আজকের দিন তারিখ ২৭শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শুক্রবার, ১২ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সর্বশেষ সংবাদ
অন্যান্য জবির জমিদাতা কিশোরীলাল রায় চৌধুরীর বংশধরদের জীবন কাটছে দুর্দশায়

জবির জমিদাতা কিশোরীলাল রায় চৌধুরীর বংশধরদের জীবন কাটছে দুর্দশায়


পোস্ট করেছেন: Dinersheshey | প্রকাশিত হয়েছে: ডিসেম্বর ১৩, ২০২২ , ৯:০৩ অপরাহ্ণ | বিভাগ: অন্যান্য


জবি প্রতিনিধি : কিশোরীলাল রায় চৌধুরী শিক্ষার আলো ছড়ানোসহ জনহিতকর কাজে যিনি ছিলেন অগ্রনায়ক আজ তার বংশদের ঘরের আলো নিভু নিভু করছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা কিশোরীলাল রায় চৌধুরী। যিনি  ১৮৪৮ সালের ১৯শে নভেম্বর মানিকগঞ্জ জেলার সাটুরিয়া থানার বালিয়াটি জমিদার পরিবারের প্রখ্যাত পশ্চিম বাড়ীতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর পিতার নাম মহাত্মা জগন্নাথ রায় চৌধুরী।  তিনি ১৮৮৪ সালের ৪ঠা জুলাই তাঁর পিতার নামে জগন্নাথ কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন, যা বর্তমান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় নামে পরিচিতি। বালিয়াটির প্রসিদ্ধ জমিদার শ্রীযুক্ত কিশোরীলাল রায় চৌধুরী ঢাকায় বাংলা বাজারে ১৮৮৭ সালে তাঁর নিজ নামে কিশোরীলাল জুবিলী হাইস্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি নাট্য চর্চার উন্নতির জন্য মালঞ্চ নামে ঢাকাতে তিনি একটি রঙ্গমঞ্চ গড়ে তোলেন। সেই  রঙ্গমঞ্চটি বর্তমানে লায়ন্স সিনেমা নামে পরিচিত। বালিয়াটিতে তিনি একটি দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপন করেন যা অদ্যাবধি সরকারী নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হচ্ছে। ১৯২৫ সালের ৩ জুলাই বাবু কিশোরীলাল রায় চৌধুরী পরলোকগমন করেন।

