দায় বোধের উপাখ্যান
পোস্ট করেছেন: dinersheshey | প্রকাশিত হয়েছে: জুলাই ৭, ২০২১ , ২:৫২ অপরাহ্ণ | বিভাগ: সম্পাদকীয়
শ্যামল দত্ত , সম্পাদক : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে এক ব্রিটিশ কবি ও সাংবাদিক নিহত হয়েছিলেন বাংলাদেশের সীমান্ত সংলগ্ন মিয়ানমারের (সে সময় বার্মা) রাখাইন স্টেটে। মাত্র ২৮ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করা এই কবি ও সাংবাদিক ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে তার অনমনীয় অবস্থান ও তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার প্রত্যয় নিয়ে। জাপানিদের হাতে পরাজিত হয়ে ব্রিটিশ বাহিনী যখন বার্মা ছেড়ে চট্টগ্রামের দিকে ঢুকছে, তখন টেকনাফের সীমান্ত সংলগ্ন রাখাইন স্টেটের যুদ্ধক্ষেত্রে এই ব্রিটিশ কবি, সাংবাদিক ও সৈনিক অ্যালান লুইস ১৯৪৪ সালের ৫ মার্চ আত্মহত্যা করেন। মৃত্যুর আগে এই তরুণ ইংরেজ কবি লিখেছিলেন, ‘চারপাশের পরিবেশ দেখে ক্ষুব্ধ হওয়ার মতো এতই বস্তু আছে যে, এখানে সংযতমনা হওয়া সম্ভব নয়। সমাজের চেহারায় যদি দিশাহারা হওয়ার মতো বস্তু থাকে, তাহলে সেখানে দিশাহারা না হওয়াটাই অস্বাভাবিক।’
এই ইংরেজ কবিকে উদ্ধৃত করে লেখা শুরু করলাম সঙ্গত কারণেই। চারপাশের অবস্থা দেখে দিশাহারা হওয়ার মতোই অবস্থা। দিশাহারা না হওয়াটাই যেন অস্বাভাবিক। দেশে লকডাউন চলছে, মানুষের যাতায়াত খুবই সীমিত। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কারো ঘর থেকে বের হওয়াই নিষেধ। সভা-সমিতি, বৈঠক অনুষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে। রাস্তায় বের হলেই লোকজন গ্রেপ্তার হচ্ছে। গত পাঁচ দিনে কয়েক হাজার লোকের জরিমানা, গ্রেপ্তার বা হাজতবাস হয়েছে। এর মধ্যেই আল্লামা বাবুনগরীর নেতৃত্বে হেফাজতের নেতারা চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এসেছেন এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। প্রশ্ন উঠেছে, সরকার ঘোষিত লকডাউন কি হেফাজতের জন্য প্রযোজ্য নয়? চট্টগ্রাম থেকে গাড়ি নিয়ে তারা ঢাকায় এলেন লকডাউন ভেঙে? হেফাজত কি লকডাউনের ঊর্ধ্বে? যেসব জরুরি সার্ভিসকে ছাড় দিয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ নির্দেশনা জারি করেছে, সেখানে হেফাজতকে ছাড় দেয়ার কথা তো উল্লেখ ছিল না! তাহলে তারা চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা পৌঁছলেন কীভাবে?
কয়েক দিন আগেও বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ইস্যুতে আল্লামা বাবুনগরী হুমকি দিয়েছিলেন, যারা মূর্তি বানাতে চায়- তাদের ক্ষমতা থেকে টেনে-হিঁচড়ে নামানো হবে। এখন সেই বাবুনগরীর সঙ্গে লকডাউনের মধ্যেই বৈঠক করছেন ক্ষমতাসীন সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। একদিকে হেফাজতের মধ্যম সারির কিছু নেতাকে দেশজুড়ে চালানো নজিরবিহীন তাণ্ডবের জন্য গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, অন্যদিকে সেই হেফাজতের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে বৈঠক করছেন আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে নিয়োজিত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। এসব দেখে প্রয়াত ইংরেজ কবি অ্যালান লুইসের মতো দিশাহারা না হওয়াটাই অস্বাভাবিক নয় কি?
