ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেট : অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি নিয়েই চলছে ব্যবসা
পোস্ট করেছেন: dinersheshey | প্রকাশিত হয়েছে: অক্টোবর ১২, ২০২৩ , ৩:২৪ অপরাহ্ণ | বিভাগ: /////হাইলাইটস/////
দিনের শেষে প্রতিবেদক : টিকাটুলীতে অবস্থিত রাজধানী সুপার মার্কেটটি বেশ বড়। প্রতিদিনই ভিড় থাকে ক্রেতাদের। মার্কেটের সাতটি ব্লকে শত শত দোকান। কাপড়, জুতা, প্রসাধনী, জুয়েলারি ও ঘর সাজানোসহ বিভিন্ন ধরনের দোকান। ভেতরে যাতায়াতের জন্য রয়েছে সরু পথ। গাদাগাদি অবস্থা। আলো-বাতাস আসার কোনো পথ নেই। এর মধ্যে আবার পুরো মার্কেটের ওপর টিনশেড। দোকানগুলোতে মালামাল এমনভাবে রাখা যে, এক দোকানে আগুন লাগলে অন্য দোকানে সহজেই ছড়িয়ে পড়বে। বিদ্যুতের লাইনগুলোও নেওয়া হয়েছে ঝুঁকিপূর্ণভাবে। ফলে যে কোনো সময় শর্ট সার্কিট থেকে ঘটতে পারে অগ্নিকাণ্ড। যদিও চার বছর আগেই আগুনের মুখ দেখেছে মার্কেটটি। এর মধ্যে চলতি বছর বঙ্গবাজারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এরপর ঢাকা শহরের ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেটের তালিকা তৈরি করে ফায়ার সার্ভিস। যে তালিকায় রয়েছে ‘রাজধানী মার্কেট’। ব্যবসায়ীরা বলছেন, মার্কেটের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে রয়েছে দ্বন্দ্ব। ফলে দুর্ঘটনা এড়াতে যে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা থাকা দরকার তার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। যদিও সম্প্রতি অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র, পানির ট্যাংকি স্থাপনসহ নানা কাজ করা হয়েছে রাজধানী মার্কেটে। একই সঙ্গে বাড়তি নিরাপত্তার জন্য গভীর রাতে দেওয়া হচ্ছে পাহারা। তারপরও ঝুঁকি নিয়ে ব্যবসা করছেন ব্যবসায়ীরা। ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা যায়, গত আগস্ট মাসে ঢাকা শহরে মোট ১২৮টি আগুনের ঘটনা ঘটে। এরপর সেপ্টেম্বর মাসে তা বেড়ে হয় ১৫৫টি। এরমধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ ছিল মোহাম্মদপুরের কৃষি মার্কেটের আগুন। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) অধীনে থাকা মার্কেটটিতে আগুন লাগে ভোররাতে। আগুনে ২১৭ দোকান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নিঃস্ব হন অনেক ব্যবসায়ী। এর আগে গত ৪ এপ্রিল বঙ্গবাজারে ভয়াবহ আগুন লাগে। সেদিন পুড়ে যায় বঙ্গ মার্কেট, গুলিস্তান মার্কেট, মহানগর শপিং কমপ্লেক্স, আদর্শ মার্কেট ও এনেক্সকো টাওয়ার। নিঃস্ব হয়ে যান তিন হাজারের বেশি ব্যবসায়ী। ক্ষয়ক্ষতি হয় ৩০৫ কোটি টাকার। এর রেশ কাট না কাটতেই ১৫ এপ্রিল ঢাকা নিউ সুপার মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এতে পুড়ে যায় ২২৬টি দোকান। দুটি আগুনই লাগে ভোররাতে। ফায়ার সার্ভিস বলছে, এসব মার্কেটের কোনোটিতেই অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই। এ অবস্থায় রাজধানী সুপার মার্কেটের ব্যবসায়ীরা রয়েছেন আতঙ্কে। তারা বলছেন, একের পর এক মার্কেটে আগুন তাদের শঙ্কায় ফেলছে। আগুন লাগলে পড়তে হবে লাখ লাখ টাকার ক্ষতিতে। গভীর রাতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে তাদের কিছু করার থাকবে না। রাজধানী মার্কেটের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৯৯৬ সালে সেখানকার কয়েকজন ব্যবসায়ী মিলে মার্কেটটি নির্মাণ করেন। প্রথম দিকে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের অধীনে ১৪ জন মিলে পরিচালনা করেন মার্কেট। এরমধ্যে একজন পরিচালক ছিলেন আজমল হোসেন বাবু। বর্তমানে তার ছেলে মো. ফজলুল হক বিপ্লব মার্কেটের দোকান মালিক