পানিবন্দি ৩ লক্ষাধিক মানুষ, তলিয়ে গেছে ঘরবাড়ি
পোস্ট করেছেন: dinersheshey | প্রকাশিত হয়েছে: মে ৩১, ২০২৪ , ৩:৪৪ অপরাহ্ণ | বিভাগ: /////হাইলাইটস/////
সিলেট প্রতিনিধি : সিলেটের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও সিলেট সদরসহ অন্যান্য এলাকায় পানি বাড়ছে। তবে এখনো বানভাসি লোকজন আশ্রয় কেন্দ্রেই অবস্থান করছেন। এখনো আকস্মিক বন্যায় সিলেটের ৫টি উপজেলার ৩৬ টি ইউনিয়নের ৩ লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি রয়েছেন। অন্যদিকে সিলেটের নদ নদীর সবকটা পয়েন্টে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। বিপদসীমার উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। স্থানীয় সূত্র মতে, জেলার গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর, কোম্পানীগঞ্জ, কানাইঘাট ও জকিগঞ্জ উপজেলায় ৩ লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে আছেন। এখানকার বেশিরভাগ এলাকার ঘরবাড়ি বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। অনেকের ঘরের ভিতরে কোমর সমান পানি আবার অনেকের ঘর একেবারে ডুবে গেছে। প্রধান প্রধান সড়কগুলোতে পানি উঠে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। মানুষজন কোথাও বের হতে পারছেন না। নষ্ট হচ্ছে ঘরবাড়ির মালামাল। অনেকে ঘরের মালামাল ও গবাদি পশু রেখে আশ্রয়কেন্দ্রেও যাচ্ছেন না। ঘরবাড়ি পানিতে তলিয়ে যাওয়াতে রান্নাবান্নারও সুযোগ নেই। নেই শুকনো খাবারও। মানুষের বাড়িঘরে দ্রুত পানি ঢুকে পড়ায় অনেক মানুষ ঘরবন্দি হয়ে পড়েছেন। পর্যাপ্ত নৌকার অভাবে আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে বেগ পোহাতে হয় বানভাসীদের। জকিগঞ্জে ভারতের বরাক নদী দিয়ে আসা পাহাড়ি ঢলে সুরমা-কুশিয়ারা নদীর কয়েকটি স্থানে ডাইক ভেঙে ৪টি ইউনিয়নের অন্তত ৪০/৫০ টি গ্রাম প্লাবিত হয়। সেখানে ৫৮টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত করা হয়েছে এবং মানুষজনও সেখানে অবস্থান করছেন। জকিগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার আফসানা তাসলিম জানান, পানি কিছুটা কমেছে। উপজেলার ৯টি ইউনিয়নের মধ্যে ৪টি ইউনিয়ন ইতোমধ্যে প্লাবিত হয়েছে। কুশিয়ারার অমলসীদ পয়েন্টে কাল থেকে বিপদসীমার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। বন্যার্তদের জন্য ৫৮টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রয়েছে এবং ২০-২৫ টি পরিবার সেখানে উঠেছেন। তারা সেখানে রয়েছেন। কানাইঘাটেও বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে কানাইঘাট উপজেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করে। সুরমা ও লোভা নদীর তীব্র স্রোতের কারণে বিভিন্ন এলাকায় সুরমা ডাইক ভেঙে পানি লোকালয়ে প্রবেশ করার কারণে উপজেলার লক্ষ্মীপ্রসাদ পূর্ব, লক্ষ্মীপ্রসাদ পশ্চিম, দিঘীরপাড় পূর্ব, বড়চতুল, সদর ইউনিয়ন ও পৌরসভার সমস্ত জনপদ, জনগুরুত্বপূর্ণ সড়ক ও রাস্তাঘাট বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। শত শত বাড়িঘরে হাঁটুপানি থেকে কোমর পানি বিরাজ করছে। বেশিরভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পানিতে তলিয়ে গেছে। লোকালয় সহ বিস্তীর্ণ এলাকা বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় বিপুল সংখ্যক মৎস্য খামার ও সবজি বাগানের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। কানাইঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফারজানা নাসরীন বলেন, উপজেলার ৯টি ইউনিয়নের ৮টি ইউনিয়নই প্লাবিত হয়েছে। মানুষজন আশ্রয়কেন্দ্রেই রয়েছেন। সুরমা নদীর পানি কানাইঘাট পয়েন্টে বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গোয়াইনঘাটের উজানের ইউনিয়নগুলোতে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। তবে নিচের ইউনিয়নগুলোর আরো অবনতি ঘটছে। ঢলের পানিতে