আজকের দিন তারিখ ২৫শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, বুধবার, ১০ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সর্বশেষ সংবাদ
/////হাইলাইটস///// যুগে যুগে মহামারির যত রূপ

যুগে যুগে মহামারির যত রূপ


পোস্ট করেছেন: dinersheshey | প্রকাশিত হয়েছে: এপ্রিল ১৩, ২০২০ , ৭:৩৯ পূর্বাহ্ণ | বিভাগ: /////হাইলাইটস/////


দিনের শেষে ডেস্ক : এ গল্প একদিন, একবছর বা একদশকের নয়। মানব সভ্যতার শুরু থেকেই মহামারির উপস্থিতি দেখা গেছে। কখনো কলেরা আবার কখনো বা প্লেগ নামে আমরা মহামারিকে চিহ্নিত করেছি। তবে যে নামেই মহামারি পরিচিতি পেয়েছে না কেনো প্রতিবারই কেড়ে নিয়েছে কোটি কোটি মানুষের প্রাণ। ইতিহাসে মহামারির কালো ছোয়া লেগেছে অনেকবার। এর কোনো কোনোটা সম্পর্কে আমরা হয়তো জানি আবার কোনোটা এখন কালের বিবর্তনে হারিয়েও গেছে। মহামারির কারণে বহু নগর সভ্যতা হারিয়েছে, অনেক মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। মা হারিয়েছে সন্তান, বোন হারিয়েছে ভাই। কয়েক হাজার বছর আগের পৃথিবী শাসন করা মিসরের ফারাওয়দের অবিকৃত মমির গায়েও গুটিবসন্তের চিহ্ন মিলেছে। গোটা পৃথিবী শাসন করা এসব শাসকদেরও হার মানতে হয়েছিল মহামারির কাছে। সেসব এখন ইতিহাস। সহজ করে বলতে গেলে, মানব সভ্যতার ইতিহাসের শুরু থেকেই রয়েছে মহামারির প্রাদুর্ভাব। অনেক গল্প, উপন্যাস, সিনেমাও তৈরি হয়েছে এ নিয়ে। তাছাড়া মহামারির বিস্তার রোধে নির্দিষ্ট এলাকার মানুষকে অন্য এলাকায় ভ্রমণে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে অনেক ধর্মে। আমরা যদি ইতিহাস দেখতে যাই তাহলে খ্রিষ্টপূর্ব ৪৩০ অব্দেই এথেন্সে মহামারির তথ্য মেলে। এথেন্স তখন ছিলো ‘গ্রিসের ফুসফুস’। পেলোপনেসিয়ান যুদ্ধের সময় একটি রোগ মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছিল এথেন্সে। এতে ওই অঞ্চলের তিনভাগের দুইভাগ মানুষ মারা যায়। কেউ মারা গেলে তার আশ-পাশের দুই-তিন ঘরের মানুষের মৃত্যু নিশ্চিত ছিলো। মানুষ মৃত্যুর ভয়ে পালিয়ে বেড়াতো জঙ্গল, মরুভূমিতে। নৌকা নিয়ে পাড়ি জমাতো নদীতে। এথেন্সবাসীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়া ওই মহামারিতে আক্রান্তদের শুরুতে জ্বর, প্রচণ্ড তৃষ্ণা ও গলাব্যাথা দেখা দিতো। পরে জিহ্বা রক্তাক্ত ও ত্বক লালচে হয়ে দেহের বিভিন্নস্থানে ক্ষতের সৃষ্টি হতো এবং সর্বশেষ পরিণতি ছিলো মৃত্যু। ১৬৫ খ্রিষ্টাব্দে জার্মানে মুরগি থেকে ছড়িয়ে পড়ে ‘অ্যান্টনি প্লেগ’। ১৮০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বিস্তিত এ মহামারি ছড়িয়ে পড়েছিল জার্মান সেনাবাহীনিতে। তখন মানুষ পশুর মাংস খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিল। কিন্তু সংক্রামণ রোগী থেকে এ রোগ ছড়িয়ে পড়ছিল গোটা দেশে। শুরুতে আক্রান্ত সেনাদের জ্বর, গলা ব্যথা ও ডায়রিয়া দেখা দিতো। পরে দেহে পুঁজযুক্ত ক্ষত হতো এবং শেষ পর্যন্ত মারা যেতো তারা। সাইপ্রিয়ান প্লেগ পৃথীবিতে বেঁচে ছিলো প্রায় ৩ শ বছর। বিশ্বে দীর্ঘসময় যেসব মহামারি টিকে ছিলো এটি তার মধ্যে অন্যতম। কার্থেজ অঞ্চলের এক চার্চের যাজকের নামানুসারের এ ভাইরাসের নামকরণ করা হয়েছিল। তিনি প্রথম এ রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। এ মহামারি রোমান সাম্রাজ্যকে একেবারে দুর্বল করে দিয়েছিল। রাজপরিবারেও হানা দিয়েছিল এটি। এ মহামারি উত্তর আফ্রিকা হয়ে রোম, সেখান থেকে মিশর এবং আরো উত্তরে ছড়িয়ে পড়েছিল। সাইপ্রিয়ান