করোনা কাহিনী : প্রধানমন্ত্রীর প্রণোদনা প্যাকেজ ও নানা প্রতিক্রিয়া
পোস্ট করেছেন: dinersheshey | প্রকাশিত হয়েছে: এপ্রিল ৭, ২০২০ , ৭:০৯ পূর্বাহ্ণ | বিভাগ: সম্পাদকীয়
শ্যামল দত্ত, সম্পাদক ।
বিগত দুই শতাব্দীতে বিশ্ব দুটি বড় অর্থনৈতিক ধাক্কার মুখোমুখি হয়েছে। একটিকে বলা হয় গ্রেট ডিপ্রেশন বা ‘ব্র্যাক টুইসডে’ যা ঘটেছিল ১৯২৯ সালের ২৯ অক্টোবর। দ্বিতীয় ধাক্কাটি আসে ২০০৮-০৯ সালে, যা ‘গ্রেট রিসিশন’ হিসেবে পরিচিত। এই দুই ধাক্কায় বদলে গিয়েছিল পৃথিবীর অর্থনীতির সামগ্রিক গতিপ্রকৃতি। খ্যাতনামা অর্থনীতি চিন্তকরা কোনো হদিস খুঁজে পাননি কেন অর্থনীতির এমন পতন ঘটল। তবে নানা ফর্মুলায় বিশ্ব অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার জন্য তারা নানা সময় নানা পরামর্শ দিয়েছেন, যা পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রনেতারা ভেঙে পড়া অর্থনীতিকে দাঁড়ানোর চেষ্টায় ‘স্টিমুলাস প্যাকেজ’ বা প্রণোদনার উদ্যোগ হিসেবে অভিহিত করেছেন। ১৯২৯ সালের শেয়ার মার্কেট ধসের কারণে যে অর্থনৈতিক মন্দার সৃষ্টি হয়েছিল তা কাটিয়ে উঠতে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত বিভিন্ন প্রণোদনা সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নতুন একটি আর্থিক বাস্তবতা তৈরি করায় তিনি সামলে ওঠেন সেই বিপর্যয়, কারণ আমরা জানি যুদ্ধেরও একটি অর্থনীতি আছে।
২০০৮-০৯ সালে আকস্মিক ব্যাংকিং ব্যবস্থার বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে ওবামা প্রশাসনকে মার্কিন অর্থনীতিতে ৭৮৭ বিলিয়ন ডলারের প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করতে হয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই নিম্নগামী অর্থনীতির চাপ তৃতীয় বিশ্বের অধিকাংশ উদীয়মান অর্থনীতিকে কঠিন সংকটে ফেললেও বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির অবিনাশী শক্তির কারণে খুব বেশি সংকটে পড়তে হয়নি আমাদের দেশকে। বরং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক শক্তির নিজস্ব একটি চেহারা ফুটে উঠতে সাহায্য করেছে এই অর্থনৈতিক মন্দা, যা মূলত আমাদের দেশের শক্তিশালী কৃষি খাত, বিদেশ থেকে পাঠানো শ্রমজীবী মানুষের রেমিট্যান্স ও অপেক্ষাকৃত কম দামি পোশাক বানানোর যে শ্রমঘন গার্মেন্টস শিল্প তার ওপরই নির্ভরশীল ছিল।
বর্তমানে বিশ্ব যে অর্থনৈতিক সংকটের মুখোমুখি তার গতিপ্রকৃতি অবশ্য একেবারেই ভিন্ন। একে অতীতের কোনো বিশ্বমন্দার সঙ্গে মেলানো যাচ্ছে না বলে অভিমত দিচ্ছেন বাঘা বাঘা অর্থনীতিবিদরা। তবে করোনা ভাইরাসের কারণে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সংকট বিশ্ব অর্থনীতিকে এমন একটি ভয়াবহ অসুখের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে যা অনেকেই কল্পনা করেননি। যে কারণে অনেক উন্নত দেশ শুরুতে এটাকে পাত্তাই দেননি। কিন্তু দিন যত যাচ্ছে ততই তাদের উপলব্ধি এরকম যে- স্বাস্থ্যের অসুখ হয়তো একসময় সেরে যাবে কিন্তু অর্থনীতির অসুখ সারাতে অনেক বেগ পেতে হবে এই বিশ্বকে। কারণ ভাইরাসের যে মহৌষধ- সেই সামাজিক দূরত্ব মানতে গিয়ে দুটো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এর একটি হচ্ছে ‘সাপ্লাই শক’ বা সরবরাহের আঘাত- সামাজিক দূরত্বে মানুষে মানুষের দূরত্বের সৃষ্টি, যা উৎপাদনকে চরমভাবে ব্যাহত করেছে এবং যার কারণে হ্রাস পেয়েছে উৎপাদন সক্ষমতা। অন্যদিকে দ্বিতীয়টি হচ্ছে ‘ডিমান্ড শক’ বা চাহিদার আঘাত- যাকে বলা হয় আয় কমে যাওয়ার কারণে ক্রয়ক্ষমতা কমেছে মানুষের। এ দুটো মিলেই বিশ্বের অর্থনীতিকে করেছে নিম্নগামী। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি এমনকি জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস পর্যন্ত বলেছেন, বিশ্ব অর্থনীতি থেকে কয়েক ট্রিলিয়ন ডলার নাই হয়ে গেছে।
