পিলখানা ট্র্যাজেডি : সাজা শেষ হলেও ঝুলে আছে অনেকের মুক্তি
পোস্ট করেছেন: dinersheshey | প্রকাশিত হয়েছে: ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০২৩ , ৩:৩৩ অপরাহ্ণ | বিভাগ: /////হাইলাইটস/////
দিনের শেষে প্রতিবেদক : একে একে কেটে গেছে ১৪ বছর। এখনো শেষ হয়নি পিলখানা হত্যাকাণ্ডের কোনো মামলার চূড়ান্ত বিচারকাজ। এ ঘটনার দায়ের হওয়া হত্যা মামলার রায় উচ্চ আদালত হয়ে এখন আটকে আছে আপিল বিভাগে। বিস্ফোরক আইনে করা অন্য মামলার বিচার এখনো চলছে বিচারিক আদালতেই। এরই মধ্যে অনেক আসামির হত্যা মামলায় সাজা ভোগ শেষ হয়েছে। কিন্তু বিস্ফোরক মামলা বিচারাধীন থাকায় তারা মুক্তি পাচ্ছেন না। ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি কিছু বিপথগামী সদস্য দাবি আদায়ের নামে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) সদর দপ্তর পিলখানায়। অগ্নিসংযোগ, লুটপাটের পাশাপাশি তৎকালীন মহাপরিচালকসহ ৫৭ জন বিভিন্ন পর্যায়ের সেনা কর্মকর্তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। বিপথগামী বিদ্রোহীদের হাত থেকে রেহাই পায়নি শিশু ও নারীরাও। তারা নারী ও শিশুসহ ১৭ জন বেসামরিক নাগরিককেও নির্মমভাবে হত্যা করে। বহুল আলোচিত এ ঘটনায় দায়ের করা মামলায় (পিলখানা হত্যা মামলা) ১৩৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড, ১৮৫ জনকে যাবজ্জীবন এবং ২০০ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দিয়েছেন হাইকোর্ট। আসামির সংখ্যার দিক থেকে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় মামলা এটি। মামলাটি এখন আটকে আছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে। এ বিষয়ে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল আবু মোহাম্মদ (এএম) আমিন উদ্দিন জানান, এ বছরই আপিল শুনানি শুরু করতে চান তারা। পিলখানায় ভয়াবহ নৃশংসতার পর হত্যা ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে আলাদা দুটি মামলার বিচার একসঙ্গে শুরু হয়।
বিচারিক আদালত ও হাইকোর্ট- দুই জায়গাতেই হত্যা মামলার বিচার শেষ হয়েছে। এখন দেশের উচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে চূড়ান্ত শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। তবে একই ঘটনায় নিম্ন আদালতে ঝুলে আছে বিস্ফোরক আইনে করা অপর মামলাটি। যদিও এরই মধ্যে কেটে গেছে ১৪ বছর। ভয়াবহ এ হত্যাকাণ্ডের এত বছর পরও বিস্ফোরক আইনে করা মামলাটি এখনো বিচারিক (নিম্ন) আদালতের গণ্ডি পেরোয়নি। সাক্ষ্য গ্রহণের অপেক্ষায় থাকা বিস্ফোরক মামলায় এখন পযন্ত ২৫৭ জন সাক্ষী তাদের সাক্ষ্য দিয়েছেন। আগামী ২৭ এবং ২৮ ফেব্রুয়ারি সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য দিন ধার্য রয়েছে। এ অবস্থায় মামলাটির কার্যক্রম চলতি বছরেই শেষ হতে পারে বলে আশা প্রকাশ করেছেন প্রসিকিউটর মো. মোশাররফ হোসেন কাজল। এদিকে, হত্যা ও বিদ্রোহ মামলায় খালাস মিললেও কারাগার থেকে বের হতে পারছেন না দুই শতাধিক আসামি। এ অবস্থায় মামলার আপিল শুনানির জন্য প্রয়োজনে আবারও বিশেষ বেঞ্চ গঠন করে দ্রুত চূড়ান্ত নিষ্পত্তির দাবি জানিয়েছেন আসামিপক্ষের আইনজীবীরা। আইনজীবী আমিনুল ইসলাম বলেন, দুটি মামলার মধ্যে একটি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। অথচ অন্যটি এখনো ট্রায়াল পর্যায়ে। খুব সহজেই বোঝা যায় রাষ্ট্রপক্ষের সদিচ্ছারও ঘাটতি রয়েছে। আমরা উভয় মামলা খুব দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য অনেকবার চেষ্টা করেছি, করে যাচ্ছি। অনুরোধ করবো, রাষ্ট্রপক্ষ যেন দুটি মামলাই দ্রুত নিষ্পত্তি করেন। আলোচিত এ মামলায় বিশেষ বেঞ্চ গঠন করা হবে কি না- জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল আবু মোহাম্মদ (এএম) আমিন উদ্দিন বলেন, নিয়মিত যে আপিল বিভাগ বেঞ্চ আছে, সেখানেই এর বিচার হবে। রাষ্ট্রের প্রধান এ আইন কর্মকর্তা জানান, আলোচিত এ মামলার শুনানি চলতি বছরেই হতে পারে। আপিলের সারসংক্ষেপ একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জমা দিতে হবে আসামি ও রাষ্ট্রপক্ষকে। সেটি চার সপ্তাহ থেকে ছয় সপ্তাহ সময়ের মধ্যে হতে পারে, এর বেশি কোনোভাবেই হবে না। এরই মধ্যে রাষ্ট্রপক্ষ আপিলের সারসংক্ষেপ জমা দিয়েছে। আসামিপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট আমিনুল ইসলাম বলেন, আমরা সারসংক্ষেপ জমা দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। আমরাও এই মামলায় আপিল শুনানির জন্য প্রস্তুত রয়েছি। পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহ ও নৃশংস হত্যাকাণ্ডের এক মামলার বিচারের দুই ধাপ শেষ হয়েছে বিচারিক আদালত ও হাইকোর্টে। রায় কার্যকর করতে হলে আপিল বিভাগের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের পর রিভিউ এবং রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার বিষয়টি নিষ্পত্তি করতে হবে। রাষ্ট্রপক্ষ বলছে, শেষ ধাপটি চলতি বছরই হতে পারে।
হত্যা মামলায় হাইকোর্টে খালাসপ্রাপ্ত এবং যাদের সাজা কমানো হয়েছে, তাদের সাজা বাড়াতে আপিল ও লিভ টু আপিল দাখিল শেষ করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত এবং বিভিন্ন মেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের খালাস চেয়ে আপিল ও লিভ টু আপিল দাখিলও শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এরপর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে প্রথমে উভয়পক্ষের লিভ টু আপিলের গ্রহণযোগ্যতার ওপর শুনানি হবে। তারপর আপিলের শুনানি ও মামলা চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হবে। তবে কিছুদিনের মধ্যেই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আপিল শুনানির উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন। তিনি বলেন, হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে ৩৩টি আপিল দাখিল করা হয়েছে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে এ বছর আপিল শুনানি হতে পারে। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আশা করছি এই বছরেই এ মামলার শুনানি করতে পারবো। তিনি বলেন, পিলখানায় যে মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে, নৃশংসভাবে সেনা কর্মকর্তাদের হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় করা মামলায় অনেকের মৃত্যুদণ্ডাদেশ হয়। ফৌজদারি কার্যবিধি অনুসারে মৃত্যুদণ্ড অনুমোদনের জন্য হাইকোর্টে আসে, সঙ্গে দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিরাও আপিল করেন। হাইকোর্ট বিভাগের রায়ে অনেকের সাজা কমেছে, অনেকের বহাল আছে। এ এম আমিন উদ্দিন আরও বলেন, হাইকোর্টের রায়ে যাদের সাজা বহাল আছে তাদের মধ্যে ৩৩ জন আপিল বিভাগে আপিল ফাইল করেন। এরপর আসামিপক্ষ মামলার আপিলের সার সংক্ষেপ জমা না দেওয়ায় মামলাটা আমরা শুনানি করতে পারছিলাম না। তাদের সারসংক্ষেপ জমা দেওয়ার জন্য আমরা একটা ফাইল করেছি। এই ৩৩টা ফাইল আসবে। তাদেরকে একটা সময় দেওয়া হবে। ওই সময়ের মধ্যে যদি তারা না দেয় তাহলে তাদের আপিলটা ডিসমিস হবে। আশা করছি এই বছরই এই মামলার শুনানি করতে পারবো। গত বছরও আপনাদের একই বক্তব্য ছিল- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গত বছর আমরা চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু তারা জমা দেয়নি। সেই কারণে আমরা আবেদন করেছি। আদালতের কাছে চাইবো তাদের যেন একটা সময় নির্ধারণ করে দেন। ওই