প্রধানমন্ত্রীর ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ও চারটি গুরুতর বিচ্যুতি
পোস্ট করেছেন: dinersheshey | প্রকাশিত হয়েছে: এপ্রিল ৯, ২০২০ , ৪:৪৮ পূর্বাহ্ণ | বিভাগ: সম্পাদকীয়
শ্যামল দত্ত, সম্পাদক।
‘আমার করোনা হয়নি অথচ পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে করানোর জন্য আমাকে মরতে হবে।’ ফেসবুকে ২৬ মার্চ এমন একটি পোস্ট দিয়ে ৬ এপ্রিল মারা যান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র সুমন চাকমা। সুমন খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার কৃষক বাবা সুখেন চাকমার সন্তান। ফুসফুসের ক্যান্সার নিয়ে দীর্ঘদিন অসুস্থ সুমন কিছুটা সুস্থ হয়ে আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। কিন্তু সম্প্রতি ঢাকায় অসুস্থ বোধ করলে তাকে করোনার রোগী ভেবে কোনো হাসপাতাল চিকিৎসা দিতে রাজি হয়নি। শেষ পর্যন্ত চট্টগ্রামের এক হোমিও চিকিৎসকের ওষুধ খাওয়ার ২৪ দিন পর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন সুমন চাকমা। যার স্বপ্ন ছিল উচ্চতর পড়াশোনার জন্য বিদেশ যাবেন, কিন্তু তিনি গেছেন পরকালে।
অ্যাম্বুলেন্সে ১৬ ঘণ্টা ৫টি হাসপাতালে ঘোরাঘুরির পরও বিনা চিকিৎসায় মারা গেলেন মুক্তিযোদ্ধা আলমাস উদ্দিন। করোনা নয়, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের রোগী আলমাস উদ্দিনকে নিয়ে পাঁচটি হাসপাতাল ঘুরতে হয়েছে তার পরিবারকে। করোনার উপসর্গ বলে কেউ চিকিৎসা দিতে রাজি হয়নি। শেষ পর্যন্ত বাসাবো এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্যোগে ভর্তি করা হয় মুগদা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে। কিন্তু চিকিৎসা শুরুর আগেই মারা যান বীর মুক্তিযোদ্ধা আলমাস উদ্দিন।
গাইবান্ধার মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে গিয়ে সেখানে ভর্তি হতে পারেননি এক প্রসূতি। শেষ পর্যন্ত সড়কের ওপর ব্যাটারিচালিত ইজিবাইকে সন্তানের জন্ম দিয়েছেন এই প্রসূতি মা। নারায়ণগঞ্জের সঙ্গীতাঙ্গনের প্রিয় মুখ গিটারিস্ট খায়রুল আলম হিরু মারা যান বাড়ির সামনে রাস্তার ওপর। জ্বর সর্দি শ্বাসকষ্ট শুনে হাসপাতাল থেকে নিতে আসা অ্যাম্বুলেন্স তাকে রাস্তায় ফেলেই চলে যায়। বাড়িতে কোনো পুরুষ মানুষ না থাকায় নিজ বাড়ির সামনেই রাস্তার ওপর দীর্ঘক্ষণ পড়ে থাকে তার লাশ।
এই যে কয়েকটি ঘটনা আমাদের চোখে পড়েছে মূলত গণমাধ্যমের কল্যাণে। প্রকৃত অবস্থা তার চেয়েও খারাপ ও ভয়াবহ এবং হৃদয়বিদারক। সাধারণ মানুষের ভোগান্তি এমন চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেছে, খোদ প্রধানমন্ত্রীকে এসব হাসপাতাল ও চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে কঠোর বক্তব্য দিতে হয়েছে। এ কথা ঠিক, করোনার এই দুর্যোগে ঝুঁকি নিয়ে দায়িত্ব পালন করা চিকিৎসকের সংখ্যা কম নয়। ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা দিতে গিয়ে ভাইরাস আক্রান্ত হয়েছেন অনেক ডাক্তার ও নার্স। কোয়ারেন্টাইনে আছেন অনেকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের মাউন্ট সিনাই হাসপাতালে চিকিৎসক ডাক্তার ফেরদৌস খন্দকার আমাকে জানিয়েছেন, শুধুমাত্র চিকিৎসা দিতে গিয়ে ৪০ শতাংশ চিকিৎসক ও নার্স করোনা ভাইরাস আক্রান্ত হয়েছেন। এটার প্রধান কারণ পিপিইসহ নানা ধরনের চিকিৎসা সরঞ্জামের অভাব। আর ইতালিতে ৫৭ জন চিকিৎসক মারা গেছেন করোনা আক্রান্ত হয়ে।
