আজকের দিন তারিখ ২৩শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শনিবার, ৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সর্বশেষ সংবাদ
সম্পাদকীয় আফগানিস্তান: সংকট সমাধানে বিশ্বে অভিভাবকহীন এক দেশ

আফগানিস্তান: সংকট সমাধানে বিশ্বে অভিভাবকহীন এক দেশ


পোস্ট করেছেন: dinersheshey | প্রকাশিত হয়েছে: আগস্ট ১৮, ২০২১ , ২:২৬ অপরাহ্ণ | বিভাগ: সম্পাদকীয়


শ্যামল দত্ত : 

জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বুট্রোস বুট্রোস ঘালি ১৯৯৫ সালে বলেছিলেন, আফগানিস্তানের সংকটটি বিশ্বের কাছে একটি এতিমের মতো বিষয়, যে সংকট সমাধানের কোনো অভিভাবক নেই। বিভিন্ন সময়ে আফগানিস্তান রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু দেশটির সাধারণ মানুষের একটি শান্তিপূর্ণ জীবন প্রতিষ্ঠান কোনো উদ্যোগ রাষ্ট্রগুলো নেয়নি। বুট্রোস বুট্রোস ঘালি আরো আক্ষেপ করে বলেছিলেন, একই সময়ে সৃষ্ট সংকটে যুগোস্লাভিয়া পশ্চিমা দেশগুলোর যে পরিমাণ মনোযোগ পেয়েছে, আফগানিস্তানের সংকট সেই অর্থে কোনো গুরুত্বই পায়নি।

নিরাপত্তা পরিষদের রিপোর্ট প্রদানের সময় জাতিসংঘের মধ্যস্থতাকারী লাখদার ব্রাহিমি বলেছিলেন, একটা ব্যর্থ রাষ্ট্রের সংকট নিয়ে আমরা সমাধানের চেষ্টা করছি- যার  ক্ষতগুলোতে পচন ধরে গেছে। এমনকি আমরা জানি না যে এর চিকিৎসা কোথা থেকে শুরু করতে হবে। দীর্ঘ কয়েক দশক পর এখন আবারো বলা যায়, আফগানিস্তান সংকটের সমাধানের কোনো অভিভাবক নেই। রাশিয়া এবং চীন গোপনে শলা পরামর্শ করছে তালেবানদের সঙ্গে। নেপথ্যে সমর্থন জোগাচ্ছে তুরস্ক এবং ইরান। ভারত নীরব। পাকিস্তানের সমর্থন প্রকাশ্য। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পশ্চিমা শক্তি পরাজয় বরণ করে তালেবানের হাতে দেশটি তুলে দিয়ে চলে গেল।

ঠিক একইভাবে ১৯৭৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ ভিয়েতনাম থেকে নিজেদের সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। সাইগনের মার্কিন দূতাবাস থেকে যেভাবে মার্কিন নাগরিকদের সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল সে সময়, এখন কাবুল বিমানবন্দরে স্থাপিত অস্থায়ী দূতাবাস থেকে সরিয়ে নিতে হচ্ছে নিজেদের জনগণকে। ২০০১ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত একটানা ২০ বছর আফগানিস্তানে একটি গ্রহণযোগ্য সরকার গঠনে মার্কিনিদের চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হওয়ার পর পুরো আফগানিস্তানকে এতিম করে মার্কিন সেনাবাহিনী দেশটিকে অরক্ষিত রেখেই চলে গেল। দীর্ঘ এই সময়কালে যে আফগান জনগোষ্ঠী মার্কিনি প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী একটি রাষ্ট্র চালানোর ব্যবস্থায় সমর্থন দিয়েছে, তালেবান শাসন আমলে তাদের ভবিষ্যৎ কী হবে, তা একবারও চিন্তা করেনি তারা। এই ২০ বছরে আফগানিস্তান পুনর্গঠনের নামে ৮৯ বিলিয়ন ডলার খরচ করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলো। পশ্চিমা অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত একটি আফগান বাহিনী তৈরি করা হয়েছে, যার এখন অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মার্কিন যে কোম্পানিকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল এই সেনাবাহিনী গঠনের, তারা আগেই পালিয়েছে আফগানিস্তান থেকে।

