল পর্যন্ত টানা ছয় দিনে জেলার ১০ উপজেলায় ৩৭১টি ক্ষুদ্র ও মাঝারি ধরনের পাহাড় ধস হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৫০৬ ঘরবাড়ি । ১৮টি ব্রিজের আশপাশে ক্ষুদ্র পরিসরে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে, প্রায় ১২৯৩ একর ফসলি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রাঙামাটির চার উপজেলার ২২ ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভার ৯টি বাজার পানিতে তলিয়ে গেছে। এছাড়া, বাঘাইছড়ি উপজেলায় বন্যার পানিতে তলিয়ে গিয়ে মো. জুয়েল নামে এক শিশু নিখোঁজ আছে। বরকল উপজেলায় পানির স্রোতে ভেসে গিয়ে নিখোঁজ যুবককে এখনও পাওয়া যায়নি। জেলায় মোট ২৪৫টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এ পর্যন্ত ৩ হাজার ২৬৪ জন নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন। এর মধ্যে রাঙামাটি সদরে ১৯টি আশ্রয়কেন্দ্রের মধ্যে ৮টি আশ্রয়কেন্দ্রে ৯০০ নারী, শিশু ও পুরুষ আশ্রয় নিয়েছেন। এদিকে, সীমান্তবর্তী বাঘাইছড়ি উপজেলায় কাচালং নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর প্রবাহিত হচ্ছে। এতে সাজেক ইউনিয়নের বাঘাইহাট বাজারের আশপাশের এলাকা, বাঘাইছড়ি পৌরসভার ১- ৭ নং ওর্য়াড এবং বাঘাইছড়ি ইউনিয়নের ৪ নং ওর্য়াড মারিশ্যা ইউনিয়ন তুলাবান, আমতলী ইউনিয়নে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। মৎস পুকুর ও মাছের ঘের ও সবজি ফসলের ক্ষতি হয়েছে। বাঘাইছড়ি উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পাহাড়ে বসবাসকারী স্থানীয়দের সতর্ক করে মাইকিং করে সকলকে নিরাপদ স্থানে বা আশ্রয়কেন্দ্রে চলে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে।
বাঘাইছড়িতে বর্তমানে ৪৬টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। বাঘাইছড়ি পৌরসভার মেয়র জমির হোসেন বলেন, বন্যা কবলিত ৯টি ওয়ার্ডে ৯টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা রাখা হয়েছে। এদিকে, বাঘাইছড়ি উপজেলা নির্বাহী অফিসার রুমানা আক্তার বলেন, প্রাকৃতিক এই দুর্যোগ মোকাবিলায় আমরা প্রস্তুত রয়েছি। আমি বিভিন্ন এলাকায় পরিদর্শন করে লোকজনকে আশ্রয়কেন্দ্র আসার জন্য অনুরোধ করছি। উপজেলা নির্বাহী অফিসার কার্যালয়ে এক জরুরি বৈঠক পর বিষয়টি জেলা প্রশাসককে অবগত করা হলে তিনি দ্রুত ২০ মেট্রিক টন খাদ্য বরাদ্দ দেন। এদিকে, রাঙামাটির সীমান্তবর্তী আরেক উপজেলা বিলাইছড়ির ফারুয়া ইউনিয়ন পাহাড়ি ঢলের পানিতে তলিয়ে গেছে। বিলাইছড়ি উপজেলার ফারুয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা মনু মারমা বলেন, আমাদের পুরো ইউনিয়ন পানিবন্দি। হ্রদে তীব্র স্রোত থাকায় সরকারি খাবার পৌঁছাছে না। একদিকে, খাবার সংকট অন্যদিকে বিশুদ্ধ পানির অভাব, সবমিলে মহাদুর্যোগ চলছে এখানে। টানা ভারী বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকায় জেলা প্রশাসনের পাশাপাশি সেনাবাহিনী, পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস, স্কাউটস, রেড ক্রিসেন্টের কর্মীরা ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় লোকজনদের আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে যাচ্ছেন। মঙ্গলবার সকালের