দেশে প্রতিবছর অসংখ্য মানুষের মৃত্যু হয় মশার কারণে
পোস্ট করেছেন: dinersheshey | প্রকাশিত হয়েছে: সেপ্টেম্বর ১৬, ২০২২ , ৫:৫৭ অপরাহ্ণ | বিভাগ: /////হাইলাইটস/////
দিনের শেষে প্রতিবেদক : ২০১৯ সালে দেশে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু রোগের ভয়াবহতা ছড়িয়ে পড়েছিল। ওই সময়ে এক লাখ এক হাজার মানুষ আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। মারা যান ১৭৯ জন। সেই সময়ে ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তবে অজ্ঞাত কারণে হারিয়ে গেছে সেই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ পরিকল্পনা। জানা গেছে, ওই সময়ে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে উলবাকিয়া ব্যাকটেরিয়া এবং জেনেটিক্যালি মডিফায়েড মশা-অক্সিটেক পদ্ধতি নিয়ে কয়েক দফায় সভা অনুষ্ঠিত হয়। এমনকি এ বিষয়ে একটি জাতীয় কারিগরি কমিটিও গঠন করা হয়। তবে হঠাৎ করে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বদলি হয়ে যাওয়ায় এসব পরিকল্পনা আর আলোর মুখ দেখেনি। এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক ( রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, ২০২০ সালে সারা বিশ্বের মতো দেশে করোনা মহামারী ছড়িয়ে পড়ে। এই মহামারী নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো প্রাধান্য পায়নি। এখন করোনা সংক্রমণ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে। তাই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কাজ করার সুযোগ পাওয়া যাবে। আশা করছি, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে শিগগিরিই ইতিবাচক কার্যক্রম গ্রহণ করতে পারব। বিশেষজ্ঞরা বলেন, মশা এমন একটি প্রাণী যে ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়াসহ বিভিন্ন ধরনের জীবাণু বহন করে। শুধু বহন করেই ক্ষান্ত হয় না, সামান্য এক কামড়ে এসব জীবাণু ছড়িয়ে দিতে পারে একজন থেকে আরেক জনে। মশাদের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর এডিস মশা। এর জন্ম আফ্রিকায় প্রায় চারশ বছর আগে। কিন্তু এরপর এটি পৃথিবীর গ্রীষ্মমণ্ডলীয় সব এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। আন্তর্জাতিক এক পরিসংখ্যান বলছে, শুধু মশার কারণে এক বছরে নানা রোগে আক্রান্ত হয় ৭০ কোটির মতো মানুষ। তাদের মধ্যে মৃত্যু হয় ১০ লাখের বেশি মানুষের।
বাংলাদেশেও প্রতিবছর অসংখ্য মানুষের মৃত্যু হয় মশার কারণে। মশা নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশে বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায় বছরের পর বছর নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু তারপরও এডিস মশা মানুষের কাছে আতঙ্কের নাম। কারণ এই এডিস মশাই ডেঙ্গু ও চিকনগুনিয়ার সংক্রমণ ঘটিয়ে হাজার হাজার মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত করে তোলে। এডিস মশার এসব ভয়াবহতা বিবেচনা করে ২০১৯ সালে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ দুটো বিকল্প উপায় নিয়ে আলোচনা করে। এজন্য বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি জাতীয় পরামর্শক কমিটিও গঠন করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এমনকি বিভিন্ন দেশ থেকে বিশেষজ্ঞ এনে দেশে সেমিনার-সিম্পোজিয়াম করা হয়। কমিটির সদস্যরা উলবাকিয়া ব্যাকটেরিয়া এবং জেনেটিক্যালি মডিফায়েড মশা-অক্সিটেক এই দুই পদ্ধতির ওপর গুরুত্বারোপর করেন। চীনে এই দুটি পদ্ধতি নিয়ে পরীক্ষা করা হয়েছে দুই বছর সময় ধরে। সেখানে দেখা গেছে, মশার বংশবিস্তার প্রায় ৯০ শতাংশ কমে গেছে। উলবাকিয়া পদ্ধতি : উলবাকিয়া এক ধরনের প্রাকৃতিক ব্যাকটেরিয়া। বিভিন্ন কীটপতঙ্গের দেহকোষে এই ব্যাকটেরিয়া পাওয়া যায় এবং ডিমের মাধ্যমে এটি এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে প্রবাহিত হয়।