বাংলাদেশে সরকার বলছে পিপিইর অভাব নেই। যদিও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এই বক্তব্যের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করছেন বিএমএ মহাসচিব ড. এহতেশামুল হক চৌধুরী। হাসপাতালে প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের অভাব ও যথাযথ মোটিভেশন না হওয়ায় চিকিৎসকদের মধ্যে ভীতি কাজ করছে বলে তিনি জানান। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে- করোনা নিয়ে এই যুদ্ধকালে ডাক্তাররা যদি ফ্রন্টলাইনে যেতে অস্বীকৃতি জানান তাহলে কীভাবে আমরা পরিস্থিতি সামলাব? দেশে যদি যুদ্ধ লাগে আর সৈনিকরা যদি বলে আমরা যুদ্ধে যাব না, তাহলে কীভাবে আমরা যুদ্ধে জিতব? ১৯৭১ সাল আমাদের কী শিক্ষা দিয়েছে? মৃত্যু অনিবার্য জেনে দেশকে মুক্ত করতে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ কি ঝাঁপিয়ে পড়েনি? পৃথিবীর চৌকস বাহিনী হিসেবে পরিচিত পাকিস্তানি বাহিনীকে পর্যুদস্ত করতে এ দেশের কৃষক শ্রমিক সাধারণ মানুষ এক যৌথ প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল, যেখানে দেশপ্রেম আর মনের বলটাই ছিল প্রধান অস্ত্র।
তাই চিকিৎসা ব্যবস্থার এমন বেহাল অবস্থা দেখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষুব্ধ হওয়াটা যথার্থই। তিনি একদিকে যারা দায়িত্ব পালন করছেন তাদের জন্য প্রণোদনার কথা বলেছেন, আবার অন্যদিকে যারা চিকিৎসা না দিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন, চিকিৎসায় অবহেলা করছেন- তাদের জন্য কঠোর শাস্তির ইঙ্গিতও দিয়েছেন। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, একজন রোগী কেন চিকিৎসার জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরে মারা যাবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রকে কেন চিকিৎসার অভাবে মরতে হলো? তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, যারা নিজেদের সুরক্ষার জন্য পালিয়ে গেছেন, সাধারণ রোগীদের চিকিৎসাবঞ্চিত করেছেন, ভবিষ্যতে তারা ডাক্তারি করতে পারবেন কিনা সেটা চিন্তা করতে হবে। যাদের ডাক্তারি করার সক্ষমতা নেই, তাদের চাকরি থেকে বের করে দেয়া উচিত।