দিকে রাঙামাটি শহরের সিভিল সার্জন বাংলো এলাকার আশপাশে পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে। তবে এত কেউ হতাহত হয়নি। খবর পেয়ে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা এলাকার বসবাসরত ১৭ পরিবারকে নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে যান। রাঙামাটি জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো. সাজ্জাদ হোসেন বলেন, রাঙামাটিতে প্রবল ভারী বর্ষণের ফলে জেলার ৫১টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর রাঙামাটির নির্বাহী প্রকৌশলী আহামদ শফি বলেন, কয়েকদিনের ভারী বৃষ্টিতে রাঙামাটি জেলার প্রায় ৮০টির মতো পাকা সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তিনি বলেন, সড়কের বিভিন্ন অংশে বেশকিছু ক্ষতি হয়েছে। রাঙামাটির অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, টানা বর্ষণে ঝুকিপূর্ণ অবস্থায় বসবাসকারীদের নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়ার জন্য জেলা প্রশাসনের পাশাপাশি পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস, স্কাউটস, রেড ক্রিসেন্টের কর্মীরা কাজ করছেন। এছাড়া, সেনাবাহিনীর সহায়তা চাইলে তারাও সহায়তা করছে। এদিকে, টানা বৃষ্টিতে কক্সবাজারের ৯ উপজেলার ৬০ ইউনিয়নের মানুষ পানিবন্দি রয়েছেন। তবে নামতে শুরু করেছে বন্যার পানি। জেলায় সবেচেয়ে বেশি প্লাবিত এলাকা চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলা। এই দুই উপজেলার একটি পৌরসভাসহ ২৫টি ইউনিয়ন প্লাবিত হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। গতকাল সকাল থেকে ভারী বৃষ্টি না হওয়ায় চকরিয়া-পেকুয়ার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ১ থেকে ২ ফুট বন্যার পানি নেমে গেছে এবং পানি নামা চলমান বলে জানা গেছে। চকরিয়া সুরাজপুর-মানিকপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আজিমুল হক আজিম বলেন, প্লাবিত অঞ্চল থেকে ২ ফুটের মতো পানি কমেছে। তবে পানি কমলেও এসব অঞ্চলের মানুষের দুর্ভোগের শেষ নেই। এই মুহূর্তে তাদের সাহায্য-সহযোগিতার প্রয়োজন। আমরা যতটুকু পারছি সহযোগিতা করে যাচ্ছি। জেলা প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা রয়েছেন বন্যা দুর্গতদের পাশে।
গত সমঙ্গলবার (৮ আগস্ট) বিকেলে কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) বিভীষণ কান্তি দাশের পাঠানো এক তথ্য বিবরণীতে বলা হয়েছে, কক্সবাজারের ৯টি উপজেলার মধ্যে সকল উপজেলার কম- বেশি ইউনিয়ন পানিবন্দি রয়েছে। বিকেল পর্যন্ত ৬০ ইউনিয়নের পানিবন্দি থাকার তথ্য জেলা প্রশাসন পেয়েছে। এর মধ্যে কক্সবাজার সদরের ৫টি, রামুর ৩টি, ঈদগাঁওর ৫টি, চকরিয়ার ১৮টি, পেকুয়ার ৭টি, মহেশখালীর ৫টি, কুতুবদিয়ার ৬টি, উখিয়ার ৫টি, টেকনাফের ৬টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। এই ৯টি উপজেলার ২০৮ আশ্রয়কেন্দ্রে সাড়ে ৩৩ হাজারের বেশি মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। জেলা প্রশাসনের প্রাথমিক তথ্য বলছে, বন্যার কারণে জেলায় ইতিমধ্যে দেড় কোটি টাকার ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে। যার মধ্যে সড়ক, কালভার্ট, কাঁচারাস্তা সবচেয়ে