প্রায় ৬০ শতাংশ কীটপতঙ্গের শরীরে এই উলবাকিয়া ব্যাকটেরিয়া থাকলেও এডিস মশার শরীরে থাকে না। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এডিস মশার কোষে এই ব্যাকটেরিয়া ঢুকিয়ে দেখা গেছে, এর মাধ্যমে চিকনগুনিয়া, ডেঙ্গু, জিকা ও ইয়েলো ফিভারের মতো চারটি ভাইরাসজনিত রোগের সংক্রমণ প্রতিরোধ করা সম্ভব। বিজ্ঞানীরা বলছেন, সূক্ষ্ম এই প্রযুক্তি উদ্ভাবন করতে তাদের সময় লেগেছে ১৫ বছর। উলবাকিয়া ব্যাকটেরিয়া ঢুকিয়ে দেওয়া ডিম থেকে জন্ম নেওয়া মশার শরীরে ডেঙ্গু ভাইরাস প্রবেশ করানোর পর বিস্ময়করভাবে তার সংক্রমণ ঘটেনি। বিজ্ঞানীরা দেখেন যে ভাইরাসটি ওই মশার ভেতরে ঠিকমতো বেড়ে উঠতে পারছে না। অস্ট্রেলিয়ায় দশ সপ্তাহ ধরে পরিবেশে এসব মশা ছাড়া হয়েছে। কয়েক মাস পরে দেখা গেছে, সেখানকার ১০০ ভাগ মশাতেই উলবাকিয়া আছে এবং সেই ধারা এখনো অব্যাহত রয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার পরে এই পদ্ধতি বিশ্বের ১২টি দেশে পরীক্ষা করে সাফল্য পাওয়া গেছে। এসব দেশের মধ্যে রয়েছে শ্রীলংকা, কলম্বিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ভারত, ভিয়েতনাম, মেক্সিকো। জিনগত পরিবর্তন-অক্সিটেক : ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে মূলত উলবাকিয়া পদ্ধতি নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি ওই সময়ে দেশে জিনগত পরিবর্তন বা অক্সিটেক মশা ছাড়ার বিষয়ে আলোচনা হয়। ২০১৯ সালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিশেষ টেকনিক্যাল কমিটিতে আলোচনা হয়। বাংলায় এই মশাকে ‘বন্ধু মশা’ হিসেবে নামকরণ করা হয়।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাগারে ১৬ বছর ধরে গবেষণার পর এ ধরনের মশা উৎপাদন করা সম্ভব হয়েছে। যা যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রাজিলসহ কয়েকটি দেশে ব্যবহার করা হয়েছে ম্যালেরিয়া ও জিকা ভাইরাস প্রতিরোধে। এই পদ্ধতিতে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে মশার কোষে বিশেষ ধরনের জিন প্রবেশ করানো হয়। এর ফলে মশার মধ্যে জিনগত পরিবর্তন ঘটে। ব্রিটেনে অক্সিটেক নামের একটি বায়োটেক কোম্পানির বিজ্ঞানীরা ২০০২ থেকে এ নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। তাদের লক্ষ্য ছিল, জিনগত পরিবর্তন ঘটানোর মধ্য দিয়ে পরিবেশে এডিস মশার সংখ্যা কমিয়ে ফেলা। অক্সিটেকের বিজ্ঞানীরা জানান, গবেষণাগারে জন্ম দেওয়া এসব ‘বন্ধু মশা’ প্রকৃতিতে ছেড়ে দেওয়া হয়। তখন প্রকৃতিতে থাকা নারী এডিস মশার প্রজননে যেসব মশার জন্ম হয়, সেগুলো বেঁচে থাকতে পারে না। ফলে এডিস মশার সংখ্যা কমতে শুরু করে। ২০১৯ সালে বাংলাদেশে ডেঙ্গু মোকাবিলায় স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা এই দুটো পদ্ধতির তুলনা করে দেখেছেন। উলবাকিয়া পদ্ধতির ব্যাপারে ওয়ার্ল্ড মসকিউটো প্রোগ্রামের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষকে প্রস্তাবও করা হয়। প্রাকৃতিক উপায় হওয়ার কারণে এতে খরচ কম। এর ফলে মশার ইকোলজিতেও (বাস্তু সংস্থান) কোনো পরিবর্তন ঘটে না। এর ভালো দিক হচ্ছে এটি একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া। যেসব দেশে এই পদ্ধতি পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে, সেসব দেশে এখন পর্যন্ত তেমন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। সব কিছুই আগের মতোই থাকবে, মশাও থাকবে, সেই মশা কামড়াবে; কিন্তু উলবাকিয়ার কারণে ভাইরাসজনিত সেই রোগগুলোর সংক্রমণ ঘটবে না। অন্যদিকে, জিনগত পরিবর্তন করা মশা দিয়ে ডেঙ্গু মোকাবিলা হবে অত্যন্ত ব্যয়বহুল। কারণ ল্যাবরেটরিতে এই ‘বন্ধু মশা’ জন্মাতে হবে। এ ছাড়াও প্রকৃতিতে সব সময় এই মশা ছাড়া অব্যাহত রাখতে হবে। সূত্র-আমাদের সময়।