অভিযোগ রয়েছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার দুর্নীতিতে নিমজ্জিত আফগান শাসকদের পকেটে গেছে অথবা কোনো মার্কিন সংস্থার একাউন্টে জমা হয়েছে। ফলে কোনোরকম প্রতিরোধ ছাড়াই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা বাহিনীর সব পূর্বাভাসকে মিথ্যা বানিয়ে দিয়ে কোনো রক্তপাত না ঘটিয়ে মাত্র ৭ দিনের মধ্যে কাবুল দখল করেছে তালেবান বাহিনী। প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি ও তার মন্ত্রিসভার সদস্যরা দেশ ছেড়ে পালানোর পর প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে নির্বিঘ্নে সোফার উপর পা তুলে বসে কোলের উপর অটোমেটিক রাইফেল নিয়ে মাদ্রাসা থেকে বের হওয়া তালিব অর্থাৎ প্রশিক্ষিত তালেবান বাহিনী এখন খাওয়া-দাওয়া করছে। অন্যদিকে এই ২০ বছরের চেষ্টায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কী পেল, শত শত মার্কিন সৈনিকের জীবনের বিনিময়ে কী অর্জিত হলো, তা নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বিগত ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন। জলবায়ু পরিবর্তনসহ ট্রাম্পের অনেক নীতি পরবর্তী সময়ে পরিবর্তিত হলেও জো বাইডেন ক্ষমতায় আসার পর আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহারে ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত অক্ষুণ্ন রাখেন। গত ফেব্রুয়ারি মাসে দোহায় তালেবান এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যে বৈঠক হয় সেখানে কী প্রক্রিয়ায় ক্ষমতা হস্তান্তর হবে তা জানার কোনো অধিকারই রাখেনি আফগানিস্তানের বর্তমান প্রশাসন। তাদের ছাড়াই একতরফা বৈঠকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয় বাইডেন প্রশাসন। কিন্তু সৈন্য প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর থেকেই খুব দ্রুতগতিতে কাবুল পর্যন্ত পৌঁছে যায় তালেবান বাহিনী। এখন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিনকেন বলছেন আফগান বাহিনীর ব্যর্থতার কারণেই এত দ্রুত তারা ক্ষমতা দখল করতে পেরেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এখানে কিছু করার ছিল না। জো বাইডেন বলছেন, আরো পাঁচ বছর মার্কিন সৈন্য থাকলেও পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হতো না।

এ নিয়ে এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলছে একে অপরকে দোষারোপের পালা। অনেকেই তুলনা করছেন, ১৯৭৫ সালে দক্ষিণ ভিয়েতনাম থেকে এভাবেই পরাজয় মেনে চলে আসতে হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রকে। কিন্তু মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ভিয়েতনাম এবং আফগানিস্তানকে একই পাল্লায় মাপতে রাজি নন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে আফগানিস্তানের একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠী অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে গেছে এই আকস্মিক পরিস্থিতিতে। গত ২০ বছরে যারা স্বপ্ন দেখেছিল একটি মুক্তবুদ্ধির সমাজ গড়ে উঠবে, নারীরা শিক্ষাপ্রাপ্ত হয়ে ক্ষমতায়িত হবে, শিল্প সংস্কৃতির বিকাশ ঘটবে- তালেবান শাসন আমলে তাদের জীবনটা এখন সবচেয়ে বেশি হুমকির মুখে। অন্তত ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত যে তালেবান শাসন ব্যবস্থা আফগানবাসী দেখেছে, তাদের কাছে এখনো সেটা ভয়ংকর এক স্মৃতি। যদিও বর্তমান তালেবান নেতৃত্ব বলছে, ২০০১ সালের তালেবান আর ২০২১ সালের তালেবান এক নয়। কিন্তু জিহাদ আর শরিয়া প্রশ্নে তালেবানদের অবস্থান এখনো অভিন্ন। মোল্লা ওমরের নেতৃত্বে ১৯৯৬ সালে যে শাসন ব্যবস্থা আফগানিস্তানকে অন্ধকারে নিয়ে গিয়েছিল, তার অনুসারীরা পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কতখানি নতুন ব্যবস্থা দিতে পারবে সে নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। ইতোমধ্যে আফগানিস্তানের পতাকা পাল্টে গেছে, দেশটির নামও পাল্টে গেছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে একটা বিরাট জনগোষ্ঠী আফগানিস্তান ছেড়ে এখন অন্য কোনো দেশে চলে যাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। বিমানবন্দরে হাজার হাজার মানুষ ভিড় জমিয়েছে অন্য কোনো দেশে চলে যাওয়ার প্রত্যাশায়। মার্কিন সেনাবাহিনীর সি ১০৩ বিমান ধরে ঝুলতে থাকা মানুষগুলো ঝরে ঝরে পড়ছে রানওয়েতে। এ থেকে বোঝা যায় দেশ ছাড়ার জন্য কতখানি মরিয়া তারা।