বিশ্বজুড়ে এই অর্থনৈতিক সংকটের মোকাবিলায় বিভিন্ন দেশের সরকার নানা ধরনের প্রণোদনামূলক উদ্যোগ নিয়ে অর্থনীতিকে আবার চাঙ্গা করার চেষ্টা করছেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত রবিবার এরকম একটি ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন, যা নিয়ে গত দুদিন ধরে চলছে নানা আলোচনা-পর্যালোচনা। বলে রাখা ভালো গত ১৫ দিনে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও চীনসহ বিভিন্ন দেশ এই ভয়াবহ আর্থিক বিপর্যয় মোকাবিলায় নানা উদ্যোগ নিয়েছে। ট্রাম্প প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ২ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার, ব্রিটেনের বরিস জনসনের সরকার ৩০ বিলিয়ন ব্রিটিশ পাউন্ড এবং চীন সরকার ৪ ট্রিলিয়ন ইউয়ান (যা প্রায় ৫৬৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমান) করোনা মহামারি বিপর্যস্ত অর্থনীতির মোকাবিলায় প্রণোদনা ঘোষণা দিয়েছে।
প্রথম একটু দেখে নিই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অর্থনীতির সংকট মোকাবিলায় যে প্রণোদনার ঘোষণা দিয়েছেন, সেখানে কী আছে? চারটি ধাপের এ প্রস্তাবে দেখা যায় : ক. ক্ষতিগ্রস্ত শিল্পসেবা খাতগুলোর জন্য ৩০ হাজার কোটি টাকার ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল সুবিধা, যা ব্যাংক ব্যবস্থার মাধ্যমে বিতরণ করা হবে। এই সুবিধায় সুদের হার হবে ৯ শতাংশ। এর অর্ধেক অর্থাৎ ৪ দশমিক ৫ শতাংশ ঋণগ্রহীতা দেবে। বাকি ৪ দশমিক ৫ শতাংশ সরকার ভর্তুকি হিসেবে ব্যাংকে দেবে। খ. ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পসহ মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠানের জন্য ২০ হাজার কোটি টাকার একটি ঋণ সুবিধার ব্যবস্থা করা হয়েছে, যার সুদের হার হবে ৯ শতাংশ। এখানেও সরকার সুদের হারের অর্ধেক ভর্তুকি হিসেবে ব্যাংকে দেবে। গ. বাংলাদেশ ব্যাংকের রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল ৩৫০ কোটি ডলার থেকে বাড়িয়ে ৫০০ কোটি ডলারে উন্নীত করা হবে। ফলে বাংলাদেশি মুদ্রায় ইডিএফে যুক্ত হবে অতিরিক্ত ১২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। ইডিএফের সুদের হার ২ দশমিক ৭৩ থেকে কমে ২ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। ঘ. প্রি-শিপমেন্ট ক্রেডিট ফাইন্যান্স স্কিম নামে বাংলাদেশ ব্যাংক ৫ হাজার কোটি টাকার একটি নতুন ঋণ সুবিধা চালু করবে, এই সুবিধায় সুদের হার হবে ৭ শতাংশ। এর আগে প্রধানমন্ত্রী গত ২৫ মার্চ জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণের সময় রপ্তানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধের জন্য মাত্র ২ শতাংশ সার্ভিস চার্জ দিয়ে ৫০০০ কোটি টাকার একটি আপৎকালীন প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছিলেন। এই পাঁচটি প্যাকেজ মিলে সরকারের সামগ্রিক প্রণোদনার পরিমাণ ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা, যা জিডিপির ২ দশমিক ৫২ বলে প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেছেন।