সড়কের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. তৌহিদুল ইসলাম জানান, উপজেলার ৭০ ভাগের বেশি এলাকা প্লাবিত হয়েছে। ২৬টি আশ্রয়কেন্দ্রে ২ হাজার ৩৫৬ জন মানুষ ও ৬৪৫টি গবাদি পশু আশ্রয় নিয়েছে। ১ হাজার ৬৬০ হেক্টর আবাদি জমির ফসল পানিতে নিমজ্জিত। ৩৪৩ বর্গ কিলোমিটার এলাকা প্লাবিত হয়েছে। বন্যা দুর্গত মোট ৪২ হাজার ৯০০ টি পরিবারের ২ লাখ ৪৫ হাজার ৯৫০ জন মানুষ পানিবন্দী রয়েছেন। জৈন্তাপুরে বুধবার রাতে ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হলেও বৃহস্পতিবার দিনে তৎপরতায় মানুষের মধ্যে স্বস্তি ফিরেছে। দিনভর আটকেপড়া লোকজনকে উদ্ধার করে আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে আসা হয়। তারা এখনো আশ্রয় কেন্দ্রেই আছেন। জৈন্তাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা উম্মে সালিক রুমাইয়া বলেন, রাতের অবস্থা ছিল খুবই ভয়াবহ। পানি একটু কমতে শুরু করেছে। মূলত থেমে থেমে বৃষ্টির কারণে পানি ধীর গতিতে নামছিলো। উপজেলার বানভাসি মানুষজন আশ্রয়কেন্দ্রের পাশাপশি নিকটস্থ আত্মীয়স্বজনের নিরাপদ উঁচু স্থাপনাতেও আশ্রয় নিয়েছেন। আমরা যতটা সম্ভব সব জায়গায় পৌঁছানোর চেষ্টা করছি। জেলা থেকে পাওয়া ত্রাণ ছাড়াও আমরা ঢাকা এবং অন্যান্য জায়গা থেকে ত্রাণ এনে সকল মানুষের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করছি। অন্যদিকে কোম্পানীগঞ্জে টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার অধিকাংশ নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। উপজেলা পরিষদ মাঠ, থানা রোড ও থানা কম্পাউন্ড জলমগ্ন হয়ে পড়েছে। ধলাই ও পিয়াইন নদীর পানি উপচে বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তলিয়ে গেছে উপজেলার ফসলি জমি ও মাছের খামার। বেশ কিছু গ্রামীণ রাস্তাঘাট ডুবে গেছে। উপজেলার সর্বত্র গোখাদ্যের সংকট দেখা দিয়েছে। দুর্গত এলাকায় বিশুদ্ধ পানি ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুনজিত কুমার চন্দ বলেন, নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। মানুষজনের জন্য ৩৫টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। ১০০টি নৌকা উদ্ধার ও ত্রাণ কাজের জন্য প্রস্তুত আছে। আমরা মাইকিংও করেছি। কারো আশ্রকেন্দ্রে আসতে অসুবিধা হলে আমাদের ভলান্টিয়াররা গিয়ে আনবেন এদিকে জেলার ৫ টি উপজেলায় (গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর, কোম্পানীগঞ্জ, কানাইঘাট ও জকিগঞ্জ) সমহারে ২০০ বস্তা করে ১ হাজার বস্তা শুকনো খাবার, ১৫ মেট্রিক টন করে ৭৫ মেট্রিক টন চাল, ৫০ হাজার টাকা করে ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা ত্রাণসামগ্রী বরাদ্দ প্রদান করা হয়েছে বলে জানিয়েছে জেলা প্রশাসন। অপরদিকে সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোবারক হোসেন জানিয়েছেন, পানিবন্দি মানুষকে উদ্ধারে প্রস্তুত রয়েছে সেনাবাহিনী। প্রয়োজন হলেই তারা তৎপরতা শুরু করবে বলে জানান তিনি। জেলা প্রশাসনের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী ৪ হাজার ৮শ পরিবার বর্তমানে আশ্রয় কেন্দ্রে আছে। ৫ লাখ ৩৩ হাজার ২০২ জন বন্যায় আক্রান্ত হয়েছেন। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) জানায়, গতকাল সিলেট পয়েন্টে সুরমা নদীর পানি বিপদসীমার ১৯ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়। তবে, কানাইঘাটে সুরমা বিপদসীমার ১৩৮ সেন্টিমিটার, আমলসীদে কুশিয়ারা বিপদসীমার ২১৩ সেন্টিমিটার, শেওলায় কুশিয়ারা বিপদসীমার ২০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। অন্যদিকে সুরমা নদীন পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় নগরীর নিচু এলাকায় পানি উঠতে শুরু করেছে। তবে সেটি ধীরগতিতে। সিলেট আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ মোহাম্মদ সজীব হোসাইন জানান, গত সোমবার সিলেটে ২৪৯ দশমিক ২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়, মঙ্গলবার ১৪৬ দশমিক ১ মিলিমিটার এবং বুধবার ২৪ ঘণ্টায় ১৯ দশমিক ২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। চলতি মৌসুমে স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি বৃষ্টিপাত হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ২০২২ সালে মে মাসে সিলেটে রেকর্ড করা বৃষ্টির পরিমাণ ছিল ৮৩৯ মিলিমিটার, ২০২৩ সালের মে মাসে ছিল ৩৩০ মিলিমিটার এবং ২০২৪ মে মাসের বৃহস্পতিবার পর্যন্ত রেকর্ড করা বৃষ্টির পরিমাণ ৭০৫ মিলিমিটার। এয়াড়া বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে শুক্রবার সকাল ৬টা পর্যন্ত ৬১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। তাপামাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ২২.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে ১৩১টি মেডিক্যাল টিম গঠন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সিলেটের সিভিল সার্জন ডা. মনিসর চৌধুরী। তিনি বলেন, জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে সার্বিক প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। দেড় লাখ পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট, ২ লাখ ২০ হাজার এন্টিভেনম ইনজেকশন, পর্যাপ্ত খাবার স্যালাইন ও কলেরা স্যালাইন মজুদ রয়েছে। বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তুতি নিয়েছে জেলা প্রশাসনও। জনগণের আতঙ্কগ্রস্ত হওয়ার কিছু নেই উল্লেখ করে সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোবারক হোসেন বলেন, জেলা ও উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির জন্য কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। প্রয়োজনে উদ্ধার অভিযান ও ত্রাণ তৎপরতায় অংশ নেবে সেনাবাহিনী। এদিকে, ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে ভারী বৃষ্টি ও উজানের ঢলে আকস্মিক বন্যায় প্লাবিত হয়েছে সিলেটের সীমান্তবর্তী ৫টি উপজেলার বেশিরভাগ এলাকা। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন সাড়ে ৫ লাখের বেশি মানুষ। নদ-নদীর পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করায় ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে সিলেটের সীমান্তবর্তী উপজেলাগুলোতে অবস্থিত পর্যটন কেন্দ্রগুলো। এ অবস্থায় পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত পর্যটন কেন্দ্রগুলো বন্ধ ঘোষণা করেছে সংশ্লিষ্ট উপজেলা প্রশাসন। গোয়াইঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. তৌহিদুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, জাফলং,বিছানাকান্দি , রাতারগুল, পান্থুমাইসহ সব ক’টি পর্যটনকেন্দ্র বন্ধ ঘোষণা করে বুধবার নোটিশ দিয়েছি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত বন্ধ থাকবে। কেননা,পাহাড়ি ঢলে নদীগুলোর পানি বৃদ্ধি পেয়ে এসব পর্যটনকেন্দ্র ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। যে কারণে বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে পর্যটকের ভ্রমণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুনজিত কুমার চন্দ সাক্ষরিত এক আদেশে বলা হয়, অবিরাম বর্ষণ ও ঢলে ধলাই নদীর পানি অব্যাহতভাবে বেড়ে পর্যটনকেন্দ্রগুলো পানিতে তলিয়ে গেছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত সাদাপাথর পর্যটনকেন্দ্রসহ সব পর্যটনকেন্দ্র বন্ধ ঘোষণা করা হলো। সিলেটের উজানে অবস্থান ভারতের মেঘালয় ও আসাম রাজ্যে। এসব রাজ্যের ভারী বৃষ্টি হলে বৃষ্টির পানির ঢল সিলেটের দিকে নেমে আসে। ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে সিলেটে গত কয়দিন থেকে থেমে থেমে ভারী বর্ষণ হচ্ছে। বিশেষ করে উজানে ভারতের চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টিপাতের কারণে নদ-নদীর পানি বেড়েছে।