আজকের দিন তারিখ ২৩শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শনিবার, ৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সর্বশেষ সংবাদ
সারাদেশ বরিশাল সিটি নির্বাচন : সাদিকের বিরুদ্ধে মুখ খুলছে সাধারণ মানুষ

বরিশাল সিটি নির্বাচন : সাদিকের বিরুদ্ধে মুখ খুলছে সাধারণ মানুষ


পোস্ট করেছেন: Dinersheshey | প্রকাশিত হয়েছে: মে ২৩, ২০২৩ , ৩:৪১ অপরাহ্ণ | বিভাগ: সারাদেশ


বরিশাল অফিস/দিনের শেষে প্রতিবেদক : বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর ‘রাজ্যে’ সবাই ছিলেন বোবা। প্রতিকারের চেষ্টা দূরে থাক, ভয়ে গত সাড়ে চার বছরে কেউ তাঁর ‘শাসনের’ বিরুদ্ধে মুখ পর্যন্ত খোলেননি। মেয়র পদে সাদিক আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পাওয়ায় এতদিন বোবা হয়ে থাকা মানুষ কথা বলতে শুরু করেছেন। জানাচ্ছেন নিজেদের ক্ষোভ ও গুরুতর সব অভিযোগের কথা।
নকশাবহির্ভূত নির্মাণের কারণ দেখিয়ে বাড়ি ভেঙে দেওয়া, জরিমানার নামে টাকা আদায়, ব্যবসায়ীদের কাছে কমিশন দাবি, ভবন নির্মাতাদের কাছে ফ্ল্যাট দাবি, রাজনৈতিক বিরোধীদের মারধর, কথায় কথায় সিটি করপোরেশনের কর্মচারীদের চাকরিচ্যুত করাসহ বহু অভিযোগ রয়েছে মেয়র সাদিক আবদুল্লাহর বিরুদ্ধে। মেয়রের নির্দেশে না চললে হয়রানি ও মিথ্যা মামলায় জেল খাটানো হয়েছে। পূজা উদযাপন পরিষদের কমিটি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কমিটি, বরিশাল ক্লাবও দখল করেছেন মেয়র। কিন্তু কেউ টুঁ শব্দ করতে পারেননি। ২০১৮ সালের নির্বাচনে একতরফা জয় পান আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী সাদিক আবদুল্লাহ। পরের বছর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদও বাগিয়ে নেন। তাঁর বাবা আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগনে এবং পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের শহীদ আবদুর রব সেরনিয়াবাতের ছেলে। আবুল হাসানাত বরিশাল-১ আসনের এমপি এবং জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। পূর্ণ মন্ত্রীর পদমর্যাদায় তিনি পার্বত্য শান্তি চুক্তি নিরীক্ষা কমিটির আহŸায়কের দায়িত্বে রয়েছেন। বরিশাল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী এবং স্থানীয়দের ভাষ্য, মেয়র এবং সাধারণ সম্পাদকের পদ পেয়ে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন সাদিক আবদুল্লাহ। তাঁর অনুগতরা পান আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের পদপদবি। তাঁর বিরোধিতা করলে শুধু অপমান, হয়রানি, মামলা নয়– নকশাবহির্ভূত নির্মাণের অভিযোগ তুলে বাড়িতে সিটি করপোরেশনের বুলডোজার চালানোর ভয়ে সবাই চুপ থাকতেন।