প্রধানমন্ত্রীর এই প্রণোদনার প্যাকেজকে স্বাভাবিকভাবেই স্বাগত জানিয়েছে দেশের সর্বস্তরের ব্যবসায়ী মহল। মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো এবং অর্থনীতিবিদরা। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, এটি মূলত ব্যবসায়ীদের জন্য ঋণ প্যাকেজ। গরিব মানুষের জন্য কোনো অনুদান নয়। যদিও বিএনপি মাত্র একদিন আগে ৮৭ হাজার কোটি টাকার একটি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণার দাবি জানিয়েছিল সরকারের কাছে। ১৪ দল তাদের প্রতিক্রিয়ায় এই প্রণোদনা প্যাকেজকে অভিনন্দন জানানোর পাশাপাশি তুলোধোনা করছে গার্মেন্টস শিল্পের মালিকদের। প্যাকেজে কৃষক, কামার, কুমার, জেলে-তাঁতি সর্বস্তরের মানুষ উপকৃত হবে, তবে গার্মেন্টস খোলা রাখার সিদ্ধান্ত নিয়ে বিজিএমইএর দ্বিধাদ্বন্দ্বের অমানবিক ও স্বেচ্ছাচারিতা এবং এই অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলেছে বলে মন্তব্য করেছে তারা। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে এই প্রণোদনার যাতে অপব্যবহার না হয় এবং সুশাসনের মাধ্যমে বিতরণ করে প্রকৃত শিল্প উদ্যোক্তারা যাতে ঋণ পায় তার ওপর জোর দিয়েছেন। বাসদ নেতা খালেকুজ্জামান খুদে দোকানদার, গ্যারেজ মালিক, ভ্যান গাড়িরচালক, সবজি বিক্রেতা, বস্তিবাসী ও রিকশাচালকসহ অনানুষ্ঠানিক খাতের কোটি মানুষ প্রণোদনার বাইরে থেকে যাবে বলে মন্তব্য করেছেন। সিপিবি দেশের সবচেয়ে বড় উৎপাদনের খাত কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষ এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য অনুদান ঘোষণার দাবি জানিয়েছে।
অর্থনীতিবিদ ড. মইনুল ইসলাম বলেছেন, এটা একটা লোন কর্মসূচি। মনে হচ্ছে না লুটপাট হবে তবে নজরদারির বিকল্প নেই। এছাড়া অর্থনীতিকে আগের পর্যায়ে নিতে হলে এটাই প্রণোদনার শেষ পদক্ষেপ নয় বরং এটাকে শুরু হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। ডক্টর আহসান এইচ মনসুর অবশ্য এই প্রণোদনার সঠিক ব্যবস্থাপনার ওপর জোর দিয়েছেন। এই বিপুল অঙ্কের অর্থের জোগান কোথা থেকে আসবে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম এবং সিপিডির ফেলো ডক্টর মুস্তাফিজুর রহমান, প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন যেন জটিল না হয় তার ওপর জোর দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর এই প্যাকেজ ঘোষণার পরপরই ব্যবসায়ী মহলে যেমন উৎসাহ দেখা যাচ্ছে তেমনি আবার সমাজের অন্যান্য খাত থেকেও নানা প্রণোদনা দেয়ার দাবি উঠছে। একথা অনস্বীকার্য, অর্থনীতি যে একটি কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে তাতে সমাজের সব স্তরের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের জন্য নানা ধরনের প্রণোদনা এখন সময়ের দাবি হয়ে উঠছে। এই দেশের একটি বিরাট জনগোষ্ঠী এখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে, প্রায় এক কোটির মতো লোক এখনো বেকার এবং এক জরিপে দেখা গেছে তিন বেলা খাবার পায় না এরকম মানুষের সংখ্যা অনেক। ফলে করোনার কারণে অর্থনৈতিক বিপর্যয় মানুষের ভাতের থালায় যে আঘাত এনেছে সেটা সামলাতে হলে সার্বিক নানা সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি প্রণোদনা প্যাকেজের পাশাপাশি কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি রেশন কার্ডের মাধ্যমে ২ টাকা কেজিতে চাল সরবরাহসহ নানা ধরনের খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করছেন, যা নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষের সংকট কিছুটা হলেও লাঘব করবে। আমাদের দেশের ১০ টাকা কেজিতে চাল বিক্রির উদ্যোগটি সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য কিন্তু অঘোষিত লকডাউন পালনের এই সময়ে ১০ টাকা কেজিতে চাল কেনার সামর্থ্য অনেকের হয়তো নাই। দুস্থ এবং সহায়হীন মানুষের জন্য বিকল্প একটি ব্যবস্থা সরকার করতে পারে, কারণ সরকারের কাছে খাদ্যশস্যের মজুত রয়েছে