সমিতির সভাপতি। তবে শুরুতে সভাপতি ছিলেন রতন নামের এক ব্যবসায়ী। এরপর বেশ কয়েক বছর ওয়ারী থানার সাবেক কাউন্সিলর মইনুল হক মঞ্জু ছিলেন রাজধানী সুপার মার্কেটের সভাপতি। ২০১৯ সাল পর্যন্ত এ দায়িত্বে ছিলেন তিনি। ২০২০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ছয় মাস আগে তিনি জেলে যাওয়ার পর মার্কেটের কোনো কমিটি ছিল না। তখন এডহক কমিটি করা হয়। মার্কেটের তিনটি গ্রুপ ও দোকানিদের প্রতিনিধি নিয়ে করা হয় এ কমিটি। প্রায় দেড় বছর ছিল এ কমিটি। এরপর আবার কমিটি হয়। সেখানে নতুন করে সভাপতি হন মো. ফজলুল হক বিপ্লব। সাধারণ সম্পাদক হন আরেক ব্যবসায়ী তারই ফুফাতো ভাই টিটু। মার্কেট সমিতি সূত্রে জানা যায়, ৭০০টি দোকান রয়েছে এখানে। কোনো ব্লকে ১০০টি আবার কোথাও দেড়শোর মতো দোকান। কোনো দোকানে মালামাল রয়েছে ৫০ হাজার থেকে ৩০ লাখ টাকার। আবার কোনোটায় ৬০-৭০ লাখ টাকার মালামাল। প্রায় ১৮০-২০০ কোটি টাকার মালামাল রয়েছে মার্কেটজুড়ে। এসব দোকানের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ২০০টি দোকান সভাপতি বিপ্লবের। মার্কেটটিতে মাসে এক হাজার ২৩০ টাকা সার্ভিস চার্জ দিতে হয় দোকানিদের। পাঁচ হাজার থেকে শুরু করে ৩৫ হাজার টাকা পর্যন্ত ভাড়া রয়েছে দোকানের। মার্কেট কমিটির সভাপতি ৭০০ দোকানের কথা বললেও মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে মার্কেটটিতে এক হাজার ৭৯৫টি দোকান রয়েছে। আর ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আশপাশের দোকান মিলে প্রায় দুই হাজারের কাছাকাছি দোকান। এরমধ্যে বেশ কিছু দোকান অবৈধ। অভিযোগ আছে, মার্কেটটির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দ্বন্দ্ব রয়েছে। বর্তমান সভাপতি বিপ্লব, সাবেক কাউন্সিলর মঞ্জু ছাড়াও আবুল বাশার গ্রুপের মার্কেট নিয়ন্ত্রণ নিয়ে চলে প্রতিযোগিতা। এ অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বর্তমান সভাপতি বিপ্লব বলেন, আমাদের এখানে বিরোধী গ্রুপ আছে। তারা মার্কেট নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার চেষ্টা করে। এদিকে মার্কেট নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দ্বন্দ্বের বিষয়ে সাবেক কাউন্সিলর মইনুল হক মঞ্জু বলেন, গত চার বছর ধরে আমি দায়িত্বে নেই। দখলদার বাহিনী এটা দখল করে নিয়ে গেছে। হাইকোর্টের রায়ও রয়েছে আমাদের কমিটি বৈধ। হাইকোর্ট তাদের মার্কেট ছেড়ে দিতে বলেছেন। কিন্তু তারা এটা মানে না। ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেটের বিষয়ে তিনি বলেন, এ নিয়ে আমার কাছে কোনো রাস্তা নাই। তারাই (বর্তমান কমিটি) মার্কেট চালায়, তারাই সবকিছু করে। আমি এখন কিছু বলতে পারবো না কীভাবে মার্কেটের ঝুঁকি এড়ানো যায়। কারণ আমি মার্কেটটিতে চার বছর ধরে নেই। ২০১৯ সালে রাজধানী মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এরপর চলতি বছর (২০২৩ সাল) বেশ কয়েকটি মার্কেটে লাগে আগুন। এ অবস্থায় অগ্নিঝুঁকি কমাতে বৈদ্যুতিক ফ্যান লাগানো, পুরাতন তার পরিবর্তন, নিরাপত্তার জন্য বেশ কিছু দোকানে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র এক্সটিংগুইশার দেয় মার্কেট সমিতি। এছাড়া স্থাপন করা হয় পানির ট্যাংকি। অন্যদিকে বঙ্গমার্কেটে আগুনের পর ফায়ার সার্ভিস প্রতি রোববারই প্রশিক্ষণ দিয়েছিল। যদিও এখন আর সেই প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় না। সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত খোলা থাকে রাজধানী মার্কেট। বাকি সময় বন্ধ রাখা হয় বিদ্যুতের লাইন। তবে নিরাপত্তার জন্য আলাদা স্থাপন করা বিদ্যুতের লাইন চালু থাকে। ৩২ জন নিরাপত্তাকর্মী রয়েছে মার্কেটটিতে।