প্রশ্ন হচ্ছে, দেশের সর্বোচ্চ নির্বাহী অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীকে কেন এ ধরনের কঠোর বার্তা দিতে হলো? স্বাস্থ্যসেবার চেইন অব কমান্ড কি পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে? স্বাস্থ্যমন্ত্রী কই? স্বাস্থ্য সচিব কই? মহাপরিচালক বা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অন্য কর্মকর্তারাই বা কোথায়? কোথায় ডাক্তারদের নানা সংগঠন? বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন, স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদসহ নানা নামে নাম ভাঙানো সংগঠনগুলো গেল কোথায়? কোথায় সেই পাঁচ তারকা, চার তারকা হাসপাতাল ও ক্লিনিক- সরকারের নানা সুবিধা নিয়ে বিগত কয়েক দশকে যারা ফুলে ফেঁপে উঠেছে। একটি হাসপাতাল থেকে দেশজুড়ে ২০টি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার গড়ে তুলেছেন- এই সংকটে কেন তাদের কোনো ভূমিকা নেই। দলাদলি, কোন্দল আর নির্লিপ্ততা বন্ধে কোনো উদ্যোগ যদি দেখা না যায়, তাহলে আগামীতে করোনা যে ভয়াবহ সংকট নিয়ে আসছে তা কীভাবে মোকাবিলা করব? দেশের ৬০ শতাংশ লোকের কাছে এখনো সরকারি হাসপাতালগুলোই ভরসা। কিন্তু করোনা সংকটে যখন স্টেডিয়ামকে হাসপাতাল বানানোর চিন্তা চলছে তখন সরকারি-বেসরকারি যৌথ চিকিৎসাব্যবস্থা যদি কার্যকর করা না যায় তাহলে হয়তো এ রকম বিনা চিকিৎসায় আরো বহু মানুষকে প্রাণ দিতে হবে।
প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিকতা সত্ত্বেও অদক্ষ প্রশাসনের কারণে পুরো পরিস্থিতি সামলাতে হ-য-ব-র-ল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। অন্যদিকে অনভিজ্ঞ মন্ত্রিসভার কারণে করোনার এই মহামারিতে নিতান্তই একাকী লড়তে হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। শারীরিকভাবে অসুস্থ দলের দ্বিতীয় কাণ্ডারি সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে হোম কোয়ারেন্টাইনে পাঠিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নিজেই। সিনিয়র নেতাদের একটি বড় অংশই শেখ হাসিনার ক্ষমতার বলয়ের বাইরে। এই পরিস্থিতিতে করোনার ভয়াবহ পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হচ্ছে সিনিয়র কয়েকজন আমলার পরামর্শে। যাদের কাছে গুরুত্ব নেই প্রতিটি সংকটের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষিত। যে কারণেই এই পরিস্থিতি সামলাতে সৃষ্টি হয়েছে এক নজিরবিহীন সমন্বয়হীনতা ও নানা বিচ্যুতি।
গত কয়েক দিনে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার পেছনে প্রশাসনের বেশ কিছু বিচ্যুতি কাজ করেছে বলে অনেকের ধারণা। এর মধ্যে যে চারটি গুরুত্বপূর্ণ বিচ্যুতি করোনা পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলেছে- সেগুলো উল্লেখ করা দরকার।
ক. ছুটি না লকডাউন? : গত ৮ মার্চ প্রথম করোনা শনাক্তের পর ছুটি বা লকডাউন ঘোষণায় ১৬ দিনের বিলম্ব পরিস্থিতি মোকাবিলায় সিদ্ধান্তহীনতার চিত্রই উঠে এসেছে। বিদেশের সঙ্গে বিমান যোগাযোগ বন্ধের ক্ষেত্র সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা দেখা যায়নি। এই সুযোগে করোনা আক্রান্ত ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে চলে এসেছে ভাইরাস বহন করা অনেক মানুষ। ডিসেম্বরে চীনে এই ভাইরাসের সূত্রপাত হলেও চীনা নববর্ষের ছুটি শেষ হওয়ার পর মধ্য