প্রচুর। যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত দেশগুলোতে প্রণোদনা প্যাকেজের পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক কর্মসূচি নেয়া হয়েছে যেটি হয়তো আমাদের পক্ষে সম্ভব না। এসব দেশে ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠানোসহ বাড়ি ভাড়া ও অন্যান্য ইউটিলিটি বিল মওকুফ এবং আরো নানা পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে মানুষকে সহায়তা করার জন্য। শুধু যুক্তরাষ্ট্রের যে প্রণোদনা প্যাকেজ সেটি একটু বিশ্লেষণ করলে আমরা কিছুটা চিত্র হয়তো পাব। ট্রাম প্রশাসনের ২ ট্রিলিয়ন ডলারের প্রণোদনা প্যাকেজের মধ্যে আছে- যারা চাকরি হারিয়েছে তাদের জন্য ২৫০ বিলিয়ন ডলার, বিভিন্ন শিল্প খাতের জন্য সরাসরি মূলধন দেয়া হবে ৩০০ বিলিয়ন ডলার, বেতন-ভাতা ও অন্যান্য খাতে খরচের জন্য ক্ষুদ্র শিল্পকে দেয়া হবে ৩৪৯ বিলিয়ন ডলার এবং ১৫০ বিলিয়ন ডলার দেয়া হবে বিভিন্ন রাজ্য সরকারকে। ব্যাংকগুলোকে সরবরাহের জন্য ফেডারেল রিজার্ভ ফান্ডে রাখা হয়েছে আরো প্রায় এক ট্রিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি।বিশ্বের বিভিন্ন দেশের এই নানা উদ্যোগ করোনা আক্রান্ত অর্থনীতিকে কতখানি চাঙ্গা করবে তা এই মুহূর্তে বলা মুশকিল, তবে করোনা পরবর্তী অর্থনীতির ধারা-প্রকৃতি নিয়ে ইতোমধ্যে ভাবতে শুরু করে দিয়েছেন খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদরা। যে সংজ্ঞায় আমরা অর্থনীতিকে সংজ্ঞায়িত করি তা কতখানি ভঙ্গুর করোনা ভাইরাস আমাদের সেটা প্রমাণ করে দিয়েছে। খ্যাতনামা নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন এবং জোসেফ স্টিগ্লিচ বলেছেন, জিডিপি কখনো জীবন মানদণ্ডের পরিমাপ হতে পারে না। যদি তাই হতো, তাহলে ধারাবাহিক জিডিপি সত্ত্বেও দারিদ্র্য কেন কমছে না। উন্নত দেশগুলোতে ভৌত অবকাঠামোর ওপর যতখানি গুরুত্ব দেয়া হয় স্বাস্থ্যের ওপর ততখানি জোর দেয়া হয় না। যদি তাই হতো সামান্য মাস্ক কিংবা পিপিই-এর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত দেশকে এরকম হাহাকার করতে হতো না। সম্প্রতি চীন থেকে জার্মানির উদ্দেশে রওনা দেয়া একটি মাস্কের চালান জোর করে যুক্তরাষ্ট্র নিয়ে গেছে বলে অভিযোগ করেছে জার্মান সরকার। অন্যদিকে চীনের কাছ থেকে ফ্রান্সের কেনা একটি মাস্কের চালান বেশি দাম পেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে বলে অভিযোগ করেছে ফ্রান্স। এরকম কর্মকাণ্ড নীতি-নৈতিকতাবিহীন বলে প্রশ্ন তুলেছে ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশ। কিন্তু এর মধ্য দিয়ে যে জিনিসটা সবচেয়ে বেশি ফুটে উঠেছে তা হলো- এই উন্নত দেশগুলোর উন্নয়নের চেহারাটি আসলে কতখানি ভঙ্গুর। করোনা ভাইরাসের এই সংকটে আরো একটি সত্য প্রকটভাবে প্রকাশিত হয়েছে তা হলো- বিশ্বায়ন কখনোই মানুষের অন্তরে কোনো মেলবন্ধন সৃষ্টি করতে পারেনি। বিশ্বায়নের নামে বড় পুঁজির জন্য বাজার উন্মুক্ত হয়েছে কিন্তু মানুষের যাতায়াত হয়েছে সীমিত। শ্রমবাজার আরো কঠিন হয়েছে, পণ্যের বাজার উন্মুক্ত করার চেষ্টা ছিল সর্বাধিক। ভারতের নোবেলজয়ী অভিজিৎ ব্যানার্জি ও তার ফরাসি স্ত্রী এস্তার দুফলোর একটি কথোপকথন সম্প্রতি ছাপা হয়েছে ভারতের গণমাধ্যমে। করোনা আক্রান্ত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর জন্য সংকটের একটি চেহারা তুলে ধরেছেন তারা। স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে থাকা দুর্বল অর্থনীতির দেশগুলোতে জীবন অনেক কঠিন। এ সমস্ত দেশে জীবন বড় না জীবিকা বড়- তা বিবেচনা করতে হয় সবার আগে। বাংলাদেশের জন্য এই কথাটি বোধহয় সবচেয়ে বেশি প্রযোজ্য।