বেশি। এদিকে, বন্যার কারণে মঙ্গলবার ২ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে রামুতে পানিতে ডুবে এক শিশু এবং পেকুয়ায় সাপের কামড়ে এক ব্যবসায়ী মারা গেছেন। এর আগে সোমবার পাহাড় ধসে উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ২ জন এবং চকরিয়ায় ৩ জনের মৃত্যু হয়। এদিকে, চকরিয়ার জিদ্দাবাজার-কাকারা-মানিকপুর সড়কের কয়েকটি অংশের ওপর দিয়ে মাতামুহুরী নদী থেকে আসা ঢলের পানি প্রবাহিত হওয়ায় বসতঘর তলিয়ে গেছে। বিশুদ্ধ খাবার পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। শুকনো খাবার ছাড়া রান্নার কোনো ব্যবস্থা নেই গত দুইদিন ধরে। চকরিয়ার লক্ষ্যারচর, কৈয়ারবিল, বরইতলী, হারবাং, সাহারবিল, চিরিঙ্গা, পূর্ব বড় ভেওলা, বিএমচর, পশ্চিম বড় ভেওলা, ঢেমুশিয়া, কোনাখালী, ফাঁসিয়াখালী, বদরখালী, ডুলাহাজারা, খুটাখালী এবং পেকুয়া উপজেলার পেকুয়া সদর ইউনিয়ন, উজানটিয়া, মগনামা, রাজাখালী, টৈটং, শিলখালী, বারবাকিয়া ইউনিয়নের লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। পেকুয়ার সদর ইউনিয়নের মেহেরনামার বেঁড়িবাধটি ভেঙে উজান থেকে নেমে আসা বন্যার পানি লোকলয়ে প্রবেশ করে।
চকরিয়া পৌরসভার মেয়র আলমগীর চৌধুরী বলেন, অতি বৃষ্টির কারণে পৌরসভার অধিকাংশ ওয়ার্ড পানির নিচে তলিয়ে গেছে। নিজ নিজ ওয়ার্ডের কাউন্সিলররা পানি যাতে দ্রুত নেমে যায় সেজন্য কাজ করছেন। এছাড়া, ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ১ নম্বর বেড়িবাঁধটি রক্ষার জন্য বালির বস্তা ফেলা হচ্ছে। সুরাজপুর-মানিকপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আজিমুল হক আজিম ও কাকারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাহাব উদ্দিন বলেন, আমাদের ইউনিয়নগুলো মাতামুহুরী নদীর সঙ্গে লাগোয়া। এজন্য পাহাড় থেকে নেমে ঢলের পানি আগে আঘাত আনে এসব ইউনিয়নগুলোতে। এই দুই ইউনিয়নে অধিকাংশ ঘর পানির নিচে। গত দুইদিন ধরে লোকজনের রান্না বন্ধ। শুধু শুকনো খাবার খেয়ে রয়েছে। অন্যদিকে, চট্টগ্রাম জেলায় ভয়াবহ বন্যাকবলিত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। সাধারণ মানুষকে উদ্ধার অভিযানের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় ত্রাণ, চিকিৎসা সহায়তা দিতে কাজ শুরু করেছেন রামু সেনানিবাসের প্রায় দেড় হাজার সেনা সদস্য। গতকাল সাতকানিয়া-লোহাগাড়া আসনের সংসদ সদস্য আবু রেজা মোহাম্মদ নেজামুউদ্দিন নদভী বলেন, স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যা হয়েছে সাতকানিয়া-লোহাগাড়া উপজেলায়। বন্যাকবলিত মানুষের কষ্ট লাঘবে ও বন্যাদুর্গত এলাকায় উদ্ধার অভিযান পরিচালনার লক্ষ্যে আমরা নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। তিনি আরও বলেন, ইতিমধ্যে সেনাবাহিনীর চট্টগ্রাম ডিভিশনের জেনারেল অফিসার কমান্ডিং (জিওসি) এবং কক্সবাজার রামুর জিওসির সঙ্গে কথা বলেছি। তারা বন্যাদুর্গত লোকজনকে উদ্ধারের জন্য সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস প্রদান করেছেন। সাতকানিয়া লোহাগাড়ার বন্যাকবলিত এলাকায় উদ্ধারাভিযানের জন্য ইতিমধ্যেই কক্সবাজার রামু ক্যান্টনমেন্ট থেকে দেড় হাজার সেনাবাহিনী সদস্য কার্যক্রম শুরু করেছেন।