সাদিকবিরোধী হিসেবে পরিচিত আওয়ামী লীগ নেতারা গত সাড়ে ৪ বছরে এলাকায় রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করতে পারেননি। অনেকে ছিলেন এলাকাছাড়া। সিটি করপোরেশনের মেয়ররা নিজ এলাকায় সচিব পদমর্যাদা পান। তবে সাদিক আবদুল্লাহ মন্ত্রীদের মতো গাড়িবহরে পুলিশের জিপ নিয়ে চলতেন। তাতে জনমানুষের মাঝে ভয় আরও বাড়ে। আগামী ১২ জুন বরিশাল সিটি করপোরেশনের ভোট। এবারের নির্বাচনে তাঁকে বাদ দিয়ে তাঁর আপন চাচা আবুল খায়ের আবদুল্লাহকে প্রার্থী করেছে আওয়ামী লীগ। যিনি খোকন সেরনিয়াবাত নামেই বেশি পরিচিত। তিনিও সাদিক আবদুল্লাহর বিরোধী। গত ৪ এপ্রিলের পর বরিশাল আসেননি মেয়র। তিনি মনোনয়ন না পাওয়ার তাঁর অনেক অনুসারীও এলাকাছাড়া। তাঁর ‘একান্ত অনুগত’ হিসেবে পরিচিত বরিশাল মহানগর ছাত্রলীগের বিলুপ্ত কমিটির আহŸায়ক রইজ আহমেদ মান্না গ্রেপ্তার হয়েছেন। খোকন সেরনিয়াবাতের মনোনয়ন প্রাপ্তি এবং সাদিক আবদুল্লাহর বরিশালে না আসাকে অনেকে পটপরিবর্তন হিসেবে দেখছেন। এখন অনেকেই মুখ খুলতে শুরু করেছেন। বরিশাল-৫ (সিটি করপোরেশন এবং সদর উপজেলা) আসনের এমপি এবং পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক শামীম গত ৩০ এপ্রিল খোকন সেরনিয়াবাতকে নিয়ে নেতাকর্মীর মতবিনিময় সভায় বলেছেন, বরিশাল মুক্ত হয়েছে। বরিশালে অনেক অন্যায়, অবিচার, শোষণ ও সন্ত্রাস হয়েছিল। গত চার বছর আমরা কত কষ্টে অতিবাহিত করেছি। আমরা ভয় পেতাম। কত লোককে তারা আহত করেছে। কত লোককে তারা বেইজ্জতি করেছে।
একই কথা বলছেন সাদিকের আপন মামা কাজী মফিদুল ইসলাম কামাল। কাজী কামাল নামে পরিচিত এই ব্যবসাসী বরিশাল ক্লাবের সভাপতি ছিলেন। তিনি বলেন, ২০১৯ সালের মার্চে নির্বাচন ছাড়াই ক্লাবের সভাপতির পদ দখল করেন মেয়র। সভাপতি হতে সদস্য হিসেবে অন্তত ১০ বছর থাকতে হয়। কিন্তু ২০১৬ সালে সদস্য হওয়া সাদিক ভোট ছাড়াই সভাপতি বনে যান। এতদিন কেন আইনি ব্যবস্থা নেননি– প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘মানসম্মানের ভয়ে মামলা করতে পারিনি। কেউ মুখ খুললে, বাড়িতে হামলা করত সাদিক আবদুল্লাহর অনুগত ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ নামধারীরা। মারধর ও গালিগালাজের ভয়ে কোনো ভদ্রলোক কথা বলতে পারেননি। এখন মামলা করব।’ কাজী কামালের ভবন নির্মাণের ব্যবসা রয়েছে। তাঁর প্রতিষ্ঠান বরিশালের দক্ষিণ চকবাজারের বিউটি রোডে পাঁচতলা ভবন নির্মাণ করছে। তিনি জানান, গত সাড়ে চার বছরে বরিশালে যারাই ভবন নির্মাণ করেছে, তাদের কাছে কমিশন হিসেবে ফ্ল্যাট অথবা ফ্লোর চাইতেন সাদিক আবদুল্লাহ। না দিলে কাজ বন্ধ করে দিতেন। পাঁচতলা পর্যন্ত ভবন তোলার পর তাঁর কাছেও অংশীদারিত্ব চেয়েছিলেন তাঁর ভাগনে। রাজি না হওয়ায় ভবনটি নকশা মেনে হচ্ছে না অভিযোগ, চার দিকে ১০ ফুট করে ভেঙে দেয় সিটি করপোরেশন। বরিশাল বিসিক শিল্প মালিক সমিতির সভাপতি এবং ফরচুন গ্রæপের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমানের অভিযোগ, সাদিক আবদুল্লাহ ব্যবসায়ীদের হয়রানি এবং ব্যবসায়িক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতেন। তিনি জানান, বিসিকের প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে কর দাবি করেন মেয়র। যে ব্যবসায়ীর সঙ্গে সম্পর্ক ভালো তাঁর জন্য কর নির্ধারণ করেন ৫ হাজার টাকা। যে ব্যবসায়ী অনুগত নন, তাঁকে ৫ লাখ টাকা কর ধার্য করেন। বিসিকের কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠাকে ট্রেড লাইসেন্স দিচ্ছে না করপোরেশন। ফরচুন গ্রæপের সব শিল্পপ্রতিষ্ঠান ট্রেড লাইসেন্স ছাড়াই চলছে।