১৯৭৯ সালে বামপন্থি দল পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি অফ আফগানিস্তানের (পিডিপিএ) সমর্থনে রাশিয়া সেনাবাহিনী পাঠানোর পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের সমর্থনে আফগান মুজাহিদ বাহিনী তৈরি হয়েছিল রুশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য। দীর্ঘ ১০ বছর পর ১৯৮৯ সালে রুশ বাহিনী নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত মার্কিন সমর্থনে আফগানিস্তানের অভ্যন্তরে একের পর এক হামলা চালিয়েছে তালেবান ও মুজাহিদীন বাহিনী। রাশিয়া আফগানিস্তান ছেড়ে চলে যাওয়ার পর ৬ বছরের গৃহযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৯৯৬ সালে কাবুলে সরকার প্রতিষ্ঠা করে তালেবানরা। জাতিসংঘের কার্যালয়ে আশ্রয় নেয়া আফগান প্রেসিডেন্ট নজিবুল্লাহকে প্রকাশ্যে রাস্তায় এনে ল্যামপোস্টে ঝুলিয়ে ফাঁসি দেয় তালেবান বাহিনী। সেই সময় এই সমস্ত কর্মকাণ্ডের নেপথ্যে ইন্ধন জুগিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। আফগানিস্তানে রুশ ব্যর্থতা স্নায়ুযুদ্ধের অবসান ঘটিয়েছিল, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে খান খান হয়ে গিয়েছিল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মুজাহিদীনদের মাধ্যমে পাওয়া এই বিজয় এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনকে সবচেয়ে বড় সাফল্য হিসেবে দেখে। ইতিহাসের নির্মম বাস্তবতা হচ্ছে, এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনপুষ্ট প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি কাবুল ছেড়ে পালিয়েছে বিপুল অর্থ-বিত্ত নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মুখে পরাজয়ের এক কলঙ্কতিলক লাগিয়ে দিয়ে। দেশের মানুষকে ফেলে যাওয়া এই প্রেসিডেন্টকে এখন কাপুরুষ হিসেবে অভিহিত করছে আফগানিস্তানের জনগণ।

তালেবানদের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি গোপন মিত্রতা ছিল বরাবরই। তালেবান শাসন আমলে মধ্য এশিয়ার গ্যাস ও তেল সম্পদ আহরণের জন্য মার্কিন কোম্পানি ইউনিকল বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছিল। উজবেকিস্তান ও তাজিকিস্তানের গ্যাস-তেল নিয়ে যাওয়ার জন্য পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে এক ধরনের প্রতিযোগিতাও ছিল। পাকিস্তানি সাংবাদিক আহমেদ রশীদ তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘তালেবান : দ্য স্টোরি অফ দ্য আফগান ওয়ার লর্ডস’ এ লিখেছেন, মূলত মধ্য এশিয়ার তেল এবং গ্যাস সম্পদকে ঘিরেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আফগান নীতি পরিচালিত হয়েছিল। ১৯৯৭ সালের ২৫ অক্টোবর তালেবানদের সহযোগিতায় আফগানিস্তানের মধ্য দিয়েই সেন্ট্রাল এশিয়ার তেল ও গ্যাস সম্পদ পরিবহনে পাইপলাইন নির্মাণের জন্য মার্কিন তেল কোম্পানি ইউনিকল সেন্ট্রাল এশিয়া গ্যাস পাইপলাইন লিমিটেড নামে একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করে, যেখানে ইউনিকলের শেয়ার ছিল ৪০ দশমিক ৫ শতাংশ, ডেল্টা অয়েলের শেয়ার ছিল ১৫ শতাংশ, তুর্কমেনিস্তানের ৭ শতাংশ, জাপানের ইতোচু কোম্পানির ৬ দশমিক ৫ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়ান পেট্রোলিয়ামের (ইম্পেক্স) ৩ দশমিক ৫ শতাংশ, হুন্দাই ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন কোম্পানি ৫ শতাংশ এবং পরবর্তী সময়ে এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয় রাশিয়ান কোম্পানি গ্যাসপ্রম। স্থল পরিবেষ্টিত মধ্য এশিয়া থেকে ইরান-তুরস্ক হয়ে একটি পাইপলাইন তৈরি, অন্যদিকে আফগান-পাকিস্তান হয়ে একটি পাইপলাইন তৈরির চেষ্টা ছিল পশ্চিমা দেশগুলোর। মার্কিন তেল কোম্পানিগুলো কয়েকবার তালেবানদের আমন্ত্রণ জানিয়ে হিউস্টনসহ যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে নিয়ে গিয়েছিল। এই প্রকল্প নিয়ে তালেবানদের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক ধরনের সমঝোতা হয়েছিল। কিন্তু ২০০১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর টুইন টাওয়ারে হামলার ঘটনা পুরো হিসাব-নিকাশ পাল্টে দেয়। তেলের দাম পড়ে যাওয়ায় বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের এই প্রকল্প থেকে পিছুটান দেয় ইউনিকল। তালেবানদের আশ্রয়ে থাকা আল কায়দাকে উৎখাতে আক্রমণ শুরু করে মাত্র কয়েক মাসের মাথায় তালেবানদের ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তারপর থেকে শুরু হয় আফগানিস্তানের একটি অনুগত সরকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা, যা ২০ বছরেও সফলতা পায়নি। কাবুলকে বাদ দিলে আফগানিস্তানের অধিকাংশ এলাকায় ছিল তালেবানদের দখলে। শেষ পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরাজয় হলো। জয়ী হলো তালেবানরা। এখন আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ কোন দিকে যায় সেটা দেখার জন্য হয়তো আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। কি ধরনের সরকার ব্যবস্থার দিকে যাচ্ছে তালেবান প্রশাসন, নারীদের ক্ষমতায়ন কতটুকু হবে? এর আগে যেভাবে আইএস ও আল কায়দাসহ ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদকে যেভাবে প্রশ্রয় দিয়েছিল, সেই নীতি কতখানি অনুসরণ করবে এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক কিভাবে এগিয়ে নিয়ে যাবে, তার ওপর নির্ভর করছে অনেক কিছু।

