আজকের দিন তারিখ ২৬শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, মঙ্গলবার, ১১ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সর্বশেষ সংবাদ
সারাবিশ্ব নারীর সঙ্গে একাধিক পুরুষকে বিয়ের প্রস্তাবে তোলপাড়

নারীর সঙ্গে একাধিক পুরুষকে বিয়ের প্রস্তাবে তোলপাড়


পোস্ট করেছেন: dinersheshey | প্রকাশিত হয়েছে: জুন ২৯, ২০২১ , ১:১৫ অপরাহ্ণ | বিভাগ: সারাবিশ্ব


দিনের শেষে ডেস্ক :  দক্ষিণ আফ্রিকা সরকার একজন নারীর একইসাথে একাধিক পুরুষকে বিবাহ করার বিষয়টি বৈধ করার যে প্রস্তাব দিয়েছে, তাতে দেশটির রক্ষণশীল সমাজে প্রতিবাদের ঢেউ উঠেছে। এই প্রস্তাবে এত ব্যাপক প্রতিবাদের ঝড় ওঠায় অনেক বিশ্লেষকই বিস্মিত হয়েছেন। এ বিষয় নিয়ে কাজ করা সুপরিচিত শিক্ষাবিদ কলিস মাচোকো বিবিসিকে বলেন, এই আপত্তির মূলে রয়েছে পুরুষদের ‘নিয়ন্ত্রণের’ সংস্কৃতি। তিনি বলেন, ‘আফ্রিকান সমাজ এখনও সমান অধিকারের জন্য তৈরি হয়নি। যে নারীকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না, তার সাথে কী ধরনের আচরণ করা উচিৎ, সেটা আমরা জানি না। বিশ্বে খুবই উদারপন্থী সংবিধান যেসব দেশে রয়েছে তার একটি হল দক্ষিণ আফ্রিকা। দেশটির সংবিধানে সমকামী নারী ও সমকামী পুরুষদের মধ্যে বিয়ে এবং পুরুষদের জন্য বহুবিবাহ বৈধ। দক্ষিণ আফ্রিকার টিভি ব্যক্তিত্ব এবং ব্যবসায়ী মুসা এমসেলেকুর চার বৌ। তিনি নারীদের বহুবিবাহের বিরোধী। তিনি বলেন, ‘এটা আফ্রিকার সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে দেবে। এদের সন্তানদের কী হবে? তারা কীভাবে জানবে তাদের পিতা কে?’

দক্ষিণ আফ্রিকায় রিয়ালিটি টিভির পর্দায় তার একাধিক স্ত্রীর সাথে সংসার বিষয়ক অনুষ্ঠান করে তারকা খ্যাতি পেয়েছেন তিনি। মুসা এমসেলেকুর বলেন, ‘নারীরা এখন পুরুষের ভূমিকা নিতে পারে না। এমন কথা কেউ আগে কখনও শোনেনি। মেয়েরা কি এখন বিয়ে করার জন্য পুরুষদের লোবোলা (দেনমোহর) দেবে? পুরুষরা ওই নারীর পদবি (সারনেম) গ্রহণ করবেন এমনটাই কি এখন আশা করা হবে?’

গোপন বিয়ে

অধ্যাপক মাচোকো জন্ম প্রতিবেশি জিম্বাবুয়েতে। সেখানে নারীদের বহুবিবাহ নিয়ে তিনি গবেষণা করেছেন। তিনি এমন ২০ জন নারীর সাথে কথা বলেছেন যাদের একাধিক স্বামী রয়েছে। এ রকম ৪৫ জন স্বামীর সাথে তিনি কথা বলেছেন যারা অন্য স্বামীদের সাথে মিলে স্ত্রীর ঘর করেন। অধ্যাপক মাচোকো বলেন, এ ধরনের বিয়ে জিম্বাবুয়ের সমাজে অগ্রহণযোগ্য এবং আইনগতভাবে স্বীকৃত নয়। তিনি বলেন, ‘নারীদের বহুবিবাহ যেহেতু সমাজের একটা অংশ ভাল চোখে দেখে না, তাই সেখানে এ ধরনের বিয়ে হয় গোপনে। এ ধরনের সংসারের খবরও গোপন রাখা হয়।’

অধ্যাপক মাচোকো বলেন, ‘কেউ যদি এ ধরনের সংসার দেখলে প্রশ্ন তোলেন বিশেষ করে এমন কেউ যাদের তারা চেনেন না বা বিশ্বাস করেন না, তারা এ রকম কোন বিয়ের কথা পুরোপুরি অস্বীকার করে যান। তাদের মধ্যে প্রতিশোধ বা নির্যাতন ও হয়রানির ভয় কাজ করে।’ প্রফেসর মাচোকো যাদের ওপর তার গবেষণার কাজ করেছেন তাদের সবার ক্ষেত্রেই স্বামীরা স্ত্রীর ঘরে একসাথে থাকেন না। তারা থাকেন আলাদা আলাদাভাবে, সমাজ যাতে তাদের বিয়ের কথা না জানে। কিন্তু তারা সবাই একই স্ত্রীর সাথে সংসর্গ করেন এবং স্বামীরা নিজেদের মধ্যে এ নিয়ে খোলাখুলিই কথাবার্তা বলেন।