দিশাহারা হওয়ার মতো ঘটনা আরো অনেক আছে। মগবাজারের বিস্ফোরণের ঘটনার ১০ দিন অতিক্রান্ত হয়ে গেল। এত দিনেও বিস্ফোরণে ঘটে যাওয়া ১১ জন মানুষের মৃত্যুর জন্য কাউকে দায়ী করা গেল না। ১০ দিন আগে পুলিশের দায়ের করা মামলায় কেউ গ্রেপ্তার হননি এখনো। যারা মারা গেছেন তারা অতি সাধারণ মানুষ। কেউ যানজটে আটকে পড়া ড্রাইভার, কেউ দারোয়ান, কেউ পথচারী, কেউ কর্মচারী অথবা কেউ ভ্যানচালক। আমাদের বর্তমান রাষ্ট্র ব্যবস্থায় এ ধরনের মানুষের বিচার পাওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই ক্ষীণ। এতদিনে কারো গ্রেপ্তার না হওয়ার এটাও হয়তো একটা কারণ। বিধ্বস্ত ভবন ‘রাখি ভিলা’র মালিক কে?- তাও জানা সম্ভব হয়নি। যে দোকান থেকে এই বিস্ফোরণ, সেই শরমা হাউসের মালিককেও খুঁজে পাওয়া যায়নি। পাশের দোকান বেঙ্গল মিটের ফ্রিজে পচে যাচ্ছে কাঁচা মাংস। দুর্গন্ধে এলাকার মানুষের টিকে থাকা দায়। বিস্ফোরণে ভেঙে যাওয়া গ্যাসের লাইন থেকে গ্যাস বেরোচ্ছে। তিতাস কর্তৃপক্ষ বলছে, এই ভবনে তাদের কোনো লাইন ছিল না। ফলে তাদের কোনো দায়দায়িত্ব নেই। তিতাসের দায়িত্ব নেই, রাজউকের দায়িত্ব নেই, সিটি করপোরেশনেরও দায়িত্ব নেই। তাই এসব দুর্ভোগ থেকে এলাকাবাসীকে মুক্তি দেয়ার দায়িত্বও আদতে কারোরই থাকার কথা নয়। আসলে আমরা এখন সবাই দায়িত্বহীন। দায়িত্ব নিলে দায়িত্ব পালন করতে হয়। দায়িত্ব না নিলে দায়িত্ব পালন করার বাধ্যবাধকতা থাকে না। ফলে দায়িত্ব না নেয়াটাই শ্রেয় ও বুদ্ধিমানের কাজ। তাই আমরা সবাই বুদ্ধিমান হয়ে গেছি। এত বড় দুর্ঘটনার পর ঢাকা দক্ষিণের সিটি মেয়র একবারের জন্যও ঘটনাস্থলে যাননি। এলাকার নির্বাচিত এমপি রাশেদ খান মেননের দেখাও পাওয়া যায়নি। এ রকম একটি মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করা হতভাগ্য দরিদ্র মানুষগুলো ক্ষতিপূরণ পাবে- এমন বিশ্বাস কারো আছে বলে আমার মনে হয় না। এই বিস্ফোরণের ঘটনা ১১টি অসহায় পরিবারকে যে একটি অবর্ণনীয় দুর্দশার মধ্যে ফেলল, সেই দায়টা যে কার- সেটা তাই খুঁজতে যাওয়াও অর্থহীন।
শুধু মগবাজারের দুর্ঘটনা নয়, আরো গুরুত্বপূর্ণ অনেক কিছু খুঁজে না পাওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের অবহেলা সীমাহীন ও ব্যর্থতা অপরিসীম। তিন শিশুসন্তানকে রেখে খুনের মামলায় আসামি না হয়েও শুধু অর্থকষ্টের কারণে কিছু অর্থ লাভের আশায় একজনের হয়ে সাজা খাটার জন্য কারাগারে গিয়েছিলেন মিনু আক্তার। তিন বছর অন্যের সাজা ভোগ করে গত ১৬ জুন চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন তিনি। কারামুক্তির ১৩ দিনের মাথায় চিরতরে জীবন থেকেও মুক্তি নিলেন মিনু আক্তার। ২৮ জুন রাতে চট্টগ্রামের বায়েজিদ বোস্তামী-ফৌজদারহাট সংযোগ সড়কে একটি দ্রুতগতির