মিজানুর রহমান জানান, আমির হোসেন আমু শিল্পমন্ত্রী থাকাকালে বরিশাল বিসিকের অভ্যন্তরে ভ‚মি উন্নয়ন এবং সড়ক নির্মাণে ৭৪ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদিত হয়। শিল্প মন্ত্রণালয়ের এই প্রকল্পের ঠিকাদারি কাজ পেয়েছিল এম এম বিল্ডার্সসহ বরিশালের বাইরের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। ২০১৮ সালে সাদিক মেয়র হওয়ার পর ৩ বছর ঠিকাদারদের কাজ করতে দেননি। কেন কাজ করতে দেননি– প্রশ্নে ওই ব্যবসায়ী বলেন, ‘সাদিক আবদুল্লাহর লোকেরা কাজ না পাওয়ায় বাধা তৈরি করেন। ঠিকাদাররা কাজ করতে না পারায় ফরচুন তাদের হয়ে ভ‚মি উন্নয়ন এবং সড়ক নির্মাণকাজ করলে তাঁর অনুসারীরা হামলা করে। আমার ভাইয়ের হাত ভেঙে দেয়।’ মিজানুর রহমানের দাবি, তাঁর বিরুদ্ধে অপহরণসহ আরও কয়েকটি মামলা করিয়েছেন মেয়র। বরিশালের বড় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের একটি পলি ইঞ্জিনিয়ারিং। সাদিক আবদুল্লাহর মানহানির মামলায় প্রতিষ্ঠানটির মালিক আকবর হোসেন ৩৫ দিন জেলে ছিলেন। তাঁকে শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছে বলে জানান স্থানীয়রা। আকবর হোসেন বর্তমানে ঢাকায় থাকছেন। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে বলেন, ‘আমার সঙ্গে কী হয়েছিল, তা বলতে কষ্ট হচ্ছে। প্রতিবাদ করার বয়স, শারীরিক শক্তি বা টাকা কোনোটাই আমার আর নেই। সব খুইয়েছি।’ তিনি জানান, সাদিক আবদুল্লাহর করা মামলায় বরিশালের আদালতে একজন উকিলও তাঁর ভয়ে আমার পক্ষে দাঁড়ায়নি। বরিশালের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) ওবায়দুল্লাহ সাজু আরও কয়েকজন অংশীদারের সঙ্গে নগরীর ফকিরবাড়ী সড়কে ৯ তলা ভবন নির্মাণ করছেন। এই ভবনটি নকশাবহির্ভূত অভিযোগে সিটি করপোরেশন ৪৫ লাখ টাকা জরিমানা করে। আরও অনেক ভবন নির্মাণকারীকে জরিমানা করেন মেয়র। সাজু জেলার সরকারি আইনজীবী হলেও আইনি প্রতিকার চাননি। তিনি বলেছেন, ‘একটি পিলার নকশার বাইরে ছিল। ভবনের ফ্ল্যাট বিক্রি করা হয়ে গেছে। ভবন ভাঙলে তাদের ক্ষতি হতো। জরিমানার টাকা ব্যাংকে জমা দেওয়া হয়েছে।’
সাদিকের ঘোর বিরোধী পরিচিত কয়েকজন নেতার অভিযোগ, করপোরেশনে নয়, মেয়রের অ্যাকাউন্টে গেছে জরিমানার টাকা। তবে এ অভিযোগের দালিলিক প্রমাণ পায়নি। বরিশাল সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) সৈয়দ ফারুক হোসেন বলেছেন, বিবিধ খাতে জমা হয় জরিমানা। বরিশাল সিটি করপোরেশনের ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট বিশ্লেষণে দেখা গেছে, রাজস্ব আয়ের বিবিধ খাতে আয় ধরা