মাচোকো বলেন, ‘এদের মধ্যে একজন নারী বলেন তার বয়স যখন ১২, যখন তিনি স্কুলের ছাত্রী, তখন থেকেই তিনি একাধিক পুরুষকে একসাথে বিয়ে করার চিন্তা লালন করতে শুরু করেন। লেখাপড়ার সময় তিনি জেনেছিলেন, মৌচাকে রানি মৌমাছি থাকে একজন আর তাকে ঘিরে থাকে বহু পুরুষ মৌমাছি। তারা সবাই একসাথে ওই রানির সঙ্গে সহবাস করে।’ প্রাপ্তবয়স্ক হবার পর ওই নারী একাধিক পুরুষসঙ্গীর সাথে যৌন সংসর্গ শুরু করেন। ওই পুরুষরা সবাই পরস্পরকে চিনতেন এবং বিষয়টা জানতেন। তিনি বলেন, ‘তার বর্তমানে যে নয়জন স্বামী রয়েছেন, তাদের মধ্যে চারজন ওই পুরনো দলে ছিলেন।’

জিম্বাবুয়েতে অধ্যাপক মাচোকো দেখেছেন, নারীদের বহুবিবাহের ক্ষেত্রে সাধারণত নারীরাই সম্পর্ক শুরু করেন এবং পুরুষদের সবাইকেই বিয়ের পর তার সাথে সহবাসের আমন্ত্রণ জানান। কেউ কেউ বিয়ের জন্য নারী দেনমোহর দেন, কেউ আবার তা না দিয়ে ওই নারীর জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় খরচের অংশ বহন করেন। ওই নারী যদি দেখেন তার কোন স্বামী, অন্য স্বামীদের মধ্যে ঝগড়া বাধাবার বা তার সংসারে অশান্তি সৃষ্টির করছেন, তাকে ঘর থেকে তাড়িয়ে দেবার ক্ষমতাও ওই নারী রাখেন।

অধ্যাপক মাচোকো বলছেন, তিনি যাদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তারা বলেছেন অন্য স্বামীদের সাথে মিলে এক বৌ-এর ঘর করার পেছনে তাদের মূল কারণ ছিল ওই নারীর প্রতি তাদের ভালোবাসা। তারা কেউই ওই নারীকে হারানোর ঝুঁকি নিতে চাননি।

কয়েকজন পুরুষ বলেছেন তারা তাদের স্ত্রীদের যৌন চাহিদা মেটাতে অক্ষম ছিলেন, কিন্তু ডিভোর্স মেনে নেবার বদলে বরং অন্য স্বামীদের সাথে মিলেমিশে থাকাটাই ভাল বলে মেনে নিয়েছেন। কোন কোন পুরুষের সিদ্ধান্তের পেছনে কারণ ছিল তাদের বন্ধ্যাত্ব। স্ত্রী যাতে সন্তানধারণ করতে পারেন তার জন্য স্ত্রীর আরেক বিবাহ তারা মেনে নিয়েছেন। এভাবে ওই বন্ধ্যা পুরুষরা সমাজে নিজেদের ‘মুখ রক্ষা’ করেছেন এবং তাদেও ‘পৌরুষের’ অভাব নিয়ে সমাজে আলোচনার হাত থেকে বেঁচেছেন।

ধর্মীয় নেতারা অসন্তুষ্ট

অধ্যাপক মাচোকো বলেছেন, দক্ষিণ আফ্রিকায় নারীদের বহুবিবাহ সম্পর্কে তিনি ওয়াকিবহাল নন। তবে, নারী পুরুষ সমানাধিকার নিয়ে আন্দোলনকারীরা নারীর সমানাধিকার ও ইচ্ছাকে গুরুত্ব দেবার দাবিতে নারীদের বহুবিবাহকে আইনি স্বীকৃতি দেবার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানায়। দেশটির বর্তমান আইনে একাধিক নারীকে বিয়ে করার অধিকার আছে শুধু পুরুষের।

দক্ষিণ আফ্রিকা সরকারের গ্রিন পেপার নামে সরকারি নথিতে এই প্রস্তাব অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ১৯৯৪ সালে শ্বেতাঙ্গ সংখ্যালঘুদের শাসনকালের অবসানের পর এই প্রথম দেশটির বিবাহ আইনে বড় ধরনের রদবদল আনার পরিকল্পনা সরকার নিয়েছে। তাই সরকার এই নথিটি জনসাধারণের মতামত জানানোর জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছে।