প্লেগ ২৫০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ৪৪৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত টিকে ছিলো। মিসরে জাস্টিনিয়ান প্লেগ মহামারি আকারে ছড়িয়েছিল ৫৪১ খ্রিষ্টাব্দে। সম্রাট জাস্টিনিয়ান ওই সময় রোমান সাম্রাজ্যের সঙ্গে বাইজেন্টাইনকে একীভূত করার পরিকল্পনা করছিলেন। মহামারির কারণে সব বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। অর্থনৈতিক সংকট আর চিকিৎসার অভাবে মারা গিয়েছিল অন্তত পাঁচ কোটি মানুষ। যা ছিলো তখনকার সময় পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ২৬ শতাংশ। এই প্লেগের মূল বাহক ছিলো ইঁদুর। সে সময় কেউ রোগাক্রান্ত হলে ছুটে পালাতো তার সঙ্গী-স্বজনরা। মধ্যযুগে ইউরোপে মহামারি আকারে ছড়িয়েছিল কুষ্ঠরোগ। একাদশ শতাব্দীতে এ রোগে প্রাণ হারান লাখ লাখ মানুষ। অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কারের আগ পর্যন্ত কুষ্ঠ ছিলো প্রাণঘাতী। সে সময়কার মানুষের ধারণা ছিলো এ রোগ ঈশ্বর প্রদত্ত পাপের শাস্তি। অবশ্য এখনও বছরে লাখ লাখ লোক কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত হয়ে থাকেন। কিন্তু প্রাণহানী অতি নগন্য। মহামারির সবচেয়ে ভয়ঙ্কর চিত্র দেখা যায় ১৩৪৬ থেকে ১৩৫৩ সালে। এ মহামারি ‘ব্ল্যাক ডেথ’ নামে কুখ্যাতি পেয়েছিল। বুবোনিক প্লেগ নামের এ ভাইরাসে মাত্র সাত বছরে মারা গিয়েছিল অন্তত আট কোটি মানুষ। তিন থেকে সাত দিনের মধ্যেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তো আক্রান্তরা। মধ্য এশিয়ার সমভূমিতে এই রোগের জন্ম। এরপর এটি সিল্ক রোড হয়ে ক্রিমিয়ায় পৌঁছায়। বণিকদের জাহাজে বসবাস করা কালো ইঁদুর ও ইঁদুর মাছি নামে দুটি প্রজাতির মাধ্যমে ভূমধ্যসাগর এবং ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে মহামারি। ১৪ শ শতাব্দীতে এই প্লেগের কবলে পড়ে বিশ্বের জনসংখ্যা ৪৫০ মিলিয়ন থেকে ৩৭৫ মিলিয়নে নেমে আসে। প্রাচীনতম মানুষের মহামারিতে যতো ভয়াবহ পরিবর্তন হয়েছিল তার এক ভয়ঙ্কর ইতিহাস এটি। মহামারিটি মাত্র কয়েক মাসে একেবারে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল জনপদ, শহর, বসতী। ক্যারিবিয়ানে স্প্যানিশদের আগমনের পর ১৪৯২ সালে মহামারি রূপ নেয় গুঁটি বসন্ত। আক্রান্ত ৯০ শতাংশ ব্যক্তিরই মৃত্যু হতো। হিসপানিওলা দ্বীপপুঞ্জে ছড়িয়ে পড়া এ মহামারির ফলে দ্বীপটির প্রায় ৯৯.৯ শতাংশ মানুষেরই মৃত্য হয়েছিল। ১৫৪৮ সালে দেখা যায় সেখানে মাত্র ৫০০ লোক বেঁচে আছেন। যেখানে ১৪৯১ সালে ছিলো অন্তত ৬০ হাজার মানুষ। এছাড়া ১৬ শ এবং ১৭ শ শতাব্দীতে ৫৬ মিলিয়ন আমেরিকান এ মহামারিতে মারা যান। মহামারির আসল রূপ দেখা যায় ১৬১৬ সালে, লন্ডনে। স্মল পক্স, ইনফ্লুয়েঞ্জা, টাইফাসসহ অজানা আরো ভাইরাস জ্বরে লন্ডন মৃত্যুর মুখে পড়ে। ঘরে ঘরে মানুষ মরতে শুরু করে। মৃত্যুর এমন মিছিল হয়তো লন্ডন আগে দেখেনি। দেশটির ৯০ শতাংশ মানুষ অজানা রোগে আক্রান্ত হয়। মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয় শহর-জনপদ। মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশেরই মৃত্যু হয়। রোগের আতঙ্কে নির্বিচারে শহরের সব কুকুর-বিড়াল মেরে ফেলা হয়। এছাড়া গ্রেট প্লেগ অব লন্ডন, গ্রেট প্লেগ অব অস্ট্রিয়া কয়েক লাখ প্রাণহানি ঘটিয়েছিল। পরের শতকে বলকান অঞ্চলে মহামারি আঘাত করে। ৫০ হাজার মানুষ মারা গিয়েছিল ১৭৩৮ সালের প্লেগে। একই শতকে রাশিয়া ও পার্সিয়া ভয়ঙ্কর মহামারির মুখে পড়ে। দুই