মোহাম্মদ আলীর বিখ্যাত যুদ্ধ বিরোধী ভাষণ
পোস্ট করেছেন: admin | প্রকাশিত হয়েছে: জুন ১১, ২০১৬ , ১:০৩ অপরাহ্ণ | বিভাগ: সারাবিশ্ব,সারাবিশ্ব লীড
অনলাইন আন্তর্জাতিক ডেস্ক: শুক্রবার চির নিদ্রায় শায়িত হয়েছেন বিশ্বখ্যাত মুষ্ঠিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী, যিনি সারাজীবন তিনি শান্তি ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করে গেছেন। রিং থেকে অবসর নেয়ার পরও তার সে লড়াই শেষ হয়নি।
মুষ্টিযোদ্ধা হিসেবে তিনি বিশ্ব জুড়ে খ্যাতি লাভ করলেও তার জীবনের সবচাইতে কঠিনতম ও চ্যালেঞ্জিং সিদ্ধান্তটি ছিল ১৯৬৭ সালে আমেরিকান সেনাবাহিনীতে সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়ে ভিয়েতনাম যুদ্ধে যোগ না দেয়ার ঘোষণা। এর মাধ্যমে তিনি আমেরিকার মত পরাশক্তির সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়েন। প্রতিশোধ হিসেবে তার হেভিওয়েট খেতাব ও পদক কেড়ে নেয় মার্কিন প্রশাসন। তার প্রিয় বক্সিং থেকেও তাকে নিষিদ্ধ করা হয়। এখানেই শেষ নয়, তার বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দেয়া হয়। ১৯৬৭ সালের ২০ জুন আদালতে তাকে ১০ হাজার ডলার জরিমানা করা হয় এবং পাঁচ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। কিন্তু এত সব প্রতিকূলতার মধ্যেও নিজের মত করে লড়াই চালিয়ে যেতে থাকেন সাহসী আলী। বিভিন্ন সমাবেশে যুদ্ধ বিরোধী বক্তব্য দিয়ে ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করতে থাকেন। অবশেষে হেরে যায় রাষ্ট্র। চার বছর পর তার ওপর থেকে তুলে নেয়া হয় নিষেধাজ্ঞা। দীর্ঘ দিন পর রিংয়ে ফিরে পুনরায় হেভিওয়েট শিরোপা পুনরুদ্ধার করেন।
সে সময় যুক্তরাষ্ট্রে এক যুদ্ধবিরোধী সমাবেশে দেয়া আলীর বিখ্যাত ভাষণটি পাঠকদের জন্য অনূদিতকরা হল।
‘প্রথমে আমি আজকের রাতের এত সুন্দর ও মূল্যবান অনুষ্ঠানে আমাকে নিমন্ত্রন জানানো ও বক্তব্য রাখার সুযোগ দেয়ার জন্য এখানকার সকাল শিক্ষার্থী ও গভর্নিং বডিকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। ঘৃণ্য ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার জন্য সকলকে আমার অভিনন্দন। ভিয়েতনামে যে ঘৃণ্য যুদ্ধটি চলছে তা বন্ধ করার জন্যই আজকের এই মহতী আয়োজন। একজন মুসলিম প্রতিনিধি হিসেবে যুদ্ধ ও সহিংসতা সম্পর্কে আমার দৃষ্টিভঙ্গি ইতিমধ্যে সবাই জেনে গেছেন। আমি বলতে চাই, আমরা মুসলমানরা পরস্পরের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করার সময়ও শান্তির কথা বলি। আমরা যা বলি তা হচ্ছে, আসসালামু আলাইকুম যার অর্থ হচ্ছে তোমার ওপর শান্তি বর্ষিত হউক। আমি কেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছি তা নিয়ে অনেক সমালোচনা হচ্ছে। তারা বলছে, এই পদক্ষেপের কারণে নাকি আমাকে অনেক কিছু হারাতে হবে। এ নিয়ে আমি ইতিমধ্যে অনেক কথা বলেছি। আমি এই মুহূর্তে সেইসব সমালোচক ও প্রেসকে বলতে চাই, আমি কিছুই হারাইনি। বরং এর মাধ্যমে আমি অনেক কিছু অর্জন