আফগানিস্তান ৯৯ দশমিক পাঁচ শতাংশ মুসলমান জনগোষ্ঠীর দেশ। খুবই সামান্য সংখ্যক হিন্দু, শিখ এবং খ্রিস্টান রয়েছে। এর আগের তালেবান সরকার হিন্দুদের হলুদ ব্যাজ পরে রাস্তায় বের হতে বলেছিল, যাতে তাদের ধর্মীয় পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়। মোল্লা ওমরের নির্দেশে ২০০১ সালে বামিয়ানে বৃহৎ বৌদ্ধ মূর্তিগুলো ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। কাবুলের জাদুঘর থেকে অসংখ্য মূর্তি ইসলামিক রীতিবিরুদ্ধ হিসেবে অভিহিত করে ধ্বংস করে ফেলা হয়েছিল। আফগানিস্তানের রুশদের ক্ষমতা দখলের সময় ১৫টি গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তালেবানরা সবগুলো বন্ধ করে দিয়ে নিজেদের মুখপাত্র হিসেবে মাত্র দুটি পত্রিকা রেখে দিয়েছিল। ক্রিকেট খেলা ও মেয়েদের উচ্চশিক্ষা বন্ধ করে দিয়েছিল। দেশের প্রায় ৪৫ শতাংশ জনগোষ্ঠী পশতুন হলেও তাদের মধ্যে রয়েছে দুটি গোষ্ঠী। একটি দুররানি পশতুন, আরেকটি গিলজারি পশতুন। এছাড়া উজবেক, তাজিক ও হাজারাসহ আরো কিছু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী রয়েছে। তবে তালেবানদের মধ্যে অধিকাংশই পশতুন জনগোষ্ঠীর। বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে সংঘাতময় এক পরিস্থিতি বরাবরই ছিল আফগানিস্তানে। কিন্তু ইতিহাস বলে সংস্কৃতি এবং কৃষ্টিতে অত্যন্ত সমৃদ্ধ আফগানিস্তান এখন প্রায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। কবি ফেরদৌসী দুই লাইনের ৬০ হাজার শ্লোকে শাহনামা মহাকাব্য লিখেছিলেন আফগানিস্তানের দারি ভাষায়। কবি জালাল উদ্দিন রুমির অনেক কবিতা আছে এই ভাষায়। সংস্কৃতির উজ্জ্বল ইতিহাসের অংশ আফগানিস্তান তালেবানদের হাতে কী চেহারা নেয়, সেটাই এখন দেখার বিষয়।

শেষ করব আফগানিস্তান নিয়ে গবেষক পাকিস্তানি সাংবাদিক আহমেদ রশীদের আরেকটি উদ্ধৃতি দিয়ে। তিনি বলেছেন, আফগানিস্তানের সংকটের সমাধান করতে হবে আফগানিস্তানের বাস্তবতাকে উপলব্ধি করে। বাইরে থেকে চাপিয়ে দিয়ে নয়। গৃহযুদ্ধ ও রক্তপাতবিহীন একটি সমাজে বসবাস করার অধিকার আফগানিস্তানের সাধারণ নাগরিকদের রয়েছে। বছরের পর বছর ধরে এই দেশটিতে সংঘাত অব্যাহত থাকার কারণে একটি জনগোষ্ঠী বড় হচ্ছে সংঘাতের বাস্তবতার মধ্যে, যে সংকটটির সমাধানের কোনো উপায় তারা খুঁজে পাচ্ছে না।