লাখ মানুষ মারা যাওয়ার পর পার্সিয়া অভিশপ্ত হিসেবে গণ্য হতো। উনিশ শতকে আসে কলেরা। ১৮১৭ সাল থেকে শুরু হয় এর প্রাদুর্ভাব। ইউরোপ ও এশিয়ায় এক লাখ মানুষ কলেরায় মারা যায় ১০ বছরের ব্যবধানে। সে সময় কলেরা প্রতিরোধের কোনো উপায় খুঁজে পায়নি বিশ্ব। উনিশ শতকের মাঝামাঝি নিশ্চিত মৃত্যুর অপর নাম হয়ে ওঠে রোগটি। কলেরা তখন বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছিল। ইউরোপ, এশিয়া ও উত্তর আফ্রিকাতে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় এক লাখে। তৃতীয়বারের মতো কলেরা মহামারির রূপ নেয় রাশিয়াতে। সেখানেও এক লাখের বেশি মানুষ মারা যাওয়ার কথা বলা হয়। পরবর্তী আরো দেড় শ বছর ধরে কলেরা বিভিন্ন সময়ে কয়েক দফায় মহামারি আকারে দেখা দিয়েছিল। ১৮৫৫ সালে ভারত ও হংকংয়ে ছড়িয়েছিল প্লেগ মহামারি। চীন থেকে এর সূত্রপাত হয়েছিল। প্রায় দেড় কোটি মানুষ এই মহামারির শিকার হয়েছিল। ভারতে এই মহামারি সবচেয়ে প্রাণঘাতী রূপ নিয়েছিল। রাশিয়ান ফ্লু ছিলো ‘ফ্লু’র মাধ্যমে ছড়ানো প্রথম মহামারি। সাইবেরিয়া ও কাজাখস্তানে এর সূত্রপাত হয়ে মস্কোর পর ফিনল্যান্ড ও পোল্যান্ডে তা ছড়িয়ে পড়ে। একপর্যায়ে ইউরোপেও দেখা দেয় মহামারি। সমুদ্র পেরিয়ে উত্তর আমেরিকা ও আফ্রিকা অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়েছিল এই ফ্লু। ১৮৯০ সালের শেষ নাগাদ এই রোগে প্রায় ৩ লাখ ৬০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। বিংশ শতাব্দীর শুরুর আগে পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছিল ইনফ্লুয়েঞ্জা। জ্বরের আদলে এই রোগে প্রাণ যায় এক লাখের বেশি মানুষের। বিশ্বে অন্তত পাঁচ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল স্প্যানিশ ফ্লুর কারণে। এর উৎপত্তি হয়েছিল চীনে। যা চীনা শ্রমিকদের মাধ্যমে কানাডা হয়ে ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। উত্তর আমেরিকায় এই ফ্লু দেখা দেয় ১৯১৮ সালের শুরুর দিকে। স্পেনের মাদ্রিদে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ার পর এর নাম হয় ‘স্প্যানিশ ফ্লু’। ১৯১৯ সালে গরম শুরু হলে এই রোগের প্রকোপ কমে আসে। স্পেনে মোট ৮০ লাখ মানুষ এই ফ্লুতে আক্রান্ত হয়েছিল। বিশ্বব্যাপী আক্রান্তের সংখ্যা ছিলো ৫০ কোটি মানুষ। এশিয়ান ফ্লু হংকং থেকে চীনে ছড়ায়। পরে যুক্তরাষ্ট্র হয়ে যুক্তরাজ্যেসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করে। এতে বিশ্বে ১১ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই মারা গিয়েছিল ১ লাখ ১৬ হাজার মানুষ। ১৯৬০ সালে পৃথিবীবাসী মুখোমুখি হয় এইচআইভি বা এইডসের সঙ্গে। এখনও পর্যন্ত ৩০ লাখ মানুষ এ রোগে মারা গেছে। পোলিওতে ভুগেও বিশ্বের নানা প্রান্তে অকালে প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। তবে একবিংশ শতাব্দীতে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় মহামারি হিসেবে দেখা হচ্ছে করোনাভাইরাসকে। এ শতাব্দীতে সার্স, মার্স, ডেঙ্গু, জিকা, ইবোলার মতো প্রাণঘাতী রোগের কথা জেনেছে বিশ্ব। কিন্তু সব কিছুকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে চীনের করোনাভাইরাস। এখন পর্যন্ত এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে অন্তত সাড়ে ১৬ লাখ মানুষ। মৃত্যু ছাড়িয়েছে ৯৫ হাজার। মৃতের মিছিলে প্রতিদিনই যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন নাম। হারিয়ে যাচ্ছে সম্ভাবনা, স্বপ্ন!