করেছি। প্রথমত: আমি মনে প্রাণে শান্তি পেয়েছি। আমি জানি যে এর মাধ্যমে আমি মহা পরিক্রমশালী প্রভু যার প্রকৃত নাম আল্লাহ, তারও সন্তুষ্টি লাভ করেছি। এছাড়া আমি আজ এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত সকলের শ্রদ্ধা অর্জন করেছি। আমি কেবল এখানকার প্রত্যেকের শ্রদ্ধাই লাভ করিনি বরং বিশ্ব জুড়ে শান্তিকামী সকল মানুষের শ্রদ্ধা পেয়েছি। তবে আমার যুদ্ধে না যাওয়ার এই সিদ্ধান্তটি সম্ভবত সেইসব গুটিকয়েক মানুষকেও খুশি করেছে যারা যুদ্ধের জন্য সবসময় ইন্ধন জোগাতে থাকে। যুদ্ধে যাওয়ার বিনিময়ে আমেরিকা যদি তার সকল সম্পদ এবং যুদ্ধকে সমর্থনকারী লোকজনের বন্ধুত্বের প্রস্তাব দিত তাহলেও আমি আমার যুদ্ধে না যাওয়ার সিদ্ধান্তে অটল থাকতাম। কেননা আমি মন থেকে এই যুদ্ধকে সমর্থন করতে পারছি না। আপনারা সংবাদপত্র ও প্রেস থেকে ইতিমধ্যে জেনেছেন যে আমাকে বিচারের জন্য আদালতে আদালতে দাঁড়াতে হচ্ছে। আমাকে এই দেশের আইনে আদালতের কাছে ন্যায়বিচার চাইতে হবে। আপনাদের আমি স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, এই দেশ, ইউনাইটেড স্টেটস অব আমেরিকা, যেখানে খ্রিস্টান মিনিস্টাররা সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ গ্রহণ থেকে বিরত থাকার সুযোগ পায়। আমি একজন মুসলিম মিনিস্টার এবং ইসলামের শিক্ষক। অথচ আমাকে বলা হয়েছে, আমার কাছে নাকি কেবল মাত্র দুটো বিকল্প আছে। হয় আমাকে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে হবে নয়তো জেলে যেতে হবে। কিন্তু আমি তাদের বলতে চাই, আরো একটি বিকল্প আছে এবং সেটি হচ্ছে ন্যায়বিচার। আমি যদি ন্যায়বিচার পাই তবে আমাকে সেনাবাহিনীতে কিংবা জেল দুটোর কোনটাতেই যেতে হবে না। তারা বলে, প্রকৃতপক্ষে প্রতিটি সময় রিংয়ে থেকে আমি নাকি যুদ্ধই করে চলেছি। তারা আমাকে বলে, তুমি তো একজন পুরস্কার বিজয়ী যোদ্ধা। তাহলে যুদ্ধে যেতে তোমার আপত্তি কোথায়। এ দুটোর মধ্যে পার্থক্যই বা কি? আমি সেইসব সাংবাদিক ও সমালোচকদের বলতে চাই, রিংয়ে দাঁড়িয়ে মুষ্টিযুদ্ধ করা আর ভিয়েতনাম যুদ্ধ করতে যাওয়ার মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। বক্সিং কিন্তু এরকম কোনো যুদ্ধ নয়, যেখানে মেশিনগান, বাজুকাস, হ্যান্ডগ্রানেড ও বোমারু বিমান নিয়ে যেতে হয়। বক্সিংয়ে আমার সম্পূর্ণ লক্ষ্য থাকে একটি স্বচ্ছ লড়াই করে জয় ছিনিয়ে আনা। কিন্তু যুদ্ধের উদ্দেশ্য হচ্ছে হত্যা, হত্যা, হত্যা, হত্যা এবং নিরীহ মানুষজনকে হত্যার কাজটি চলতেই থাকে। আর এটার নামই হচ্ছে যুদ্ধ। আমি এখন আপনাদের কাছ থেকে একটি কথা শুনতে চাই এবং এ কথাটি শোনার জন্য ক্যামেরাও তৈরি আছে। বলুন, বিশ্বের হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন কে! (তখন উপস্থিত জনতা সমস্বরে মোহাম্মদ আলীর নাম ধরে চিৎকার করতে থাকে) আমি খুব সন্তুষ্ট এবং এ অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার জন্য আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ।’