জানুয়ারিতে কয়েক হাজার চীনা নাগরিক অনায়াসে বাংলাদেশে ফিরে এসেছে। বাংলাদেশে বিমানবন্দরের ঢিলেঢালা স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যবস্থা নিয়ে নানা প্রতিবেদন তখন গণমাধ্যমে এসেছে। উহান থেকে ফেরত আনা ছাত্রদের আশকোনা হাজি ক্যাম্প কোয়ারেন্টাইনে রাখা গেলেও ইতালিফেরতদের বিক্ষোভের মুখে নতি স্বীকার করে তাদের ছেড়ে দেয়াটা যে কার্যত আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত ছিল, সেটা এখন বোঝা যাচ্ছে। ছুটি ঘোষণা করে ঢাকাবাসীকে ঢাকা ত্যাগের সুযোগ করে দেয়ার সিদ্ধান্তও ছিল অপরিণামদর্শী। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কোয়াস লকডাউন না বলে ছুটি বলার পেছনে যুক্তি তুলে ধরলেও এখন লকডাউন করার যে অপরিহার্যতা দেখা গেছে, তাতে বোঝা যায় আগের সিদ্ধান্তটা ভুল ছিল। ঘরে থাকার জন্য ছুটি দেয়া হলেও নগরবাসী ঈদের মতো গাদাগাদি করে কেউ মনের আনন্দে, কেউ করোনার ভয়ে গ্রামে ফিরে গেছে। ঘরে থেকে সামাজিক দূরত্ব সৃষ্টির যে উদ্দেশ্যে এটা করা হয়েছিল, তা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। স্কুলের ছুটি ঘোষণা নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় যে টালবাহানা করেছে, তা যথেষ্ট দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেয় না। মন্ত্রিসভার বৈঠকে শিক্ষামন্ত্রী ও স্বাস্থ্যমন্ত্রীর তুমুল বাকবিতণ্ডার খবর ইতোমধ্যে ছড়িয়েছে সর্বত্র।
খ. গার্মেন্টস নিয়ে তেলেসমাতি : সরকারের ছুটি ঘোষণার বিষয়টি রাজধানী ও তার আশপাশের প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক কর্মচারীর জন্য প্রযোজ্য হবে কিনা তা নিয়ে সুস্পষ্ট কোনো নির্দেশনা ছিল না। বিজিএমইএ এবং বিকেএমইএর নেতারা বলতে থাকলেন, এই ছুটি গার্মেন্টসের জন্য প্রযোজ্য নয়। গার্মেন্টস ব্যবসায়ী বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বিভিন্ন ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে নির্দেশনা দিলেন স্বাস্থ্যবিধি মেনে গার্মেন্টস খোলা রাখা যাবে। দেশের ছোটখাটো দোকানপাট, ক্ষুদ্র ব্যবসা, মার্কেট, শপিংমল এমনকি চায়ের দোকানও যখন বন্ধ করার নির্দেশ দেয়া হলো, তখন গার্মেন্টস খোলা রাখার সিদ্ধান্তটি সরকারের সামাজিক দূরত্ব তৈরির যে চিন্তা, তার একেবারেই বিপরীত। এই কারণে কিছু গার্মেন্টস থাকল খোলা, কিছু বন্ধ। এর মধ্যে বন্ধের কোনো সুনির্দিষ্ট সময়সীমা উল্লেখ না থাকায় হাজার হাজার শ্রমিক যাতায়াত ব্যবস্থা বন্ধ থাকার পরও শুধুমাত্র চাকরি বাঁচাতে বা বেতনের আশায় অমানবিকভাবে পায়ে হেঁটে, ট্রাকে চড়ে, মিনি ট্রাকে পশু পরিবহনের মতোই ঢাকায় ফিরে এসেছে। কোনো কোনো গার্মেন্টস শ্রমিক প্রশ্ন তুলেছেন আমরা কি মানুষের চাইতেও অধম? এই প্রশ্নের কোনো উত্তর গার্মেন্টস শিল্পের নেতারা দিতে পারেননি বরং সরকারের দেয়া পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা সুবিধা তাদের কতখানি কাজে লাগবে- তার বিচার-বিশ্লেষণে ব্যস্ত ছিলেন।