আজ তারই বংসধরদের মলিন পোশাক, জীর্ণ আসবাবপত্র আর রং চটে খসে পড়া ঘরের পলেস্তারা দেখে বোঝার উপায় নেই এটি এক সময়ের প্রতাপশালী বালিয়াটির জমিদার ও ব্রিটিশ সরকার থেকে রায় খেতাবপ্রাপ্ত কিশোরীলাল রায় চৌধুরীর শেষ বংশধর কালিশঙ্কর রায় চৌধুরীর বাড়ি। কালিশঙ্কর রায় কিশোরীলালের নাতির ছেলে। বংশানুক্রমে মানিকগঞ্জের বালিয়াটি জমিদার প্রাসাদে আগে বসবাস করলেও দেশ স্বাধীনের পর বাংলাদেশ প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগ নিদর্শন হিসেবে এটি সংরক্ষণ করছে। তাই কালিশঙ্কর রায় তার স্ত্রী ও এক মেয়েকে নিয়ে চলে আসেন ঢাকায়। কালিশঙ্কর রায়ের আরো দুই ভাই ও এক বোন থাকলেও তারা বহু বছর আগে ভারতে পাড়ি জমান এবং সেখানেই পরলোকমন করেন। তবে তাদের নেই কোনো ছেলে সন্তান। এছাড়া কালিশঙ্কর রায়ের এক মেয়ে বাদে কোনো ছেলে সন্তান না থাকায় তিনিই কিশোরীলালের সর্বশেষ বংশধর হিসেবে স্বীকৃত। কিন্তু কালিশঙ্কর রায়ের জীবন কাটছে দুর্দশায়। এ দেশের শিক্ষা বিস্তারে নিঃস্বার্থে কিশোরীলাল নিজের নামে কিশোরীলাল জুবিলি স্কুল ও তার বাবা জগন্নাথ রায়ের নামে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে (তৎকালীন স্কুল) জমি দেন। অথচ জীবন জীবিকার টানে বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়েই চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে কাজ করছেন জমিদাতার বংশধরের জামাতা। ছেলে না থাকায় সংসার চালানোর একমাত্র অবলম্বন বৃদ্ধ কালিশঙ্করের জামাতা বিপ্লব সাহা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি বিভাগের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে নিয়োজিত। তবুও সে চাকরি অস্থায়ী। জামাতার চাকরি স্থায়ী করার জন্য বার বার কালিশঙ্কর রায় ও তার স্ত্রী ভারতী রায় চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলেও এখনো মেলেনি সাড়া। এছাড়া জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দিবসসহ কোনো অনুষ্ঠানে ডাকা হয় না বিশ্ববিদ্যালয়টির জমিদাতা এই বংশধরদের। ১৯৯২ সালে জগন্নাথ কলেজে শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষে পরিবারসহ ডাক পান কালিশঙ্কর রায় চৌধুরী। দেয়া হয় বিশেষ মর্যাদা। তবে বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার পর ২০১৯ সালে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সমাবর্তন অনুষ্ঠানে ডাক পান কালিশঙ্কর ও তার স্ত্রী। তবে সবার মাঝে দিতে দেয়া হয় না বক্তব্য বা পরিচয়। এছাড়া ১৯৯৪ সালে কিশোরীলাল জুবিলি স্কুল ও কলেজের ১২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে বিশেষ মর্যাদা দেয়া হয় বংশধরদের। এদিকে, এক সময়ের প্রতাপশালী জমিদার কিশোরীলালের বংশধরের জীবন কেমন কাটছে তা জানতে ভোরের কাগজ থেকে রায়ের বাজার স্কুলের পেছনে তাদের বাড়িতে যাওয়া হয়। এ সময় কালিশঙ্কর রায় চৌধুরী বলেন, এ দেশের শিক্ষা বিস্তারের জন্য জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, কিশোরীলাল জুবিলি স্কুল, মালঞ্চ থিয়েটার হলসহ ( বর্তমানে লায়ন সিনেমা) নানা জায়গা আমার দাদার বাবা দিয়ে গেছেন। বালিয়াটির জমিদার প্রাসাদও আমাদের। আমার ছেলে বেলা কেটেছে সেখানে। মুক্তিযুদ্ধের পর আমাদের বাড়ি প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে সংরক্ষণের জন্য নিয়ে নেয় সরকার। এর বদলে আমাদের থাকার কোনো বাড়ি দেয়নি। এছাড়া আমাদের অনেক জমি অনেকে নিয়েছে। মাঝেমধ্যে জমির নামপত্তনের জন্য তারা আমার স্বাক্ষর নিতে আসে। ভয়ভীতি দেখায়, তবে স্বাক্ষর দেই না। তিনি আরো বলেন, আমার বাবার আমল পর্যন্ত জমিদারি ছিল। পরে ১৯৫০ এর দিকে জমিদারি প্রথা বাতিল হয়ে যায়। আমাদেরও সম্পদের ভাটা পড়তে থাকে। ১৯৭২ সালে আমি জগন্নাথ কলেজে পড়েছি। তখন অর্থাভাব ছিল। তাই জমিদাতার বংশধর বলে চিঠি দিলে অধ্যক্ষ কলেজে বেতন নিত না। এরপর একটি টেক্সটাইল মিলে পার্টনার হিসেবে কাজ শুরু করি। তবে বহু বছর আগে মিল শেষ হয়ে গেছে। সম্পত্তির মধ্যে আমার এই দুই রুমের ঘর ও আরেকটি ভঙ্গুর দুই রুমের কামরা আছে। মাসে ১৫-২০ হাজার টাকা ভাড়া পাই। ছেলে নেই, জামাতাই একমাত্র সম্বল। আমাদেরই প্রতিষ্ঠান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে জামাতা কর্মচারী হিসেবে অস্থায়ী চাকরি করে। তবে স্থায়ী কবে হয় সেই আশায় আছি। কালিশঙ্করের স্ত্রী ভারতী রায় চৌধুরী বলেন, আমরা অর্থ সম্পদ চাই না। শুধু সম্মানটুকু চাই। জগন্নাথ কলেজ আমলে আমাদের ডাকা হতো। জুবিলি স্কুল থেকেও ডাকা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন দিবসে আমাদের ডাকলে ভালো লাগবে। জামাতার চাকরি স্থায়ী হয়ে গেলে বৃদ্ধ বয়সে শান্তি পেতাম। এছাড়া পরিবার নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছার কথাও জানালেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের জমিদাতার পরিবার ও চাকরি স্থায়ীর বিষয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার প্রকৌশলী মো. ওহিদুজ্জামানের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বংশধরের দুইজন আসেন মাঝে মধ্যে। তাদের জামাতা অস্থায়ী চাকরি করে। ইউজিসি থেকে পদ না আসলে স্থায়ীর বিষয়ে আমাদের কিছু করার নেই। জগন্নাথ কলেজের শতবর্ষ পূর্তিতে প্রকাশিত স্মরণিকার তথ্যমতে, ১৮৬৮ সালে জমিদার কিশোরীলাল চৌধুরী বাবার নামে জগন্নাথ স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৮৪ সালে এটি কলেজে রূপান্তরিত হয়। পরে কিশোরীলাল ১৯০৭ সালের ১ মার্চ একটি ট্রাস্ট দলিল করে ট্রাস্টবোর্ড গঠন করে কলেজের নামে জমি দেন। ওই বোর্ডের তিন সদ্যসের মধ্যে একজন ছিলেন কিশোরীলাল। দুই বছর পরে ১৯০৯ সালের ৩ জুন কিশোরীলাল মারা গেলে আগস্টে নতুন ট্রাস্ট দলিল গঠন হয়। এরপর থেকেই পুরোপুরিভাবে জমি প্রতিষ্ঠানটির হয়ে যায়। সর্বশেষ ২০০৫ সালে আইন পাসের মাধ্যমে কলেজ থেকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় রূপ পায়।