ট্রাক মিনুকে চাপা দিয়ে পালিয়ে যায়। কেউ বলছেন ট্রাক, কেউ বলছেন টেম্পো। সীতাকুণ্ডের জাফরাবাদ এলাকার বাসিন্দা মিনু কী করে এই বায়েজিদ বোস্তামী-ফৌজদারহাট সংযোগ সড়কে গেলেন, তা কেউ খুঁজে বের করতে পারেননি। অন্যদিকে হাসপাতালে একদিন চিকিৎসাধীন থাকার পর মৃত্যুবরণ করা মিনুর পরিচয় উদ্ধার করতে না পেরে অজ্ঞাত পরিচয় হিসেবেই লাশ দাফন করেছে আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলাম। মিনুর বড় ভাই রুবেল হোসেন দাবি করেছেন, তার বোনকে ট্রাকে চাপা দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। তিনি এই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত ও বিচার দাবি করেছেন।
মিনু আক্তার ২০১৮ সালে ঘটে যাওয়া চট্টগ্রামের রহমতগঞ্জ এলাকার একটি হত্যাকাণ্ডের মামলার সাজাপ্রাপ্ত এক নারী আসামির বদলে সাজা খাটছিলেন। কথা ছিল মাসে মাসে মিনু আক্তারের পরিবারকে অর্থ সাহায্য দেয়া হবে। চরম অর্থকষ্টে থাকা মিনু আক্তার এই প্রস্তাবে রাজি হয়েছিলেন। কয়েক মাস টাকা দেয়ার পর সেই হত্যা মামলার সাজাপ্রাপ্ত আসামি মিনুর পরিবারকে টাকা দেয়া বন্ধ করে দেয়। বিষয়টি চট্টগ্রামের জেল কর্তৃপক্ষকে খুলে বলার পর অন্যের হয়ে সাজা খাটা মিনু আক্তার উচ্চ আদালতের নির্দেশে মুক্তি পান। কিন্তু বিস্ময়ের বিষয় হচ্ছে, সংঘটিত হত্যা মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়েছিলেন কুলসুমা কিন্তু জেল খেটেছিলেন মিনু। মিনুকে কুলসুমা সাজিয়ে আত্মসমর্পণ করিয়ে জেলে পাঠানো হলো। কুলসুমাকে কিন্তু কেউ আর খুঁজে বের করল না। এক হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী না হয়েও মিনু আক্তার জেল খাটলেন। এখন মিনু আক্তার হত্যাকাণ্ডের জন্য কেউ যে জেল খাটবে না, এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায়। কারণ মিনুর এই হত্যা বা দুর্ঘটনার মামলায় সাক্ষ্য দেয়ার কেউ নেই, কোন গাড়ি মেরেছে তাও চিহ্নিত করা যাচ্ছে না, অন্যদিকে মিনু মারা গেছেন অজ্ঞাতপরিচয় হিসেবে এবং লাশও দাফন হয়েছে বেওয়ারিশ হিসেবে। আমরা তো জানি, এদেশে অজ্ঞাতপরিচয় বা বেওয়ারিশ লাশের দায় কারো নেই। তাই এসব মৃত্যুর কোনো বিচারও হয় না। ফলে মিনু আক্তারের এই মৃত্যুও এক বিচারহীন ঘটনা হিসেবেই থেকে যাবে।
দায় নিয়ে যখন এত কথা, তখন দায় সংক্রান্ত আরো দু-একটি কথা বলা যাক। দেশের লকডাউনে অনাহারে না খেয়ে থাকে অনেক মানুষ। মন্ত্রী আছেন, এমপি আছেন, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি- সবাই আছেন। তবুও এই লকডাউনের মধ্যে রাস্তার পাশে ভুখানাঙ্গা মানুষগুলোর মুখের দিকে তাকানো যায় না। এসব মানুষের মুখে খাবার তুলে দেয়ার জন্য যেন কারো কোনো দায় নেই। এর মধ্যে দায় নিয়ে বসে আছেন আসমা