গ. স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অব্যবস্থাপনা : চীনের উহান থেকে সৃষ্ট এই ভাইরাসের মোকাবিলায় প্রস্তুতি নিতে বাংলাদেশ অন্তত দুই মাস সময় পেলেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারেনি। পর্যাপ্ত কিট সংগ্রহ, পিপিই নির্মাণ ও বিতরণ- সর্বোপরি দেশের সামগ্রিক চিকিৎসা ব্যবস্থায় সমন্বিত পদক্ষেপ নিয়ে প্রস্তুত হওয়ার জন্য যে উদ্যোগ তা দেখা যায়নি। বরং আমাদের পর্যাপ্ত প্রস্তুতি আছে বলে যে বাগাড়ম্বর করা হয়েছে, এটা যে অন্তঃসারশূন্য তা এখন টের পাওয়া যাচ্ছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও রোগতত্ত্ব বিভাগের মধ্যে সমন্বয়হীনতা এবং সামগ্রিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার সংকটের কারণে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়াই তা প্রমাণ করে। খোদ স্বাস্থ্যমন্ত্রী যখন বলেন, আমি করোনা মোকাবিলার জাতীয় টাস্কফোর্সের প্রধান। অথচ এমন সব সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে, যা আমি জানি না। এ রকম অবস্থায় চিকিৎসা ব্যবস্থা বেহাল হওয়াটাই স্বাভাবিক। আজ বিনা চিকিৎসায় যে বহু রোগী মারা যাচ্ছে তা মূলত এই কারণেই।
ঘ. ত্রাণ বিতরণের সমন্বয়হীনতা : করোনায় বিপর্যস্ত নানা শ্রেণিপেশার মানুষের জন্য সরকারি-বেসরকারি ত্রাণ ব্যবস্থার মধ্যে সমন্বয় না থাকায় পুরো ব্যবস্থাটিতে একটি বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। শহরের বিভিন্ন এলাকায় ও গ্রামের পাড়া-মহল্লায় ত্রাণ নিয়ে কাড়াকাড়ি মারামারি সামাজিক দূরত্বের ধারণাকে বিঘ্নিত করেছে। বরং প্রকৃত দুর্গতরা অনেকে ত্রাণবঞ্চিত হয়েছে বলেই প্রধানমন্ত্রীকে ত্রাণ ব্যবস্থায় একটি সমন্বয় করার জন্য নির্দেশনা দিতে হয়েছে। তিনি হুঁশিয়ার করেছেন, ত্রাণ নিয়ে যেন কেউ নয়ছয় না করে। এই ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ইউপি চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের বাড়ি থেকে ত্রাণের বস্তা বস্তা চাল উদ্ধার করা হচ্ছে। এই সুযোগে দুর্নীতিবাজ কিছু কর্মকর্তা অভিনব পদ্ধতিতে চাঁদাবাজিও করছেন। পাবনার এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী এ কে এম বাদশা মিয়া করোনা তহবিলের নামে চাঁদা তোলার জন্য চাঁদাবাজির মামলার আসামি হয়েছেন। ত্রাণ বিতরণের সময় দুর্গত মানুষের মধ্যে মারামারি-রক্তপাতের ঘটনাও ঘটেছে। দুর্যোগের এই পরিস্থিতিতে যদি ত্রাণ ব্যবস্থায় সমন্বয় আনা না যায়, তাহলে মানুষের দুর্ভোগ আরো বাড়বে।
শেষ করব প্রখ্যাত অভিনেতা চার্লি চ্যাপলিনের একটি উদ্ধৃতি দিয়ে। গত পহেলা এপ্রিল ছিল তার ১২৫তম জন্মদিন। তিনি বলতেন, এই পৃথিবীতে কোনো কিছুই স্থায়ী নয়। এমনকি আপনার সংকটগুলোও অস্থায়ী। করোনার এই মহাসংকটের সময়টা হয়তো আমরা একদিন কাটিয়ে উঠতে পারব। তবে এর থেকে যদি আমরা কোনো শিক্ষা নিই সেটাই হবে সংকট থেকে আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় পাওয়া।