সময়ের মধ্যে তারা যদি না দেয় তাহলে তাদের আবেদন ডিসমিস করে দেবেন। অ্যাটর্নি জেনারেল আরও বলেন, শুরু হওয়াটা অনেক কিছুর উপর নির্ভর করে। আদালতের ওপর নির্ভর করে। আর গত বছর না হওয়ার পেছনে কারণ হলো গত বছর এই মামলাটা শুনানির জন্য পর্যাপ্ত বিচারক ছিলেন না। এখন আপিল বিভাগে যেহেতু আটজন বিচারক আছেন, আশা করি (এ বছর) এটার শুনানি হবে। তিনি বলেন, আমার প্রচেষ্টা আছে বলেই আমি ফাইল নিয়ে গেছি। আমরাও কিছু ফাইল করেছি। অপর্যাপ্ত সাজা দেওয়ার জন্য কিছু ফাইল করেছি। নিয়মিত বেঞ্চে (শুনানি) হবে। কমপক্ষে চারজনের বেঞ্চ হলেও হবে। ‘কেউ কেউ আর্থিক কারণে আপিল করতে পারছে না বিষয়টি এমন নয়। তার কারণ হলো আর্থিক কারণে কেউ আপিল করতে না পারলে প্রচলিত আইন অনুযায়ী জেলখানায় দরখাস্ত দিলে হয়ে যাবে। বিস্ফোরক আইনের মামলার বিষয়ে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা বলেন, কী কারণে হচ্ছে না সেটা না দেখে বলতে পারবো না। পিলখানা হত্যার ঘটনায় হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আসামিপক্ষ থেকে এরই মধ্যে বেশ কিছু আপিল ও লিভ টু আপিল দাখিল করা হয়েছে।
আইনজীবী আমিনুল ইসলাম ২০৩ আসামির পক্ষে আপিল ও লিভ টু আপিল দাখিল করেছেন। এরমধ্যে ৮২ জনের পক্ষে আপিল এবং বাকিদের পক্ষে লিভ টু আপিল করা হয়েছে। আসামিদের পক্ষে একাধিক আইনজীবী বিলম্ব মওকুফের আবেদনসহ আপিল দাখিল করেছেন এবং করছেন বলে জানা গেছে। আদালতের নিয়ম অনুযায়ী, রায়ের কপি হাতে পাওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে আপিল দাখিল করতে হবে। এ মামলায় ২০১৭ সালের নভেম্বরে রায়ের পর ২০২০ সালের জানুয়ারিতে ১১ দফা পর্যবেক্ষণসহ ২৯ হাজার ৫৯ পৃষ্ঠার হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় ( ডেথ রেফারেন্স ও আপিল) প্রকাশিত হয়। কিন্তু করোনার কারণে এরপর আদালতের কার্যক্রম বন্ধ থাকে। এ কারণে উভয়পক্ষের আপিল দাখিল করতে দেরি হয়। তাই প্রধান বিচারপতির অনুমতি নিয়ে বিলম্ব মওকুফের আবেদনসহ আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় অন রেকর্ডের মাধ্যমে আপিল দাখিল করা হয়। প্রথম আপিল দাখিলের ব্যয় ১৮ লাখ টাকা: হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে প্রথম আপিল দাখিল করতে খরচ হয়েছে ১৮ লাখ টাকা। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে প্রথম আপিলটি করা হয়। এটি ছিল ৬৬ হাজার পৃষ্ঠার। বই বাইন্ডিং, রায়ের সার্টিফায়েড কপি, প্রতিটি চারশ পাতার ভলিয়ম তৈরি, প্রতিটি আপিল ১৪টি সেট প্রস্তুত করে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সংশ্নিষ্ট শাখায় আনুষঙ্গিক নথিপত্রসহ দাখিল করা হয়েছে।
এরপর পেপারবুক ছাড়াই মেমো নম্বর দিয়ে পরবর্তী সময়ে আরও ৪৭টি আপিল দাখিল করা হয়। বিস্ফোরক মামলার বিচার: ঢাকার বিশেষ জজ আদালতে প্রতি মাসে দুইদিন করে বিস্ফোরক মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে। চলতি মাসেও এ মামলার সাক্ষ্যের জন্য দিন ধার্য রয়েছে। এ মামলার বিচারকাজ চলতি বছরই শেষ হবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। এখন পর্যন্ত এক হাজার ৩৪৫ সাক্ষীর মধ্যে ২৫৭ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে। আগামী ২৭ ও ২৮ ফেব্রুয়ারি পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য দিন ধার্য রয়েছে। আসামিপক্ষের আইনজীবী আমিনুল ইসলাম বলেন, আসামিরা ১২ বছর ধরে কারাগারে আছেন। অথচ ২৫৬ আসামির ১০ বছর করে সাজার মেয়াদ ছিল। তাদের সাজা ভোগ শেষ হয়েছে। কিন্তু বিস্ফোরক মামলা বিচারাধীন থাকায় তারা মুক্তি পাচ্ছেন না। ন্যায়বিচারের স্বার্থে দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি হওয়া প্রয়োজন।