আক্তার লিজার মতো নাটক-সিনেমাপাগল একটা মেয়ে। স্বামী-স্ত্রী, বন্ধুবান্ধব মিলে নানা মানুষের সহযোগিতায় প্রতিদিন ৩-৪ হাজার লোককে মোহাম্মদপুর-লালমাটিয়া এলাকায় খাওয়ানোর দায়িত্ব নিয়েছেন এই মেয়েটি। রানা প্লাজা দুর্ঘটনার সময় স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে উদ্ধারকাজে অংশ নিয়েছিলেন এই আসমা আক্তার লিজা। এখন তার মেহমানখানায় প্রতিদিন খাবার পাচ্ছে নিরন্ন হাজারো মানুষ। এই সমাজে নিজ দায়িত্বে কাঁধে দায় তুলে নেয়ার কিছু মানুষ আছে বলেই সমাজটা হয়তো এখনো টিকে আছে। যাদের দায়িত্ব তারা দায়িত্ব উপলব্ধি করছে না, অন্যদিকে নিজ দায়িত্বে দায় নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন, ভালো কাজের বিনিময়ে আহার ও লিজার মেহমানখানার মতো বহু সংগঠন ও ব্যক্তি উদ্যোগ। আমরা দেখছি, ঢাকা ক্লাবের মতো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এই লকডাউনে মধ্যে দরিদ্র ও নিরন্ন মানুষের মুখে খাবার তুলে দেয়ার দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে চাই, বার্ট্রান্ড রাসেলের স্মরণীয় এক উক্তি। বার্ট্রান্ড রাসেল বলেছিলেন, ‘No society can be great without great individuals.’ এই দায় কাঁধে নেয়া ‘গ্রেট ইন্ডিভিজুয়ালরাই’ হয়তো একদিন একটি মহৎ সমাজ গড়ে তুলবে। আশার জায়গাটা সেটাই এবং একমাত্র সেটাই।
পাদটীকা : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আম কূটনীতি ব্যাপক সাড়া ফেলেছে ভারতে। প্রধানমন্ত্রী রংপুরের বিখ্যাত হাঁড়িভাঙ্গা আম পাঠিয়েছেন ভারতের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি, ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেব এবং আসাম ও মেঘালয়ের মুখ্যমন্ত্রীদের জন্য। কোভিড ভ্যাকসিন দেয়া না দেয়া নিয়ে দুদেশের মধ্যে যে কিছুটা তিক্ততা তৈরি হয়েছে, রংপুরের এই সুস্বাদু আম তাকে কতখানি মিষ্টি করে তুলবে, তা অবশ্য দেখার বিষয়। দিল্লি প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি সাংবাদিক গৌতম লাহিড়ী গতকাল পাঠানো এক বার্তায় জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রীর পাঠানো একটি আমের প্যাকেট তিনিও পেয়েছেন এবং আম ক‚টনীতির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। গৌতম লাহিড়ী আরো লিখেছেন, তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে সৃষ্ট জটিলতায় ইলিশ কূটনীতির বদলে এই আম কূটনীতি ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের নতুন মাত্রা তৈরি করতে পারে।
খেতে অত্যন্ত সুস্বাদু এই আমটির নাম কে ‘হাঁড়িভাঙ্গা’ রেখেছে, তা নিয়ে একটি গবেষণা হতে পারে। কারণ বাংলায় ‘হাটে হাঁড়ি ভাঙা’ নামে আরেকটি প্রবাদ বাক্যও চালু রয়েছে!