হয়েছে মাত্র ৫ লাখ টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছরে বিবিধ খাতে আয় প্রক্ষেপণ করা হয় ১ লাখ ৯০ হাজার ৯০৯ টাকা। গত অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে বিবিধ খাতে আয় হয় ১ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। কিন্তু গত বছরে বিবিধ খাতে আয় কম কেন– প্রশ্নে সিইও বলেছেন, তিনি জেনে জানাবেন জরিমানার টাকা কোন খাতে জমা হয়েছে। এরপর আর তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি।
বরিশালের সামাজিক সংগঠনগুলোতেও মেয়রের একচ্ছত্র প্রভাব ছিল। মহানগর পূজা উদযাপন এবং হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের নেতৃত্বে অনুগতদের বসান সাদিক আবদুল্লাহ। এতদিন কেউ কথা না বললেও, তিনি বরিশাল ছাড়ার পর হিন্দু সমাজের নেতারাও মুখ খুলেছেন। হিন্দু কল্যাণ ট্রাস্টের সদস্য সুরঞ্জিত দত্ত লিটু জানান, ২০২১ সালে পূজা উদযাপন পরিষদের নির্বাচন পরিচালনা কমিটি মানু লাল দেকে সভাপতি এবং বিশ্বজিৎ ঘোষ বিশুকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করেছিল। কিন্তু সাদিক কেন্দ্রীয় নেতাদের ডেকে নিয়ে নিজের অনুগতদের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক করেন; যারা বিতর্কিত হিসেবে পরিচিত। বরিশালের ১০৯টি মন্দিরের প্রতিনিধিরা মেয়রের দেওয়া কমিটি মেনে নেননি। এখন আইনি প্রতিকার চাওয়া হবে।
সাদিক আবদুল্লাহ জমানায় বিনা নোটিশে চাকরি হারানো বরিশাল সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও মুখ খুলেছেন। প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা, তিনজন নির্বাহী প্রকৌশলী, প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তাসহ ৩৫ জন চাকরি হারিয়েছেন। দায়িত্ব থেকে সরানো হয় ২৮ জনকে। তাঁরা অফিসে হাজিরা দিলেও বেতন পাচ্ছেন না। আরও ১২ জন কর্মচারীকে করপোরেশনে আসতে মানা করেছেন মেয়র। তাঁরা কাজ না করেও বেতন পাচ্ছেন।
চাকরিচ্যুত কর্মচারী জাহাঙ্গীর বলেন, বরিশাল সিটি করপোরেশনের আইন অনুযায়ী চাকরিচ্যুত করতে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিতে হয়, বিভাগীয় মামলা করতে হয়। কিন্তু কাজে অমনোযোগিতা, অফিসে নিয়মিত না আসার অভিযোগে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আইনের নজির দিয়ে তাঁকে সরাসরি চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। চাকরিহারারা রিট করেছেন। কিন্তু মেয়র হাইকোর্টের রুলের জবাবও দেননি।
এত অভিযোগের বিষয়ে সাদিক আবদুল্লাহর বক্তব্য জানতে পারেনি। বক্তব্যের জন্য সিটি করপোরেশন কার্যালয়ে গিয়ে এবং তাঁর সহকারী একান্ত সচিব মোস্তফা জামান মিলনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। মোবাইল ফোনে যোগাযোগের পরামর্শ দিয়ে তিনি জানান, মেয়র ঢাকায়। কিন্তু মেয়রকে ফোন কল ও এসএমএস করেও সাড়া পায়নি। হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজের জবাব দেননি তিনি।