‘এই গ্রিন পেপারের মূল লক্ষ্য হল মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়ন। কাজেই মানবাধিকারের এই দিকটাও মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ,’ বলছেন শার্লিন মে, যিনি নারীদের জন্য একটি আইনি কেন্দ্রে উইমেন্স লিগ্যাল সেন্টারের আইনজীবী। এই সংস্থা নারীদের অধিকার নিয়ে কাজ করে। তিনি বলেন, ‘আইনের সংস্কার যেখানে লক্ষ্য সেখানে পুরুষদের দৃষ্টিভঙ্গিকে অগ্রাধিকার দিতে গিয়ে নারীদের অধিকার যাতে ক্ষুণ্ন না হয়, সেটাও দেখতে হবে,।’

বিভিন্ন সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া

এই নথিতে মুসলিম, হিন্দু, ইহুদী এবং রাস্ট্রাফেরিয়ান সব জনগোষ্ঠীরই বিবাহকে আইনগত স্বীকৃতি দেবার প্রস্তাব করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ এই প্রস্তাবকে স্বাগত জানালেও ধর্মীয় নেতারা নারীদের বহুবিবাহকে আইনগত স্বীকৃতি দেবার বিষয়টিকে নিন্দা জানিয়েছেন।

বিরোধী দল আফ্রিকান ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রাটিক পার্টির নেতা রেভারেন্ড কেনেথ মেশো বলেন, এই পদক্ষেপ ‘সমাজ ধ্বংস’ করে দেবে। তিনি বলেন, ‘এমন পর্যায়ে আমরা পৌঁছব যখন একজন স্বামী স্ত্রীর কাছে অভিযোগ করবেন তুমি অন্য স্বামীর সাথে বেশি সময় কাটাও, আমাকে যথেষ্ট সময় দাও না। তারপর দুই স্বামীর মধ্যে শুরু হবে দ্বন্দ্ব।

ইসলামিক আল-জামা পার্টির নেতা গানিয়েফ হেনড্রিক্স বলেছেন, ‘চিন্তা করে দেখুন, ওই নারীর সন্তান জন্মের পর ডিএনএ পরীক্ষা করে নির্ধারণ করতে হবে কোন স্বামী ওই সন্তানের বাপ!’

শিশু ও পরিবার

এমসেলেকু যুক্তি দেখাচ্ছেন, দক্ষিণ আফ্রিকায় সমানাধিকার নীতির নামে বাড়াবাড়ি করাটা সঠিক হবে না। তিনি বলেন, ‘বিষয়টা সংবিধানে আছে বলেই যে সেটা আমাদের সমাজের জন্য ভাল- এমনটা মনে করার তো কোন কারণ নেই।’

তাকে প্রশ্ন করা হয় তার নিজের তো চারজন স্ত্রী। তাহলে একজন নারীর বেলায় এই বৈষম্য কেন? নারীর চারজন স্বামী থাকলে সমস্যা কোথায়? উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমার চারটে বিয়ে, তাই এ ব্যাপারে আমার মতামতকে অনেকে বলছে ভণ্ডামি। কিন্তু আমার জবাব হল- নারীদের জন্য বহুবিবাহ আফ্রিকান সমাজ ও সংস্কৃতির বিরোধী। আমাদের সংস্কৃতিকে আমরা বদলাতে পারি না।’

কিন্তু অধ্যাপক মাচোকো বলছেন, নারীদের বহুবিবাহ প্রথা একসময় চালু ছিল কেনিয়া, কঙ্গো প্রজাতন্ত্র এবং নাইজেরিয়ায়। গ্যাবোনে নারীরা এখনও বহুবিবাহ করে, সেটা ওই দেশে আইনসিদ্ধ। তিনি বলেন, ‘খ্রিস্টান ধর্মের আগমন এবং ঔপনিবেশিক শাসন, সমাজে নারীর ভূমিকাকে খাটো করে দিয়েছিল। তাদের সমান চোখে দেখা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আর সমাজে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল বিবাহ প্রথা।’

প্রফেসর মাচোকো বলেন, একাধিক স্বামীর সাথে নারীর সহবাসের মধ্যে দিয়ে জন্মানো সন্তান নিয়ে যেসব উদ্বেগ সমাজে প্রকাশ করা হয়, তার কারণ হল পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা। তিনি বলেন, ‘এ ধরনের সংসারে জন্মানো শিশু নিয়ে প্রশ্ন উঠবে কেন? যে শিশু ওই নারীর গর্ভে আসছে সে তো তার পুরো পরিবারেরই সন্তান।’